‘জরুরি স্বাস্থ্যসেবা ও জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিকদের ক্যাম্পে এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীতে কলেরা নজরদারি’ শীর্ষক প্রকল্পের কার্যক্রম ও ফলাফল তুলে ধরতে গতকাল আইসিডিডিআর,বি এবং ইউনিসেফ যৌথভাবে এক সেমিনারের আয়োজন করে। কক্সবাজারের একটি হোটেলে অনুষ্ঠিত এই সেমিনারে সরকারি কর্মকর্তা, উন্নয়ন সহযোগী এবং এনজিওসহ প্রকল্পের সহযোগীরা অংশগ্রহণ করেন।
অনুষ্ঠানে প্রকল্পের কো-প্রিন্সিপাল ইনভেস্টিগেটর এবং আইসিডিডিআর,বি হাসপাতাল প্রধান ডা. বাহারুল আলম প্রকল্পের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেন। তিনি ২০১৭ সালে নিপীড়িত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়ার পর দ্রুত আইসিডিডিআর,বি ও ইউনিসেফের যৌথ পরিচালনায় একটি মাঠ পর্যায়ের মূল্যায়ন সম্পর্কে অবহিত করেন। প্রকল্পটির আওতায় রোগের নজরদারি, চিকিৎসা, সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং টিকাদানের মাধ্যমে ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব প্রতিরোধ করার লক্ষ্যে আইসিডিডিআর,বি, ইউনিসেফ এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহযোগিতায় ২০১৮ সাল থেকে ২ হাজার স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীকে প্রশিক্ষণ দেয়।
টেকনাফে পাঁচটি ডায়রিয়া চিকিৎসা কেন্দ্র (ডিটিসি) প্রতিষ্ঠা করা হয়, যা সেপ্টেম্বর ২০১৯-এর ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব ব্যবস্থাপনায় সাহায্য করে। লেদা ডায়রিয়া চিকিৎসা কেন্দ্রের কার্যক্রম এখনো চলমান রয়েছে এবং এখানে প্রতিবছর প্রায় ৩ হাজার ৫০০ রোগীর চিকিৎসা করা হয়।
এছাড়া, কেন্দ্রটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নেতৃত্বে চলমান যৌথ মূল্যায়ন দলও অংশ নিচ্ছে। আইসিডিডিআর,বি’র নিউট্রিশন অ্যান্ড ক্লিনিক্যাল সায়েন্স বিভাগের ইমেরিটাস সায়েন্টিস্ট ড. এএসজি ফারুক ডায়রিয়া চিকিৎসা কেন্দ্রভিত্তিক নজরদারির ফলাফল উপস্থাপন করেন। তিনি জানান, রোহিঙ্গা শিশুদের মধ্যে কম উচ্চতা) ও কৃশকায় এবং ওজন স্বল্পতার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য উন্নতি দেখা গিয়েছে। সেই সঙ্গে এই জনগোষ্ঠীর মধ্যে ক্লোরিনযুক্ত ট্যাপের পানির ব্যবহার, টয়লেট ব্যবহার, খাবার স্যালাইন এবং টিকা গ্রহণের হারও উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
আইসিডিডিআর,বি’র ইনফেকশাস ডিজিজেস ডিভিশনের ভারপ্রাপ্ত সিনিয়র ডিরেক্টর, ড. ফেরদৌসী কাদরী কক্সবাজারে মুখে খাওয়ার কলেরা টিকাদান কার্যক্রমের সাফল্য উপস্থাপন করতে গিয়ে বলেন, সাত দফা টিকাদান কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হয়েছে, কোনো কোনো ক্যাম্পে মানুষকে শতভাগ টিকাদান করা হয়েছে। প্রায় ৯ লাখ রোহিঙ্গা জনগণ ৩৭ লাখ ৬৫ হাজার ৪৯৯ ডোজ টিকা পেয়েছে। রোহিঙ্গাদের কাছাকাছি বসবাসকারী ৫ লাখ ২৮ হাজার ২৯৭ স্থানীয় জনগণ ৮ লাখ ৯৫ হাজার ৬৮৮ ডোজ মুখে খাওয়ার কলেরা টিকা পেয়েছে।
তিনি বলেন, এই এলাকায় রোহিঙ্গা ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীতে কলেরা প্রাদুর্ভাব ও মহামারি প্রতিরোধে মুখে খাওয়ার কলেরা টিকাদান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে- যা বড় রকমের কোনো প্রাদুর্ভাবের অনুপস্থিতি থেকে প্রমাণিত হয়। এটি সম্ভব হয়েছে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয়, সিডিসি-ডিজিএইচএস, আইইডিসিআর, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফসহ অন্য অংশীদারদের নেতৃত্ব এবং সমর্থনের মাধ্যমে।
প্রেজেন্টেশনের পর ইউনিসেফের হেলথ স্পেশালিস্ট ডা. মাইনুল হাসান এবং ডা. হোর্হে মার্টিনেজ, ডব্লিউএইচও-কক্সবাজারের বক্তব্যের পাশাপাশি কক্সবাজারের সিভিল সার্জন ডা. মো. মাহবুবুর রহমান এবং বাংলাদেশ সরকারের শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার ড. মো. মিজানুর রহমান বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন আইসিডিডিআর,বি’র নির্বাহী পরিচালক ড. তাহমিদ আহমেদ। ডা. হাসান আইসিডিডিআর,বি’র প্রশংসা করে বলেন, রোহিঙ্গা পরিবেশে তীব্র পানির মতো ডায়রিয়ার রোগ নিয়ন্ত্রণের এই সফল কার্যক্রমের অংশীদার হতে পেরে ইউনিসেফ গর্বিত।
ডা. মার্টিনেজ তার বক্তব্যে রোগের নজরদারি, টিকাদান এবং অন্যান্য ব্যবস্থার গুরুত্ব তুলে ধরে দ্রুত রোগ নির্ণয়ের জন্য কক্সবাজারের সক্ষমতা কিভাবে আরো বৃদ্ধি করা যায়, তা খুঁজে দেখার জন্য আইসিডিডিআর,বি-কে অনুরোধ করেন।
ড. তাহমিদ আহমেদ সরকার এবং উন্নয়ন অংশীদারদের সহযোগিতামূলক প্রচেষ্টার প্রশংসা করে বলেন, সহযোগিতামূলক প্রচেষ্টা শুধুমাত্র ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব প্রতিরোধে এবং জীবন বাঁচাতে সাহায্য করেনি; আমাদের এমন কিছু প্রমাণ এনে দিয়েছে যা পৃথিবীর অন্য যেকোনো জায়গায় মানবিক সংকট মোকাবিলায় কাজে দেবে।