নিজেদের সার্টিফিকেটের ‘মূল্যায়ন’ নেই জাবিতে

প্রকাশ : ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  তানভীর রিফাত অনিক জাবি প্রতিনিধি

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে ‘উইকেন্ড কোর্স’ থেকে প্রদত্ত সার্টিফিকেটের যথাযথ মূল্যায়ন করা হয় না। তবে দীর্ঘদিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘অবৈধভাবে’ এই কোর্স চলমান রয়েছে। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ে এমফিল ও পিএইচডিতে ভর্তির ক্ষেত্রে সিন্ডিকেটের নিয়মণ্ডনীতি মানা হচ্ছে না। জানা যায়, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) অনুমোদনহীন ‘উইকেন্ড কোর্স’ থেকে বছরে প্রায় ৩৫ কোটি টাকা আয় করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। ২০১১ সালে একটি ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে এই কোর্স চালু হলেও এখন তা চলছে ১৮টি বিভাগ ও ইনস্টিটিউটে। সাধারণত এক বছরে তিনটি সেমিস্টারে সাপ্তাহিক এসব কোর্সের স্নাতকোত্তর ডিগ্রি দেয় বিভাগগুলো। তবে ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (আইবিএ) ও ইংরেজি বিভাগ ২ বছরের স্নাতকোত্তর ডিগ্রি দেয়। মূলত বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ব্যক্তি, জাতীয় ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক সম্পন্ন করা শিক্ষার্থী ও বেকার শিক্ষার্থীরা এসব কোর্সে ভর্তি হন। এই সার্টিফিকেট কাজে লাগিয়ে দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে পদোন্নতি মিললেও নিজেদের ক্ষেত্রে এর মূল্যায়ন শুধু একটি সার্টিফিকেট মাত্র, যা ব্যক্তিগত ফাইলে সংরক্ষিত হলেও পদোন্নতিতে গ্রহণযোগ্য হয় না। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হতে অর্জিত ইভিনিং ও উইকেন্ড মাস্টার্স ডিগ্রিকে নিয়োগ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে বেসিক ডিগ্রি হিসেবে গণ্য করা হবে কি না, তা বিবেচনার জন্য ২০১৯ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ‘উইক-অ্যান্ড কোর্সের ডিগ্রি নিয়োগ বা পদোন্নতির জন্য গৃহীত হবে না। তবে এরই মধ্যে যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের যথাযথ অনুমোদন নিয়ে বর্ণিত ডিগ্রি অর্জন করেছেন, তাদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে উক্ত ডিগ্রি গণনা করা যেতে পারে। এরপর কাউকে ভর্তি অনুমোদন করা যাবে না।’ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. শরীফ এনামুল কবীরকে সভাপতি করে গঠিত এ কমিটির অন্যরা হলেন- অধ্যাপক ড. মুহম্মদ হানিফ আলী, কোষাধ্যক্ষ রাশেদা আখতার, ডেপুটি রেজিস্ট্রার (প্রশাসন-২) ড. এবিএম কামরুজ্জামান, ডেপুটি রেজিস্ট্রার (টিচিং) মোহাম্মদ আলী। রেজিস্ট্রার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ২০২২ সালের ২৭ জুন অনুষ্ঠিত সিন্ডিকেট সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, নির্দিষ্ট আটটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্স সার্টিফিকেটের সনদ পদোন্নতির জন্য গৃহীত হবে। বাদ পড়ে যায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব উইকেন্ড কোর্স। তবে যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন সাপেক্ষে ২০২১ সালের ৯ জানুয়ারি কমিটি গঠনের পূর্বে যারা ডিগ্রি অর্জন করেছেন শুধু তাদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে এই সার্টিফিকেট গ্রহণযোগ্য হবে। এ ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ২ বছরের অভিজ্ঞতা প্রয়োজন হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিবিধি অনুযায়ী, প্রতিটি পদোন্নতির জন্য স্নাতক সার্টিফিকেটের ক্ষেত্রে ৬ বছর এবং স্নাতকোত্তরের ক্ষেত্রে ৪ বছরের অভিজ্ঞতা প্রয়োজন হয়। তাই অতিরিক্ত ২ বছরের অভিজ্ঞতা চাওয়ার ফলে ইভিনিং মাস্টার্স সার্টিফিকেট পদোন্নতির ক্ষেত্রে কোনো কাজেই লাগছে না। যাকে সার্টিফিকেটের ‘অবমূল্যায়ন’ হিসেবে দেখছেন বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, আমাদের সার্টিফিকেটের মূল্যায়ন করবে না, তাহলে উইকেন্ড কোর্সে ভর্তির আগেই বিষয়টি জানাতে পারত। আমরা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করতাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন সিদ্ধান্তে শুধু আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হব না, সার্টিফিকেটের মান নিয়েও প্রশ্ন উঠবে। এখন আবার কার্যকারিতাবিহীন এই সার্টিফিকেট উত্তোলনের জন্য ৮ হাজার টাকা দিয়ে সমাবর্তনে অংশগ্রহনের সুযোগ দেয়া হচ্ছে, যা রীতিমতো প্রহসন ছাড়া কিছুই নয়।

এ বিষয়ে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ও সিন্ডিকেট সদস্য ড. মুহম্মদ হানিফ আলী বলেন, এটা নিয়ে সরাসরি মন্তব্য করতে পারব না। ব্যক্তিগতভাবে আমি চেয়েছিলাম সমস্যাটির সমাধান হোক কিন্তু সিন্ডিকেট সভায় সিদ্ধান্ত হওয়ার পর আর কিছু বলার থাকে না।

এমফিল পিএইচডিতে আইন বহির্ভূত ভর্তি : উচ্চশিক্ষা ও বৃত্তি শাখা সূত্রে জানা যায়, ২০২১ সালের ১৪ জুলাই সিন্ডিকেট মিটিংয়ে এমফিল ও পিএইচডি প্রোগ্রামে উইকেন্ড ও ইভিনিং প্রোগ্রামের সনদ গ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু প্রতি বছরই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উইকেন্ড প্রোগ্রাম থেকে মাস্টার্স করা শিক্ষার্থীদের এমফিল ও পিএইচডি প্রোগ্রামে ভর্তি করা হচ্ছে। ফলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষার মান নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে এমফিল ও পিএইচডি প্রোগ্রামে সাতজন শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়। ২০২৩-২৩ শিক্ষাবর্ষে এ প্রোগ্রামে আরও তিনজন শিক্ষার্থী ভর্তি হন, যারা প্রত্যেকেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উইকেন্ড প্রোগ্রামে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে এমফিল ও পিএইচডি প্রোগ্রামে ভর্তি হয়েছেন।

এ বিষয়ে এমফিল পিএইচডি প্রোগ্রামে ভর্তি হওয়া নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক শিক্ষার্থী বলেন, সার্কুলার হলে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগাযোগ করি। তখন বিভাগ থেকে সুপারিশ করা হলে ভর্তি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করি। তখন কেউ কোনো ধরনের নিয়মের বাধার কথা বলেননি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক মো. গোলাম মোয়াজ্জেম হোসেন রেগে যান। তিনি বলেন, আমার শিক্ষার্থী একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। তার ডিগ্রি প্রয়োজন তাই তাকে ভর্তি করা হয়েছে। তবে এসব প্রোগ্রামে কেউ ভর্তি হতে চায় না।

সাংবাদিকতা পেশাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তিনি বলেন, ‘আপনারা সাংবাদিকরা দুই নম্বর লোক। আপনাদের কাজ সবকিছুতে বাধা দেয়া’। সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্তের বিষয়ে অবগত কি না, জানতে চাইলে মো. গোলাম মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, ‘আমরা নিয়ম জানি। আপনি আরও ভালোভাবে খোঁজ নেন। এসব বিষয়ে আমাকে ফোন দেবেন না।’ বলে ফোন কেটে দেন তিনি।

এ বিষয়ে উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলম জানান, ‘আপাতত আমরা সমাবর্তন নিয়ে ব্যস্ত আছি। এখন সবকিছু মনে নেই। আমি জেনে বিষয়টি জানাব।’

উল্লেখ্য, ২০১৯ সালের ৯ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ সান্ধ্য কোর্সের (বর্তমানে উইকেন্ড কোর্স) সমালোচনা করলে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে চিঠি দিয়ে জানায়, বাণিজ্যিক কোর্সগুলো থাকা উচিত নয়। এরপর ‘ইভিনিং কোর্স’ নাম পাল্টে উইকেন্ড কোর্স রাখে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।