সিন্ডিকেটের কারসাজি
অর্ধেকে নেমেছে উপকূলের উৎপাদিত লবণের দাম
প্রকাশ : ০২ মার্চ ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
এএইচ সেলিম উল্লাহ, কক্সবাজার
আমদানি শুল্ক বাড়ানোর কারণে দামের পড়তা বেশি হওয়ায় গত বছর বিদেশ থেকে লবণ আমদানি করতে পারেনি সিন্ডিকেট। ফলে দেশীয় লবণের দাম বেড়েছে। গত বছরে জমানো লবণ মৌসুমের আগেই বিক্রি হয়েছে প্রতি মণ ৩৫০ হতে ৪০০ টাকায়। দেশীয় লবণ বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে দেখে চাষে ঝুঁকেছিল উপকূলীয় লবণ চাষিরা। ফলে গত বছরের চেয়ে এবার প্রায় ১০ হাজার একর বেশি জমিতে লবণ চাষ হয়েছে। আর শুরু থেকেই লবণের দাম মিলেছে প্রতি মণ ৪৫০ হতে ৫০০ টাকা। এতে বেজায় খুশি ছিলেন চাষিসহ লবণ সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু উপকূলে উৎপাদিত লবণের দাম হঠাৎ পড়ে গেছে। ভরা মৌসুমে লবণ মিল মালিকরা সিন্ডিকেট করে প্রতি মণ লবণের দাম ৫০০ টাকা থেকে কমিয়ে অর্ধেকে অর্থাৎ ২৫০ টাকায় নামিয়েছে বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের। এতে লাভের আশায় বেশি জমিতে চাষ বাড়ানো চাষিরা লবণ বিক্রি করে লোকসানের আশঙ্কা করছেন। কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের বাঁশখালী মিলিয়ে প্রায় ৩৮ হাজার প্রান্তিক চাষি লবণ উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত। আর বেচা-কেনা, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও পরিবহণসহ নানাভাবে লবণ শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে আছে লাখো পরিবারের জীবিকা।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) কক্সবাজারের তথ্য অনুযায়ী, চলতি মৌসুমে (১৫ নভেম্বর থেকে ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত পাঁচ মাস) কক্সবাজার সদর, ঈদগাঁও, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, পেকুয়া, চকরিয়া, টেকনাফ ও বাঁশখালী উপজেলায় ৬৬ হাজার ২৯১ একর জমিতে লবণ উৎপাদন চলছে। এবারের লবণ উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২৩ লাখ ৮৫ হাজার মেট্রিক টন। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত গত ৩ মাসে উৎপাদন হয়েছে প্রায় ৬ লাখ সাড়ে ৭৪ হাজার মেট্রিক টন লবণ। যা গত মৌসুমে এ সময়ের তুলনায় সাড়ে ৩ লাখ মেট্রিক টন বেশি। গত বছর এ সময়ে উৎপাদন হয়েছিল ২ লাখ ৯১ হাজার ৫৮ টন। তখন প্রতি মণ লবণ বিক্রি হয়েছিল ৩৫০ টাকায়। বিসিক সূত্র আরো জানায়, এখন কক্সবাজার উপকূলে দৈনিক ১৭ হাজার মেট্রিক টন লবণ উৎপাদন হচ্ছে। সপ্তাহখানেক আগেও মণপ্রতি লবণ বিক্রি হয়েছিল ৪৮০-৫০০ টাকায়। কিন্তু কয়েক দিন ধরে লবণের দাম অর্ধেক নেমে এসেছে। তাতে চাষিরা হতাশ হচ্ছেন। লোকসানের আশঙ্কায় উৎপাদন বন্ধ রাখা হলে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ কঠিন হয়ে পড়বে।
কক্সবাজারের ঈদগাঁও, কুতুবদিয়া, মহেশখালী, পেকুয়া, চকরিয়া ও টেকনাফ উপজেলায় প্রতি মণ লবণ বিক্রি হচ্ছে ২৫০ টাকায়। কক্সবাজার সদরের কিছু এলাকায় বিক্রি করে মিলছে ২৫০-২৮০ টাকা। এতে লবণ উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত ৩৫ হাজার প্রান্তিক চাষিসহ প্রায় এক লাখ শ্রমজীবী মানুষ আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তবে লবণ মিলমালিকরা বলছেন, মাঠপর্যায়ে প্রতি মণ লবণের দাম ২৫০ টাকা হলেও তারা (মিলমালিক) লবণ কিনছেন ৩৫০-৩৬০ টাকায়। মাঝখানে শতাধিক টাকার মুনাফা চলে যাচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগী ও দাদন ব্যবসায়ীদের পকেটে।
কক্সবাজারের ঈদগাঁও উপজেলার ইসলামপুরে লবণ প্রক্রিয়াজাতকরণের কারখানা (মিল) আছে ৬৯টি। উপকূলে উৎপাদিত অধিকাংশ লবণ এখানেই বেচাবিক্রি হয়। চলতি মৌসমে এখানকার ৩৫টি কারখানায় লবণ উঠছে।
কক্সবাজার লবণচাষি ও ব্যবসায়ী সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি মকছুদ আহমদ কোম্পানি বলেন, অসাধু মিলমালিক সিন্ডিকেটের ষড়যন্ত্র বন্ধ ও দেশীয় লবণের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা জরুরি। একসপ্তাহ আগেও মাঠে মণপ্রতি ৫০০ আর মিল পর্যায়ে ৫৭০ টাকা পাওয়া গেছে। বর্তমানে মাঠে ২৬০ টাকা। মিলে ৩৪০ টাকা। হঠাৎ এমন দরপতন মেনে নেয়া যায় না। ন্যায্যমূল্য না পেলে লবণ সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া হবে। দেশীয় স্বয়ংসম্পন্ন লবণ শিল্পের বাজার ধ্বংস করতে যারা ষড়যন্ত্র করছে তাদের কঠোর শাস্তির দাবি সর্বস্তরের লবণচাষিদের। গোমাতলীর চাষি রিদুয়ানুল হক (৩২) বলেন, সাত দিন আগেও প্রতি মণ লবণ তিনি বিক্রি করেছি ৫০০-৪৯০ টাকায়। এখন সেই লবণ বিক্রি করতে হচ্ছে ২৫০ টাকায়। আগামীতে লবণের দাম আরো কমতে পারে, এই শঙ্কায় আছি আমার মতো অগণিত চাষি। প্রতি মণ লবণ উৎপাদনে চাষিদের খরচ পড়ছে ২০০ টাকার বেশি। এখন বিক্রির পর দালালি ও পরিবহন খরচ বাদ দিয়ে উৎপাদন খরই উঠছে না। তবে, কিছু কিছু এলাকায় ২৫০-২৮০ টাকায়ও বিক্রি হচ্ছে লবণ।
চৌফলদন্ডী এলাকার লবণচাষি জমির উদ্দিন (৪৫) বলেন, সপ্তাহখানেক আগেও প্রতি মণ লবণ ৪৭০ টাকায় বিক্রি করেছি। কিন্তু গত বুধবার কিছু লবণ বিক্রি করতে চাইলে দালাল (লবণ ক্রেতা) দাম দিবে বলেছে ২৫০ টাকা। হঠাৎ এত দাম পড়ে যাওয়ার কারণ কি জিজ্ঞেস করলে বলেছে, মিলমালিক সিন্ডিকেট কারসাজি করেছেন। উপকূলে উৎপাদিত সিংহভাগ লবণ কিনে নেয় মিলমালিকরা। তারা সিন্ডিকেট করে এখন ২৫০ টাকার বেশি দামে লবণ কিনতে চাইছেন না।
কক্সবাজার সদরের খুরুশকুল বায়ুবিদ্যুৎ এলাকার লবণ চাষি হামিদুল ইসলাম বলেন, তিন একর জমিতে চাষ শুরুর পর গত তিন মাসে সাড়ে ৪০০ মণ লবণ বিক্রি করেছি। ডিসেম্বরে প্রতি মণ লবণের দাম পেয়েছি ৫০০ টাকা। গত বুধবার লবণ বিক্রি করতে চেয়ে দাম বলেছে ২৫০ টাকা। উৎপাদনের ভরা মৌসুমে লবণের মূল্য কমে যাওয়ায় আমাদের মতো চাষিদের মাথায় বাজ পড়েছে বলে মনে হচ্ছে। এসব দেখার যেন কেউ নেই।
ইসলামপুর লবণ মিলমালিক সমিতির সভাপতি শামসুল আলম আজাদ বলেন, মাঠ থেকে আনা এক বস্তা (দুই মণ) লবণ আমরা ৭২০ টাকায় কিনছি। মণপ্রতি লবণের দাম পড়ছে ৩৬০ টাকা। কিন্তু চাষিরা পাচ্ছেন ২৫০ টাকায়। মধ্যখানে ১১০ টাকার মতো মধ্যস্বত্বভোগী ও দাদন ব্যবসায়ীদের পকেটে যাচ্ছে। নানা শর্তে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে অগ্রিম দাদন নিয়ে চাষে নামেন চাষিরা। উৎপাদিত লবণ বিক্রির সময় মণপ্রতি ৪০-৫০ টাকা কমিশন নিয়ে চলে যায়। এ ক্ষেত্রে চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। সরকারিভাবে প্রান্তিক চাষিদের সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করা জরুরি বলে মন্তব্য করেন তারা।
বিসিক লবণ উন্নয়ন প্রকল্পের মাঠ পরিদর্শক মো. ইদ্রিস আলী বলেন, পলিথিন প্রযুক্তিতে এখন ৬৬ হাজার একর জমিতে দৈনিক ১৭ হাজার মেট্রিক টনের বেশি লবণ উৎপাদিত হচ্ছে। চাষিরা, মৌসুমের শুরুতে (ডিসেম্বর) মাঠে উৎপাদিত প্রতি মণ লবণ ৩০০-৩৫০ টাকায় বিক্রি করেছে। জানুয়ারিতে সেই লবণ বিক্রি হয় প্রতি মণ ৫০০ টাকা। তবে এখন তা আবার কমে প্রতি মণ ২৫০ টাকায় ঠেকেছে। লবণের দাম আবার বাড়বে, সে আশায় চাষিরা উৎপাদন চালিয়ে যাচ্ছেন। ঈদগাঁওয়ের উপকূলীয় পোকখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রফিক আহমদ বলেন, গত বেশ কয়েক বছর লবণের দাম নাজুক অবস্থায় ছিল। উৎপাদন ও বিক্রয়ে সঙ্গতি না থাকায় অনেকে বাপ-দাদার পেশা লবণ চাষ ছেড়ে বিভিন্ন পেশায় মনোনিবেশ করেছে। কিন্তু গত বছর আমদানি লবণ না আসায় মাঠ পর্যায়ে লবণের দাম কেজিতে ১০ টাকা পেয়েছিল চাষিরা। ডিসেম্বরেও একই দাম থাকায় আবার নতুন করে পেশায় ফিরেছেন অনেকে। এখন আবার দাম কমে যাওয়ায় হতাশা বিরাজ করছে চাষিদের মাঝে। পোষাবে না হিসাব করে মাঝ পথেই অনেকে উৎপাদন বন্ধ রাখার চিন্তা করছেন। লোকসানের ঝুঁকি নিয়ে লবণ উৎপাদনের সক্ষমতা অনেকের নেই। তাই মিলমালিকদের কারসাজি বন্ধে এখনই উদ্যোগ নেয়া দরকার বলে উল্লেখ করেন তিনি। বিসিক সূত্র মতে, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে চলা জরিপ অনুযায়ী জেলায় প্রান্তিক লবণ চাষির সংখ্যা ৩৭ হাজার ২৩১। চাষিদের সহযোগী হিসেবে (লবণ শ্রমিক) মাঠে কাজ করেন আরো ৮৭ হাজার মানুষ। গত মৌসুমে ৫৭ হাজার একর জমিতে লবণ চাষ হয়েছিল। লবণ উৎপাদন হয় ১৮ লাখ ৩২ হাজার ৩৬ মেট্রিক টন। এ বছর চাষ হচ্ছে ৬৬ হাজার ৩০০ একর জমিতে।