১০ বছর আগে হাতিরঝিল ছিল রাজধানীবাসীর জন্য বিষফোঁড়া। তখন দিনের বেলায়ও হাতিরঝিল এলাকা দিয়ে হেঁটে যেতে সাহস হতো না। মাদকের কারবার ও ছিনতাই থেকে শুরু করে নানা অপরাধের অভয়ারণ্য ছিল হাতিরঝিল।
২০১৩ সালে হাতিরঝিল প্রকল্প উদ্বোধন হওয়ার পর অনেক কিছুর পরিবর্তন হয়েছে। প্রকল্পটি উদ্বোধনের পর হাতিরঝিল যেমন ফিরে পেয়েছে তার প্রাণ, তেমনি রাজধানীবাসী পেয়েছে দৃষ্টিনন্দন একটি পর্যটন কেন্দ্র। হাতিরঝিল এখন রাজধানীর অন্যতম পর্যটন কেন্দ্রে রূপান্তরিত হয়েছে। তবে নানা কারণে এ প্রকল্পের সুফল পুরোপুরি ভোগ করতে পারছে না রাজধানীবাসী। এখনো লেকের পানিতে দুর্গন্ধ, মশার উৎপাতসহ কিছু সমস্যা রয়ে গেছে। হাতিরঝিল উদ্বোধনের পর থেকে প্রকল্প এলাকা থেকে শতাধিক মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে ২০ থেকে ২৫ জন আত্মহত্যা করেছেন। ২০ জনের বেশি হত্যার শিকার হয়েছেন।
সম্প্রতি এখানে বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে নিরাপত্তা ত্রুটি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ‘চেষ্টা’ সত্ত্বেও হাতিরঝিল প্রকল্পের নিরাপত্তায় গলদ থেকেই যাচ্ছে। ছিনতাই, সড়ক দুর্ঘটনা, কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাত থেকে শুরু করে অপরাধজনিত নানা ঘটনা ঘটছে হাতিরঝিল এলাকায়। ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দেখা দিয়েছে একের পর এক লাশ পাওয়ার ঘটনা। লেকের পানিতে প্রায়ই পাওয়া যাচ্ছে পরিচিত বা অপিরিচিত মানুষের লাশ।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, হাতিরঝিল উদ্বোধনের পর থেকে প্রকল্প এলাকা থেকে শতাধিক মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে ২০ থেকে ২৫ জন আত্মহত্যা করেছেন। ২০ জনের বেশি হত্যার শিকার হয়েছেন। হত্যার শিকার হওয়াদের অধিকাংশের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে পানিতে ভাসমান অবস্থায়। এছাড়া ফাঁকা রাস্তা পেয়ে অতিরিক্ত গতিতে যানবাহন চলার কারণে এখানে ঘটেছে শতাধিক দুর্ঘটনা। এসব দুর্ঘটনায় হতাহত হয়েছেন অনেক মানুষ।
হাতিরঝিলে দুই সাংবাদিকের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে রয়েছে নানা আলোচনা ও রহস্য। এর মধ্যে একজন দুর্ঘটনার শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করছেন এবং অন্যজন আত্মহত্যা করেছেন বলে পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে। তবে পুলিশের দাবিকে শতভাগ সত্য বলে মেনে নেননি অনেকে।
গত ৭ ফেব্রুয়ারি হাতিরঝিলের পানিতে ভাসমান অবস্থায় অজ্ঞাতনামা এক যুবকের (৩৫) লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এখন পর্যন্ত মৃত ব্যক্তির পরিচয় শনাক্ত করা যায়নি। ওই ব্যক্তি কীভাবে মারা গেছেন তাও নিশ্চিত হতে পারেনি পুলিশ।
রাত ১০টার পর আতঙ্ক : ফেব্রুয়ারি মাসের শুরু থেকে টানা বেশ কয়েক দিন সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত হাতরিঝিল এলাকা ঘুরে দেখেন ঢাকা পোস্টের এ প্রতিবেদক। দেখা গেছে, প্রতিদিন সন্ধ্যা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত হাতিরঝিল এলাকায় সাধারণ মানুষের উপস্থিতি থাকে, সঙ্গে নিরাপত্তা ব্যবস্থাও থাকে কিছুটা। কিন্তু রাত ১০টার পর এখানে বাড়তে থাকে মাদকসেবী, ছিনতাইকারী ও কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের আনাগোনা। বিভিন্ন স্পটে কিশোররা দলবেঁধে মাদক সেবন করে। আবার এরাই সুযোগ বুঝে হয়ে যায় ছিনতাইকারী। নিরাপত্তার অভাবে এসব কিশোর যেখানে অবস্থান করে, সেখান দিয়ে পথচারী কিংবা অন্য মানুষ যেতে চান না। কারণ, সুযোগ পেলে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে এসব কিশোর মানুষের সর্বস্ব ছিনিয়ে নেয়। পুলিশ ও রাজউকের পক্ষ থেকে প্রায়ই দাবি করা হয় সিসিটিভি ক্যামেরা সচল রয়েছে। কিন্তু লাশ উদ্ধার হলেই পুলিশ বলে ‘সংশ্লিষ্ট এলাকার সিসিটিভি ফুটেজ নেই’। এ বিষয়ে পুলিশের বক্তব্য- অপরাধীরা আগে থেকে পরিকল্পনা করে সিসিটিভি ক্যামেরার আওতার বাহিরে গিয়ে অপরাধ সংঘটিত করে। এ কারণে ফুটেজ পাওয়া যায় না। রাত ১০টার পর হাতিরঝিল এলাকা খুবই অনিরাপদ হয়ে ওঠে। মাঝেমধ্যে পুলিশের গাড়ি দেখা গেলেও রাত ১০টা থেকে ভোর পর্যন্ত সময়ে গাড়ির টহলও কমে যায়। দায়িত্বে থাকা রাউজকের নিরাপত্তাকর্মীদেরও রাত ৮টার পর থেকে দেখা যায় না।
ভুক্তভোগীরা বলেন, পুলিশ ও নিরাপত্তাকর্মীরা যখন থাকেন না, তখনই হাতিরঝিলে ঘটে অপরাধমূলক কার্যক্রম। এদিকে অপরাধ সংঘটনের পেছনে জড়িতরা হাতিরঝিলের আশপাশের বিভিন্ন চোরাগলি দিয়ে এসে আবার চলে যায় বলে জানা গেছে।
হাতিরঝিলের মহানগর প্রজেক্ট অংশে ভাসমান চায়ের দোকান চালান মো. মানিক। সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত বসেন তিনি। মানিক জানান, রাত ১০টার পর হাতিরঝিলে কোনোভাবেই দোকান নিয়ে বসতে পারেন না। কারণ, তখন হাতিরঝিল থাকে মাদকসেবী ও ছিনতাইকারীদের দখলে। ভাসমান দোকানিদের মারধর করে টাকা নিয়ে যায় তারা। পুলিশের উপস্থিতি থাকে না বললেই চলে। পরে পুলিশকে জানালে তারা উল্টো মারতে আসে।
হাতিরঝিলের অধিকাংশ সিসি ক্যামেরা অচল : উদ্বোধন হওয়ার পর নিরাপত্তার স্বার্থে উচ্চপ্রযুক্তির প্রায় ৫০টি সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো হয়েছিল হাতিরঝিল প্রকল্প এলাকায়। প্রথম দিকে কয়েক বছর ভালোভাবে সার্ভিস পাওয়া গেলেও বর্তমানে অধিকাংশ সিসি ক্যামেরাই অচল। এ বিষয়ে বার বার আলোচনা উঠলেও সচল করা হচ্ছে না সিসিটিভি ক্যামেরাগুলো। এর ফলে হত্যা থেকে শুরু করে নানা অপরাধমূলক ঘটনা ঘটলেও পাওয়া যাচ্ছে না সিসিটিভি ফুটেজ।
অপরাধ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান জানা গেছে, হাতিরঝিলের সিসিটিভির ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে রয়েছে রাজউক। তাদের নিজস্ব নিরাপত্তাকর্মীও রয়েছে প্রকল্প এলাকায়। কিন্তু সিসিটিভি ক্যামেরার অচলাবস্থা দীর্ঘদিন ধরে চলে এলেও রাজউকের নজর নেই।
হাতিরঝিলে অপরাধ প্রবণতা বেশি কেন? এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলেন, দেশের মানুষের জীবনমান যেমন পরিবর্তন হয়েছে, তেমনি অপরাধের ধরনও পরিবর্তন হয়েছে। সৃষ্টি হয়েছে কিশোর গ্যাংসহ নানা অপরাধী গোষ্ঠী। কোলাহলশূন্য হওয়ায় অপরাধীরা নিরাপদ স্থান হিসেবে হাতিরঝিলকে বেছে নিয়েছে।
পুলিশ সচেষ্ট রয়েছে, তবে লোকবল কম : আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হাতিরঝিল প্রকল্প এলাকায় নিরাপত্তা দিতে পুলিশ ২৪ ঘণ্টা কাজ করে। তবে এলাকা অনুযায়ী পর্যাপ্ত লোকবল না থাকায় নিরাপত্তায় ফাঁক তৈরি হচ্ছে। এই ফাঁক কাজে লাগিয়ে অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। এছাড়া নিরাপত্তার দায়িত্বে যে পরিমাণ পুলিশ সদস্য রয়েছেন তা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। এ বিষয়ে হাতিরঝিল থানা বলেছে, হাতিরঝিল প্রকল্প ও এর আশপাশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তাদের কয়েকশ’ লোকবলের প্রয়োজন। কিন্তু থানায় আছে মাত্র ১০০ লোকবল।