আলোচিত সুনামগঞ্জ সদরের নারায়ণতলা গ্রামের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার বাড়িসহ বেশ কয়েকটি বাড়িতে গোয়েন্দা সংস্থার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা পরিচয়ে তল্লাশি, শ্লীলতাহানি, লুটের চেষ্টাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ভুয়া পরিচয়ে অভিযানের নামে অর্থ ও মূল্যবান সামগ্রী আত্মসাতের মূলহোতা আব্দুল কুদ্দুস ডলার নাহিদকে রাজধানীর মিরপুর থেকে গ্রেপ্তার করছে র্যাব। সাম্প্রতিককালে এক শ্রেণির পেশাদার প্রতারক চক্র প্রতারণার নতুন নতুন কৌশল ব্যবহার করে সাধারণ জনগণকে বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে তাদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। ধর্ষণ, জঙ্গিবাদ, মাদকসহ অন্য সব ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি সাম্প্রতিক সময়ে গোয়েন্দা সংস্থার ভুয়া ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার মিথ্যা পরিচয়দানকারী চক্রের সাথে সম্পৃক্ত অপরাধীদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে র্যাব এর অভিযান অব্যাহত রয়েছে। গত ২৫ জানুয়ারি ২০২৩ তারিখ রাতে সুনামগঞ্জ জেলার সদর থানাধীন নারায়ণতলা গ্রামের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার বাড়িসহ বেশ কয়েকটি বাড়িতে কিছু দুষ্কৃতকারী গোয়েন্দা সংস্থার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার মিথ্যা পরিচয় দিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক চেয়ারম্যান মো. মোকসেদ আলীর বাড়ি ও তার আশপাশের কয়েকটি বাড়িতে অভিযান চালায়। অভিযানের নামে তারা বেশ কয়েকটি বাড়িতে লুটপাট চালায় এবং তল্লাশির নামে বেআইনিভাবে গৃহবধূর শ্লীলতাহানির ঘটনা ঘটায়। বিষয়টি মিডিয়াতে ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক আলোচিত হয়। উক্ত ঘটনার প্রেক্ষিতে একজন ভিকটিম বাদী হয়ে গত ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ তারিখ সুনামগঞ্জ মডেল থানায় একটি মামলা দায়ের করে। যার মামলা নং-২১, তারিখ ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩। পরবর্তীতে সংশ্লিষ্ট থানা কর্তৃক উক্ত আসামিদের গ্রেপ্তারে র্যাবের সহায়তা চাইলে র্যাব বর্ণিত মামলার আসামিদের গ্রেপ্তারে গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে। এরই ধারাবাহিকতায় গত ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ তারিখ র্যাব-৪ কর্তৃক উক্ত মামলার এজাহারনামীয় আসামি বিজন রায়কে মিরপুর মডেল থানাধীন এলাকা হতে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারকৃত বিজন এর মাধ্যমে র্যাব জানতে পারে সুনামগঞ্জের বর্ণিত এলাকার বিভিন্ন বাড়িসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গোয়েন্দা সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মিথ্যা পরিচয় দিয়ে লুটপাট এবং চাঁদাবাজির মূল পরিকল্পনাকারী আব্দুল কুদ্দুস ডলার নাহিদ। উক্ত তথ্যের ভিত্তিতে র্যাব ডলার নাহিদ’কে খুঁজতে নজরদারি বৃদ্ধি করে এবং বিজনের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে র্যাব গত রাতে রাজধানীর মিরপুর এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে দেশের বিভিন্ন স্থানে নিজেকে গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উর্ধ্বতন কর্মকর্তার মিথ্যা পরিচয়ে অভিযানের নামে অর্থ ও মূল্যবান সামগ্রী আত্মসাতের মূলহোতা আব্দুল কুদ্দুস ডলার নাহিদ (৩০), পিতা আলী আজগর, পল্লবী, ঢাকাকে গ্রেপ্তার করে। উদ্ধার করা হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভুয়া পরিচয়পত্র এবং প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পোশাক পরিহিত ছবি। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তারকৃত আব্দুল কুদ্দুস ওরফে ডলার নাহিদ বর্ণিত ঘটনার সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে তথ্য প্রদান করে।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, গ্রেপ্তারকৃত আব্দুল কুদ্দুস ডলার নাহিদ বিভিন্ন সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিভিন্ন গ্রুপে মানুষের কাছে নিজেকে গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে মিথ্যা পরিচয় প্রদান করত। জিজ্ঞাসাবাদে আরও জানা যায় যে, সে প্রাথমিক শিক্ষার গন্ডি পেরিয়েছে এবং ২০০৯ সালে তার মাধ্যমিক পরীক্ষা দেয়ার কথা থাকলেও সে নিজেকে ১৯৯৬ সালের এসএসসি ব্যাচ দাবি করে এবং বিভিন্ন কৌশলে উক্ত ব্যাচের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম গ্রুপে যুক্ত হয়ে নিজেকে গোয়েন্দা শাখা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে পরিচয় প্রদানের মাধ্যমে বিভিন্ন সময় অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন ব্যক্তির টাকা, জমি ও ফ্ল্যাট উদ্ধারের নামে প্রতারণা করত। সে নিজেকে গোয়েন্দা শাখা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উর্ধ্বতন কর্মকর্তার মিথ্যা পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলত। পরবর্তীতে সে নিজেকে মিথ্যা পরিচয় দিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযানের নামে বিভিন্ন বাড়ি হতে তল্লাশির সময় নগদ অর্থ, স্বর্ণালংকার ও মূল্যবান সামগ্রী লুট করত। অনেক ক্ষেত্রে সে প্রতারণার মাধ্যমে কৌশলে প্রশাসনের সহায়তা নিত। প্রতারণার কৌশল হিসেবে সে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পরিচিতদের নিকট হতে বিভিন্ন ভুক্তভোগী সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করত এবং ভুক্তভোগীদের বিভিন্ন সহায়তা প্রদানের আশ্বাস প্রদান করে তাদের আস্থা অর্জনের মাধ্যমে প্রতারণা করত। গ্রেপ্তারকৃতরা আরও জানায় যে, ৪/৫ মাস পূর্বে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের একটি গ্রুপের মাধ্যমে তার বিজনের সঙ্গে পরিচয় হয়। পরবর্তীতে রাজধানীতে সে বিভিন্ন সময় পূর্বে গ্রেপ্তারকৃত বিজনের সঙ্গে ৭/৮ বার সাক্ষাৎ করে এবং বিজনের বাড়ি সুনামগঞ্জে হওয়ায় সে বিজনের আমন্ত্রণে সুনামগঞ্জ গমন করে। গ্রেপ্তারকৃত বিজন সুনামগঞ্জের স্থায়ী বাসিন্দা হওয়ায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে তার সু-সম্পর্ক ছিল। পরবর্তীতে সে বিজনের সঙ্গে সুনামগঞ্জে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের নিকট কৌশলে নিজেকে গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে পরিচয় প্রদান করে। অতঃপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানান যে, এখানে সে মাদকের একটি চালানের বিরুদ্ধে অভিযান করতে এসেছেন এবং অভিযানের জন্য তাদের সহায়তা কামনা করে। এসময় সে পূর্বে গ্রেপ্তারকৃত বিজন ও অন্য সহযোগীদের সমন্বয়ে সুনামগঞ্জ জেলার সদর থানাধীন নারায়ণতলা এলাকায় বিভিন্ন বাড়িতে লুটের জন্য পরিকল্পনা করে। প্রথমত তারা লুটের উদ্দেশ্যে উক্ত এলাকায় বিত্তশালী কয়েকটি বাড়ি টার্গেট করে এবং ০৩ দিন ধরে টার্গেটকৃত বাড়ি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে ও বিভিন্নভাবে পর্যবেক্ষণ করে। পরবর্তীতে সে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ তারিখ রাতে ঘটনাস্থলে যান।
পরবর্তীতে সে স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করে উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে সমন্বয়ের কথা জানিয়ে তাদের ঘটনাস্থলে আসতে বলে। পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক নিজেকে গোয়েন্দা সংস্থার উর্ধ্বতন কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে তারা বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক চেয়ারম্যান মো. মোকসেদ আলী বাড়িসহ আশপাশের বাড়িতে তল্লাশি করে এবং বাড়িতে থাকা লোকজনের শ্লীলতাহানি করে। এসময় তারা তল্লাশি কার্যক্রম পরিচালনা করে নগদ অর্থ, স্বর্ণালংকার ও অন্যান্য মূল্যবান সামগ্রী হাতিয়ে নেয়। উক্ত ঘটনা জানাজানি হলে তারা অভিযান শেষ করে দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগের চেষ্টা করে। একপর্যায়ে স্থানীয় লোকজন তাদের আটক করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সংবাদ দেয়। এসময় সে নিজেকে গোয়েন্দা শাখার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার মিথ্যা পরিচয় দিয়ে কৌশলে সেখান থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। উল্লেখ্য যে, সে গত ৫/৬ বছর যাবত ঢাকা ও পাবনাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় গোয়েন্দা সংস্থার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে ভুয়া পরিচয় দিয়ে অভিযানের নামে বিভিন্ন বাড়ি হতে নগদ অর্থ ও মূল্যবান সামগ্রী লুট করেছে। গ্রেপ্তারকৃত আব্দুল কুদ্দুস ডলার নাহিদ ঢাকা জেলার একটি স্কুল হতে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে।
সে ২০১৬ সালে ঢাকায় একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে সিকিউরিটি গার্ডের চাকরি নেয়। সিকিউরিটি গার্ডে চাকরির সুবাদে সে বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে পরিচয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে পারে। এসব কার্যক্রমকে রপ্ত করে গত ৫/৬ বছর যাবত নিজেকে গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একজন কর্মকর্তা হিসেবে মিথ্যা পরিচয় দিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতারণা করে আসছে। এর আগে সে গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মিথ্যা পরিচয় দিয়ে হুমকি প্রদানকালে র্যাব কর্তৃক গ্রেপ্তাার হয়ে বেশ কিছুদিন কারাভোগ করে। গ্রেপ্তারকৃতের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।