বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও গতকাল বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবস পালিত হয়েছে। বিগত বছরগুলোর মতোই এবারও দিবসপি উপলক্ষ্যে দেশব্যাপী র্যালি ও আলোচনাসভার আয়োজন করা হয়। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ছিল ‘নিরাপদ জ্বালানি, ভোক্তাবান্ধব পৃথিবী’।
বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবস উপলক্ষ্যে গতকাল বুধবার সকালে কবুতর ও বেলুন উড়িয়ে দিবসের উদ্বোধন করা হয়। এরপর রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি।
ভোক্তার অধিকার সম্পর্কে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, ভোক্তার অধিকার মানুষের অধিকার। আমরা যখন ভোক্তাদের সব অধিকার সম্পর্কে জানাতে পারব তখন আমাদের অর্ধেক কাজ শেষ হয়ে যাবে। ভোক্তারা নিজেরাই সচেতন হতে পারবেন। তবে আগের চেয়ে ভোক্তা অধিকার সম্পর্কে মানুষের সচেতনতা বেড়েছে। আগে ভোক্তারা পণ্য কিনে প্রতারিত হলে- কোথায় অভিযোগ বা প্রতিকার পাওয়া যাবে সেটি জানতেন না। কিন্তু মানুষের মধ্যে এখন সচেতনতা বেড়েছে। তারা অভিযোগ করলেই প্রতিকার পাচ্ছেন। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর বাজার নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে যা নিয়ে টিপু মুনশি বলেন, আমাদের ভোক্তা অধিকার বিভিন্ন বাজারে যাচ্ছে, বাজার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। বাজার নিয়ন্ত্রণে প্রতিনিয়ত ক্যাবও কাজ করছে।
আসন্ন রমজান মাসে নিত্যপণ্যের দাম যেন সহনীয় থাকে সেজন্য ব্যবসায়ীদের সংযমী হওয়ার অনুরোধ জানিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, ভোক্তাদের সচেতন করতে গণমাধ্যমের ভূমিকা গুরুত্ব রয়েছে।
ভোক্তাদের চটকদার বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট না হওয়ার আহ্বান জানিয়ে টিপু মুনশি বলেন, পণ্য তৈরিতে একটা খরচ আছে। কেউ যদি একটা মোটরসাইকেল অর্ধেক দামে দেয় তাহলে আপনাদের বুঝতে হবে কীভাবে দেবে। এই অর্ধেক দামের কথা বলে কিন্তু আলটিমেটলি মানুষকে ঠকানো হয়। প্রতারিত করা হয়। কাজেই আপনারা সবকিছু ভেবে কাজ করবেন। একজন বিজ্ঞাপন দিলেই আকৃষ্ট হবেন না।
বৈশ্বিক মহামারি ও ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে সারা বিশ্বেই সবকিছুর দাম বেশি দাবি করে মন্ত্রী বলেন, দেশের বাজারে সবকিছুর দাম একটু বেশি। জানি আপনাদের কষ্ট হচ্ছে। আপনারা একটু সাশ্রয়ী হোন। রমজান সামনে রেখে একবারে পণ্য কিনবেন না। কারণ, একবারে পণ্য কিনলে বাজারে তার প্রভাব পড়ে। তখন দামও বেড়ে যায়। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান ভোক্তা অধিকার রক্ষায় জাতিসংঘের অনুমোদিত অধিকারগুলো বাস্তবায়নের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, বাজারে সুষ্ঠু প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ভোক্তারা যেন ন্যায্য অধিকার আদায় পান, সেই বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে। এছাড়া সরকারের আইন মেনে ব্যবসায়ীদের চলতে হবে। সরকারের আইনগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে। দেশের সবাইকে টিসিবির পণ্য দেওয়া সম্ভব নয়, তবে সব মানুষকে সহায়তার ব্যবস্থা করতে হবে।
ভোক্তাদের উদ্দেশে গোলাম রহমান বলেন, বাজারে বাড়তি চাহিদার চাপ সৃষ্টি করবেন না। এতে অসাধু ব্যবসায়ীরা সুযোগ পাবে। সুযোগ পেলেই তারা অধিক মুনাফা করবে।
রোজাসহ বিশেষ উপলক্ষ্যে অনেক দেশে পণ্যের দামে ছাড় দেওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করে ক্যাব সভাপতি ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে বলেন, অনেক দেশে বিশেষ দিনগুলোতে পণ্যের দামে ছাড় দেয়া হয়, আমাদের দেশে এ ধরনের কোনো সুবিধা দেয়া যায় কি না, ভেবে দেখা দরকার। পাশাপাশি অধিক লাভ না করে সীমিত লাভে বেশি বিক্রির জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) এএইচএম সফিকুজ্জামান স্বাগত বক্তব্যে অধিদপ্তরের নিয়মিত কার্যক্রম বাজার তদারকি, অভিযোগ নিষ্পত্তি ও সচেতনতামূলক কার্যক্রমের পাশাপাশি অধিদপ্তরের হটলাইন ১৬১২১, অধিদপ্তরের অফিসিয়াল ফেইসবুক পেজ ও ইউটিউব চ্যানেল এবং সিসিএমএস সফটওয়্যারের মাধ্যমে অভিযোগ নিষ্পত্তির বিষয়ে সম্যক ধারনণ প্রদান করেন। ব্যবসায়ীদের আইন মেনে যৌক্তিক মূল্যে ব্যবসা পরিচালনা করার কথাও বলেন। তিনি আরো বলেন, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯ ভোক্তাবান্ধবের পাশাপাশি ব্যবসায়ীবান্ধবও বটে।
ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই) সিনিয়র সহ-সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বলেন, করোনার পর ইউক্রেন যুদ্ধে বিদ্যুৎ জ্বালানির ওপর প্রভাব পড়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়ে যাওয়ায় দেশের বাজারেও দাম বেড়েছে। ফলে বিভিন্ন পণ্যের দামের ওপর প্রভাব পড়েছে।
এ সময় দেশে বন্ধ সরকারি চিনির কলগুলো বেসরকারি উদ্যোগে চেড়ে দেয়া বা বিদেশিদের সহায়তায় চালুর উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানান মোস্তফা আজাদ।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন। সভাপতিত্ব করেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ। জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের সদস্যরা, অধিদপ্তরের পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ারসহ অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়, ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয় ও ঢাকা জেলা কার্যালয়ের সব উপ-পরিচালক ও সহকারী পরিচালক, বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের কর্মকর্তা, অংশীজনসহ বিভিন্ন বিশিষ্ট ব্যক্তিরা, বাংলাদেশ স্কাউটস গার্লস গাইডের সদস্য, ব্যবসায়ী প্রতিনিধি, ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন বাজার কমিটির প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর কর্তৃক প্রস্তৃতকৃত কনজুমার কমপ্লেইন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (সিসিএমএস) সফটওয়্যারের পাইলটিং পর্যায়ে কীভাবে কাজ করবে, সেই বিষয়ে একটি তথ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়। তথ্যচিত্র প্রদর্শনের পর ‘সিসিএমএস শীর্ষক সফটওয়্যারটি পাইলটিং পর্যায়ে শুভ উদ্বোধন এবং ‘ভোক্তা বাতায়ন-২০২৩’ শীর্ষক স্মরণিকার মোড়ক উন্মোচন করেন বাণিজ্যমন্ত্রী।
উল্লেখ্য, বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবস উপলক্ষ্যে অনুষ্ঠানে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এবং গণমাধ্যমসহ চারটি পর্যায়ে রচনা প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। প্রাপ্ত ৩৫০টি রচনার মূল্যায়নের মাধ্যমে ১৪ জনকে বিজয়ী করা হয় এবং বিজয়ীদের পুরস্কৃত করা হয়।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া, টাঙ্গাইলের কালিহাতী, নাটোরের বাগাতিপাড়া ও ফরিদপুরসহ সারা দেশে র্যালি ও আলোচনা সভার মধ্যদিয়ে বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবস পালন করা হয়।