একটি পোর্টালের শিরোনাম দেখে রীতিমতো চমকে উঠার মতো অবস্থা। এটা কী করে সম্ভব! অনেকটা ঘাবড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। এমন যদি হতো, তাহলে তো আর মানুষের কোনো পেরেশানি থাকত না। দ্রুত ন্যায় বিচার পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা অনায়াসে পূরণ হয়ে যেত। আইন-আদালতের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা আরো অনেক বেড়ে যেত। বিচারাধীন মামলার জট বলতে আর কিছুই থাকত না। বারবার চোখ আটকে যাচ্ছিল আসলে খবরটা কি সত্যিই বাস্তব? পরে খুব খেয়াল করে দেখলাম আসলেই সত্য। এই বাংলাদেশে এমনি ঘটনা ঘটতে পারে! এই বাংলাদেশ সব সম্ভবের দেশ। আমরাও পারি। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার অনেক চ্যালেঞ্জ নিয়ে দেশ পরিচালনা করছে। একেকটা মেগা প্রকল্প একেকটি চ্যালেঞ্জ। আর এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই এগিয়ে যাচ্ছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা। আর তারই কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই এগিয়ে চলার পথে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তারই দুরদর্শিতায় বাংলাদেশ আজ উন্নয়নশীল দেশের কাতারে। দেশের বিচারাঙ্গন আজ স্বাধীনভাবে বিচারকাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। যেসব ঘটনা আদালতের কাছে অস্বাভাবিক বলে বিবেচ্য হচ্ছে, যেখানে আইনি সহায়তা দেয়া দরকার, সেখানে বিচারকরা স্বপ্রণোদিত হয়ে রুলিং দিচ্ছেন। আদালতের নির্দেশনায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিচ্ছে। অতি সম্প্রতি কুষ্টিয়ায় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রী নির্যাতনের ঘটনায় আদালত হস্তক্ষেপ করায় ওই ছাত্রীর ন্যায় বিচার পাওয়ার পথ সুগম হয়েছে। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে এরই মধ্যে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। আদালত আরেকটি মহতী দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন গত ২ মার্চ। ওই দিনের ওই পোর্টালের খবরটি ছিল আসলেই ব্যক্তিক্রম এবং দৃষ্টি আকর্ষণের।
ওই দিন ‘হাইকোর্টের ৯ বেঞ্চে ৩১৯০ মামলার নিষ্পত্তি’ হওয়ার মতো খবরটি ছিল জাতির জন্য চমকপদ। এমন শিরোনামের খবর বাংলাদেশের কোনো গণমাধ্যমে স্মরণকালে প্রকাশিত হয়েছে, এমনটা মনে পড়ে না। বার বার শিরোনামটি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তে গিয়ে দেখা গেল, না সেটি ২ মার্চ তারিখেরই শিরোনাম। বাংলাদেশের আদালতগুলোতে মামলার ঝট নিয়ে এমন কোনো মহল খুঁজে পাওয়া যাবে না, যারা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় নেই। আইনের মারপ্যাচ সাধারণ মানুষের যেমন বোঝার কথা নয়, তেমনি ‘৯ বেঞ্চে একদিনে ৩ হাজার ১৯০ মামলার নিষ্পত্তি’ এমন বক্তব্যটি সাধারণ মানুষের সাধারণ জ্ঞানে অনুধাবন করার মতো নয়। তবে মানুষ অত্যন্ত সহজে বুঝতে পেরেছে, এটি একটি অত্যন্ত মহতী উদ্যোগ। বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থায় প্রচলিত রয়েছে ‘কাউকে শায়েস্তা করতে হলে একটা মামলা দিয়ে দাও’। মামলার কী যন্ত্রণা, সেটি ভুক্তভোগীরাই জানেন। অনেক মানুষ মামলার ঘানি টানতে টানতে তার সহায় সম্পদ হারিয়ে পথের ভিখারি হয়েছেন। মামলার তারিখে হাজিরা দিতে গিয়ে কিংবা আইনজীবীর ফি দিতে দিতে পৈত্রিক সম্পদ বিক্রি করতে হয়েছে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম মামলা টানতে গিয়ে নিজের জীবনজীবিকার ওপর আঘাত এসেছে। অর্থকষ্টে সংসার পরিচালনা করতে গিয়ে পদে পদে বিড়ম্বনায় শিকার হয়েছেন। মামলার বাদী কিংবা বিবাদীর সঙ্গে সাক্ষীকেও আদালতে নিয়ে যেতে হয়। সময় মতো মামলার শুনানি, সাক্ষ্যগ্রহণ, তদন্ত কর্মকর্তার প্রতিবেদন না আসা, নারাজি আবেদন কিংবা বাদী-বিবাদীর মধ্যে একজনের অনুপস্থিতিতে মামলার নতুন তারিখ পড়ে। মামলার নতুন তারিখ মানেই হচ্ছে নতুন করে খরচ, নতুন করে বিড়ম্বনা। আইনজীবীর বাড়তি ফি। সবচেয়ে বিড়ম্বনায় পড়তে হয় মামলার তারিখের দিনে আদালতের বারান্দায় বসে থাকতে গিয়ে। ডাক আসার সঙ্গে সঙ্গেই উপস্থিতি জানান না দিলে অনুপস্থিত দেখিয়ে নতুন তারিখ পড়ার গ্নানি সহ্য করতে হয়। বর্তমান সরকারের উন্নয়নের ছোঁয়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হওয়ায় দিনের মামলার কার্যক্রম দিনে শেষ করে বাড়ি ফেরা যায়। আদালতের আশপাশের আবাসিক হোটেল কিংবা আত্মীয়স্বজনের বাসাবাড়িতে থাকতে হয় না। তবে মামালার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্যদের নিয়েও বিড়ম্বনা কম নয়।
পোর্টালের খবরে দেখা গেল, প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর বিশেষ উদ্যোগে ২০২১ সাল পর্যন্ত অন্তর্বর্তীকালীন জামিন (ধারা ৪৯৮) সংক্রান্ত ৩ হাজার ১৯০টি বিচারাধীন মামলা নিষ্পত্তি করেছেন হাইকোর্টের ৯টি বিশেষ বেঞ্চ। ২ মার্চ দুপুর ২টা থেকে বিকাল সোয়া ৪টা পর্যন্ত ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯৮ ধারা মোতাবেক ২০২১ সাল পর্যন্ত এ ফৌজদারি বিবিধ মামলার শুনানি ও নিষ্পত্তি করেন এসব বেঞ্চ। সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের রেজিস্ট্রার মোহাম্মদ সাইফুর রহমান জানিয়েছেন, মামলা নিষ্পত্তির জন্য প্রধান বিচারপতির এ উদ্যোগ চলমান থাকবে।
এর আগে ৯টি বিশেষ বেঞ্চ গঠন করে ২৮ ফেব্রুয়ারি সুপ্রিমকোর্টের ওয়েবসাইটে এ বিষয়ে প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর আদেশ প্রকাশ করা হয়। বিচারপতি মো. রেজাউল হক ও বিচারপতি কেএম ইমরুল কয়েশের বেঞ্চে নিষ্পত্তি হয়েছে ২৪৯টি, বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেন ও বিচারপতি একেএম জহিরুল হকের বেঞ্চে ৪৯৪টি, বিচারপতি মো. হাবিবুল গণি ও বিচারপতি মো. শওকত আলী চৌধুরীর বেঞ্চে ৪৬৯টি, বিচারপতি মো. আকরাম হোসেন চৌধুরী ও বিচারপতি শাহেদ নূরউদ্দিনের বেঞ্চে ৪৯১টি, বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি মো. আমিনুল ইসলামের বেঞ্চে ২৯৭টি, বিচারপতি মো. জাহাঙ্গীর হোসেন ও বিচারপতি মো. বজলুর রহমানের বেঞ্চে ৪৮৯টি, বিচারপতি মো. বদরুজ্জামান ও বিচারপতি এস এম মাসুদ হোসাইন দোলনের বেঞ্চে ৯৯টি, বিচারপতি মো. কামরুল হোসেন মোল্লা ও বিচারপতি খোন্দকার দিলীরুজ্জামানের বেঞ্চে ৩০০টি এবং বিচারপতি এসএম কুদ্দুস জামান ও বিচারপতি ফাহমিদা কাদেরের বেঞ্চে ৩০২টি মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে।
এত অল্প সময়ে এগুলো মামালার নিষ্পতি আসলেই একটি যুগান্তকারী ঘটনা। এই ধরনের মহতী উদ্যোগ অব্যাহত থাকুক। আইন-আদালতের প্রতি মানুষের আস্থা ও শ্রদ্ধা অটুট থাকুক, সে প্রত্যাশায়ই বুক বাঁধবে দেশের মানুষ।