দ্য ডনের প্রতিবেদন
পাকিস্তানে অর্থনৈতিক সংকটে রমজানে চরম দুর্ভোগের শঙ্কা
প্রকাশ : ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
আলোকিত ডেস্ক
বড় ধরনের অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে রয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার পরমাণু শক্তিধর দেশ পাকিস্তান। দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ অনেক কমে গেছে। কমেছে রপ্তানির পরিমাণ আর পাল্লা দিয়ে বেড়েছে আমদানি। একই সঙ্গে মার্কিন ডলারের বিপরীতে পাকিস্তানি রুপির অব্যাহত দরপতন তো আছে-ই। এতে করে পাকিস্তানে আসন্ন রমজানে দুর্ভোগ আরও বৃদ্ধি পাওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। গতকাল এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে পাকিস্তানি সংবাদমাধ্যম দ্য ডন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি বছর পাকিস্তানে রমজান অবশ্যই অনেক নিম্ন ও মধ্যম আয়ের গোষ্ঠীর লোকদের জন্য আগের বছরের তুলনায় কঠিন হবে। বিশেষ করে গত বছরের তুলনায় এবার পণ্য-দ্রব্যের আকাশছোঁয়া দামের কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হবে।
দ্য ডন বলছে, দিনে ১২ ঘণ্টার বেশি সময় রোজা রাখার পর লোকেরা অনেক আইটেম সাজিয়ে মজাদার ইফতার উপভোগ করার চেষ্টা করে থাকেন। তবে বাড়তি দ্রব্যমূল্যের কারণে মাঝারি বেতন পান এমন অনেক লোক এ বছর তাদের কেনাকাটা সীমিত করতে বাধ্য হবেন। পবিত্র এই মাসে সুলভ মূল্যে ভোগ্য পণ্যের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের। তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ অনুমোদনের আশা জাগানো ছাড়া শেহবাজ সরকার আর কিছুই করছে না। তারা বরং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলায় বেশি নিমগ্ন। আর তাই স্বস্তি আনতে পারে এমন বিশেষ কোনো পদক্ষেপ সরকারের কাছ থেকে আশা করা কঠিন। পাকিস্তানের ভোক্তারা গত বছর দ্রব্যের কিছুটা বাড়তি দাম প্রত্যক্ষ করলেও এবার শেহবাজ শরিফের নেতৃত্বাধীন সরকার পণ্যের দাম কমানোর জন্য কোনো ভর্তুকি প্রদান বা শুল্ক/কর শিথিল করার মতো অবস্থানে নেই। এছাড়া কর ও শুল্ক কমিয়ে দাম কমানোর যেকোনো প্রচেষ্টা ঋণ অনুমোদনের আগে আইএমএফকে ক্ষুব্ধ করতে পারে।
এছাড়া কমপক্ষে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ না কমে দ্রব্যমূল্য কেবল ১০-২০ শতাংশ কমলে সেটিও ভোক্তাদের সন্তুষ্ট করতে পারবে না।
দ্য ডন বলছে, কোনো ধরনের সুবিধা দেয়ার পরিবর্তে শেহবাজ শরিফের সরকার সম্প্রতি অনেক পণ্যের ওপর সাধারণ বিক্রয় কর (জিএসটি) ১৭ শতাংশ থেকে ১৮ শতাংশ এবং ফলের রসের ওপর ১০ শতাংশ ফেডারেল আবগারি শুল্ক বাড়িয়েছে। এতে করে ঘি বা রান্নার তেল এবং প্যাকেটজাত জুসগুলো সাধারণ মানুষের জন্য ব্যয়বহুল হয়ে গেছে।
পাকিস্তানের প্রভাবশালী এই সংবাদমাধ্যমটি বলেছে, সাম্প্রতিক সময়ে খাদ্যদ্রব্যের ঘন ঘন মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি সরকার খুব কমই গুরুত্ব সহকারে নিয়েছে এবং এতে করে প্রস্তুতকারক ও বাজারের অংশীদাররা তাদের ইচ্ছামতো দাম বাড়াতে পেরেছেন।
ডিজেলের ক্রমবর্ধমান মূল্য এবং গ্যাস ও বিদ্যুতের উচ্চমূল্যের পাশাপাশি ক্রমবর্ধমান কাঁচামালের দাম, পরিবহণ খরচ, ডলারের বিপরীতে রুপির অবমূল্যায়নসহ উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির মতো বিভিন্ন কারণকে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির জন্য নির্মাতারা দায়ী করছেন। অন্যদিকে গত ৩ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পাকিস্তানে ডলারের বিপরীতে রুপি শক্তিশালী হয়েছে। এতে করে দেশটিতে এখন ২৬২ রুপিতে মিলছে এক মার্কিন ডলার। আর এর ফলে আমদানি করা কাঁচামালসহ অন্য কিছু পণ্যের খরচ কমিয়ে আনা হয়েছে।
তবে এরপরও প্রস্তুতকারকরা মূল্যস্ফীতি-জর্জরিত ভোক্তাদের কম খরচের কোনো সুবিধা দিচ্ছেন না। তারা ডলারের বিপরীতে রুপির অবমূল্যায়ন এবং মূল্য বৃদ্ধির পুরোনো সুরে জোরেশোরে দাম বাড়ানো অব্যাহত রেখেছেন। এছাড়া উচ্চ উৎপাদন খরচ এবং রুপির পতনের কারণে মূল্যবৃদ্ধির দাবির ন্যায্যতা প্রমাণের জন্য বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্যের প্রস্তুতকারকদের কোনো শক্ত প্রমাণ দিতে বাধ্যও করতে পারেনি শেহবাজ সরকার। ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে রমজানের প্রথম সপ্তাহ থেকে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত দ্রব্যমূল্যের তুলনা করলে দেখা যায় এই সময়ের মধ্যে পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানে ২০ কেজি আটার ব্যাগের মূল্য সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। এই ওজনের প্রতিটি আটার ব্যাগের দাম ৮০০ থেকে ১৫০০ রুপি থেকে বেড়ে ১২৯৫ থেকে ২৭২০ রুপিতে পৌঁছেছে। বিদেশ থেকে প্রচুর পরিমাণে গম আমদানি এবং দেশের গম ফসলের মজুদ থাকা সত্ত্বেও ময়দার দাম ক্রমাগত বেড়েছে। এছাড়া শস্য চোরাচালান এবং মিলারদের গম না ছাড়ার বিষয়গুলো নিয়মিতভাবেই সংবাদমাধ্যমের শিরোনামে জায়গা করে নিয়েছে।
সংবাদমাধ্যমটি বলেছে, একজন স্ত্রী এবং দুই থেকে তিন সন্তান নিয়ে মাসিক ২৫ হাজার থেকে ৪০ হাজার রুপি উপার্জনকারী একজন ব্যক্তি কীভাবে ইফতারি ও সেহরির ব্যবস্থা করবেন? এক লিটার দুধ, ফল, বেসিন, দই, ঘি এবং মিষ্টান্ন আইটেমের দৈনিক খরচ ধরে নিলে প্রতিদিন আনুমানিক ১ হাজার থেকে দেড় হাজার রুপির প্রয়োজন হয়। যদিও এই হিসাবটিতে ছোলা, জুস, কোল্ড ড্রিংকস এবং শাকসবজি অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
করাচি রিটেইল গ্রোসারস গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক ফরিদ কুরেশি বলছেন, ‘আমি পবিত্র রমজান মাসে দাতব্য বিতরণের জন্য দুই ধরনের রেশন প্যাক তৈরি করছি : একটি ব্যাগের দাম ৪ হাজার রুপি এবং এতে আটা, চিনি, চাল, ডাল, চা, লবণ, তেল এবং ঘি, ছোলা ও ভার্মিসেলি রয়েছে। অন্য রেশন ব্যাগের দাম ৬ হাজার রুপি এবং এতে আরও বেশি পরিমাণে পণ্য রয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘গত রমজানে আমরা ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ কম দামে এই পণ্যগুলো বিতরণ করতে পেরেছিলাম। এ বছর আমরা রেশন প্যাকে চাল যোগ করতে পারিনি কারণ ভালো মানের বাসমতি চাল প্রতি কেজি ৩০০ থেকে ৫০০ রুপিতে বিক্রি হয়, যা গত বছর প্রতি কেজি ১৫০ থেকে ৩০০ রুপি ছিল।’ করাচির আবাসিক এলাকা হিসেবে পরিচিত ফেডারেল বি এরিয়ার একজন মুরগি ব্যবসায়ী বলেন, ‘আমি এখন চারটি ক্রেটে ৪০টি জীবন্ত মুরগি রাখছি। দাম কম থাকার সময় আমি আটটি ক্রেট রাখতাম। উচ্চ মূল্যের কারণে, আমাদের অনেক নিয়মিত গ্রাহক আগে দুই থেকে তিনটি মুরগি কিনলেও এখন পুরো সপ্তাহের খরচের জন্য শুধু একটি মুরগি কেনেন।’
দ্য ডন বলছে, খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির এই তীব্রতা অনেক নিম্ন আয়ের মানুষকে কল্যাণ সংস্থার বিনামূল্যে ইফতারি ও সেহরির আয়োজনের দীর্ঘ লাইনের দিকে ঠেলে দিতে পারে। তবে কোনো মধ্যবিত্ত ব্যক্তির পক্ষে তার আত্মসম্মান বিসর্জন দেয়া এবং ইফতার সীমিত করার বিকল্পটি বেছে নেয়া কঠিন হতে পারে।