‘সোনার মানুষ’ হতে আখড়াবাড়িতে ভিড়
কুষ্টিয়ায় আজ শুরু হচ্ছে সাঁইজির স্মরণোৎসব
প্রকাশ : ০৪ মার্চ ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
এএইচএম আরিফ, কুষ্টিয়া
মরমী সাধক বাউল সম্রাট ফকির লালন সাঁই বাঙালির চেতনায় এক অবিস্মরণীয় কালপুরুষ। তার গানের মাঝেই লুকিয়ে আছে সৃষ্টির রহস্য। সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে আত্মিক সম্পর্ক তার গানের মূলমন্ত্র। জাতি-ধর্মণ্ডবর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষকে একই স্রোতধারায় আনার জন্য আমরণ কাজ করেছেন এই মরমী সাধক। বাউল সম্রাট ফকির লালন সাঁইয়ের সংগীত আজও আমাদের অনুপ্রাণিত করে। এই মহান সাধক বাউল সম্রাট ফকির লালন সাঁইয়ের স্মরণোৎসব (দোলপূর্ণিমা) উপলক্ষ্যে কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ার আখড়া বাড়ীতে আজ থেকে শুরু হচ্ছে ৩ দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালা। অনুষ্ঠানমালায় যথারীতি থাকছে আলোচনা সভা, লালন মেলা ও নির্ধারিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় ও লালন একাডেমির আয়োজনে টানা তিন দিনব্যাপী চলবে বাউল সম্রাট সাধক ফকির লালন সাঁইয়ের স্মরণোৎসবের অনুষ্ঠান। সাঁইজীর জীবদ্দশায় তার ভক্ত অনুরাগী শিষ্যরা দোলপূর্ণিমায় স্মরণোৎসবের অনুষ্ঠান খুব জাঁকজমকভাবে উদযাপিত করতেন। এবারো তার কোনো ব্যতিক্রম হচ্ছে না। স্মরণোৎসবের অনুষ্ঠানকে ঘিরে এরই মধ্যে লালন একাডেমি নানান উদ্যোগসহ সব প্রস্তুতি গ্রহণ করেছেন। লালন সাঁইয়ের মাজারের সাজসজ্জা ও ধোয়া-মোছার কাজ শেষ করে সাঁইজীর পছন্দের সাদা ধূসর রং দিয়ে রাঙিয়ে দেয়া হয়েছে তাঁর মাজার।
‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’ এই মানবতার দীক্ষা নিতে আত্মার টানে দেশ-বিদেশের সাধু-গুরু ও ভক্তরা দলে দলে আসতে শুরু করেছে সাঁইজির মাজারে। প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী প্রতিবার দুই অথবা তিনদিনের এ উৎসব পালিত হলেও স্মরণোৎসব থেকে এবং আগত বাউলদের অনুরোধেই তা বাড়িয়ে পাঁচদিনের প্রথা চালু করা হয়েছে। এবারো তার ভিন্নতা নেই। মূল উৎসব শুরু হওয়ার ৭-৮ দিন আগ থেকে আখড়ায় আসা বাউল সাধকরা মাজারের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নিয়ে আসন গেড়ে গেয়ে চলেছে সাঁইজির আধ্যাত্মিক মর্মবাণী ও ভেদ তথ্যের গান। জমজমাট এখন লালন শাহের আখড়াবাড়ি। কুষ্টিয়া পরিণত হয়েছে উৎসবের শহরে। সুষ্ঠুভাবে আয়োজন সম্পন্ন করতে নেয়া হয়েছে ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা। পুলিশের পাশাপাশি অনুষ্ঠানস্থলে থাকছে র্যাব ও সাদা পোশাকে গোয়েন্দা পুলিশ। স্মরণোৎসবের অনুষ্ঠানে আসা দেশ-বিদেশের লাখো ভক্ত অনুরাগী ও সাধু-গুরুদের চরণ ধূলায় সিক্ত হবে বাউল সম্রাটের ছেঁউড়িয়ার আখড়াবাড়ী। সভ্যতার এই যুগে মানুষ মানুষে হিংসা বিদ্বেষ ভুলে সময়ের কাজ সময়ে করার সাঁইজির দর্শনের চিরাচরিত তাগিদ ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’ এই সেøøাগান বাস্তবায়নে সদা সত্য ও সঠিক পথে চলে দেশ ও জাতির উন্নয়নে নিজেদের নিয়োজিত রাখতে হবে।
উদ্বোধনী দিন আজ সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে স্মরণোৎসবের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন কুষ্টিয়া-৩ সদর আসনের এমপি ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন কুষ্টিয়া-(খোকসা-কুমারখালী) আসনের এমপি ব্যারিস্টার সেলিম আলতাফ জর্জ, কুষ্টিয়া-১ (দৌলতপুর) আসনের এমপি আ ক ম সরওয়ার জাহান বাদশাহ, কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার খাইরুল আলম, কুষ্টিয়া জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আলহাজ সদর উদ্দিন খান, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আজগর আলী, কুমারখালী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল মান্নান খান, কুমারখালী পৌরসভার মেয়র সামছুজ্জামান অরুণ, কুষ্টিয়া জজ আদালতের পিপি অ্যাড. অনুপ কুমার নন্দী, নাগরিক কমিটি কুষ্টিয়ার আহ্বায়ক ডা. এসএম মুস্তানজিদ ও কুষ্টিয়া প্রেসক্লাব কেপিসি’র সভাপতি রাশেদুল ইসলাম বিপ্লব।
প্রধান আলোচক হিসেবে থাকছেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপ-উপাচার্য ড. মো. শাহিনুর রহমান। আলোচক থাকছেন লালন মাজারের খাদেম মোহাম্মদ আলী। শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখবেন কুষ্টিয়ার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) শারমিন আখতার ও কুমারখালি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিতান কুমার মণ্ডল। স্বাগত বক্তব্য রাখবেন লালন একাডেমির এডহক কমিটির সদস্য অ্যাড. শহিদুল ইসলাম। প্রতিদিন সন্ধ্যায় উন্মুক্ত মঞ্চে বিশিষ্টজনদের মুক্ত আলোচনা শেষে গভীর রাত অবধি চলবে খ্যাতনামা শিল্পীদের পরিবেশনায় লালন সঙ্গীতানুষ্ঠান।
উল্লেখ্য, ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠীর নির্মম অত্যাচারে গ্রামের সাধারণ মানুষের জীবনকে যখন বিষিয়ে তুলেছিল, ঠিক সেই সময়ই সত্যের পথ ধরে, মানুষ গুরুর দীক্ষা নিতেই সেদিন মানবতার পথ প্রদর্শক হিসাবে বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহ’র আবির্ভাব ঘটে কুমারখালীর ছেঁউড়িয়াতে। লালনের জন্মস্থান নিয়ে নানা জনের নানা মত থাকলেও আজো অজানায় রয়ে গেছে তাঁর জন্ম রহস্য। তিনি ছিলেন নিঃসন্তান। আর্থিক অসংগতির কারণে তিনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করতে পারেননি। তবে তিনি ছিলেন স্ব-শিক্ষায় শিক্ষিত। যৌবনকালে পুণ্য লাভের জন্য তীর্থ ভ্রমণে বেরিয়ে তার যৌবনের রূপান্তর ও সাধন জীবনে প্রবেশের ঘটনা ঘটে বলে জানা যায়। তীর্থকালে তিনি বসন্ত রোগে আক্রান্ত হলে তার সঙ্গীরা তাকে প্রত্যাখ্যান করে। পরে মলম শাহ’র আশ্রয়ে জীবন ফিরে পাওয়ার পর সাধক সিরাজ সাঁইয়ের সান্নিধ্যে তিনি সাধক ফকিরী লাভ করেন। প্রথমে তিনি কুমারখালীর ছেঁউড়িয়া গ্রামের গভীর বনের একটি আমগাছের নীচে সাধনায় নিযুক্ত হন। পরে স্থানীয় কারিগর সম্প্রদায়ের সাহায্য লাভ করেন। লালন ভক্ত মলম শাহ আখড়া তৈরির জন্য ষোল বিঘা জমি দান করেন। দানকৃত ওই জমিতেই ১৮২৩ সালে লালন আখড়া গড়ে ওঠে। প্রথমে সেখানে লালনের বসবাস ও সাধনার জন্য বড় খড়ের ঘর তৈরি করা হয়। সেই ঘরেই তাঁর সাধন-ভজন বসত। ছেঁউড়িয়ার আঁখড়া স্থাপনের পর থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত শিষ্যভক্তদের নিয়ে পরিবৃত থাকতেন। তিনি প্রায় এক হাজার গান রচনা করে গেছেন। ১৮৯০ সালের ১৭ অক্টোবর ভোরে এই মরমী সাধক বাউল সম্রাট দেহত্যাগ করেন এবং তাঁর সাধন-ভজনের ঘরের মধ্যেই তাকে সমাহিত করা হয়। আলোচনা শেষে দ্বিতীয় পর্বে লালন মঞ্চে বিভিন্ন শিল্পী ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সমন্বয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে পরিবেশিত হবে লালন সংগীত। এতে সংগীত পরিবেশন করবেন দেশের খ্যাতনামা শিল্পীসহ লালন একাডেমির স্থানীয় শিল্পীরা। উৎসবকে ঘিরে পুরো একাডেমি চত্বরে শুরু হয়েছে খণ্ড-খণ্ড স্থানে গানের আসর। এসব গান শুনে আগত দর্শক-শ্রোতারাও নেচে-গেয়ে গানের সঙ্গে সঙ্গে তাল মিলাচ্ছে।