সুসংবাদ প্রতিদিন

সূর্যমুখীতে হাসেমের মুখে হাসি নকলায় চাষের অপার সম্ভাবনা

প্রকাশ : ২০ মার্চ ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  মো. মোশারফ হোসাইন, নকলা (শেরপুর) প্রতিনিধি

শেরপুরের নকলা উপজেলায় পতিত ও অপেক্ষাকৃত অনুর্বর জমিতে তেলবীজ ফসল সূর্যমুখী চাষের অপার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। সূর্যমুখীতে শতাংশে আয় হচ্ছে ২ হাজার থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকা করে। সূর্যমুখীর ফলন দেখে ও বাজারে ভালো দাম থাকায় উপজেলার গৌড়দ্বার ইউনিয়নের গৌড়দ্বার গ্রামের কৃষক মো. হাসেম মিয়ার মুখে হাসি ফুটে উঠেছে। নকলায় সূর্যমুখী চাষের অপার সম্ভাবনার কথা বলছে কৃষি বিভাগ।

নাম মাত্র শ্রমে ও সল্প ব্যয়ে বাড়তি আয়সহ সূর্যমুখীর দৃষ্টিনন্দন দৃশ্য নজর কেড়েছে সবার। সূর্যমুখীর প্রতিটি ক্ষেতে প্রতিদিনই দর্শনার্থীদের উপচেপড়া ভিড় লক্ষ্যণীয়। এবার উপজেলার গনপদ্দী ইউনিয়নে ৫০ শতাংশ জমিতে ও গৌড়দ্বার ইউনিয়নে আরো ৫০ শতাংশ জমিতে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তেলজাতীয় ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি প্রকল্পের আওতায় তেলজাতীয় ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য প্যাটার্নভিত্তিক একক প্রদর্শনীর মাধ্যমে সূর্যমুখী-আউশ-রোপা আমন প্যাটার্নের আওতায় দুই কৃষককে প্রদর্শনী দেয়া হয়েছে। চলতি মৌসুমে তেলজাতীয় ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি প্রকল্পের আওতায় উপজেলায় ১০০ শতাংশ জমিতে হাইসান-৩৩ জাতের সূর্যমুখী চাষ করা হয়েছে। ৩ মাস মেয়াদি এ তেল ফসলে লাভ বেশি ও চাষের অপার সম্ভাবনা থাকলেও, কৃষি বিভাগ থেকে অধিক প্রণোদনা না দেয়ায় ও কৃষকরা স্থানীয়ভাবে ব্যাপকহারে বাজারজাত করার সুযোগ না পাওয়ায় এই ফসলের আবাদ বৃদ্ধির সম্ভাবনা খুবই কম বলে মনে করছেন অনেকে। তবে এটি স্থানীয়ভাবে বাজারজাত করা সহজ না হলেও দামি ফসল হিসেবে সবার কাছে পরিচিত। সরেজমিন উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, গনপদ্দী ও গৌড়দ্বার ইউনিয়নে মাঠে প্রদর্শীত ক্ষেত হরুদ ফুলে ছেয়ে গেছে। কিছু ফুলে বীজ আসা শুরু হয়েছে। তাছাড়া বানেশ্বরদী, চন্দ্রকোনা, পাঠাকাটা, টালকী ও চরঅষ্টধর ইউনিয়নের অনেকে নিজ উদ্যোগে বাড়ির আঙিনায় এবং অনেকে ফুল বাগানেও শখের বসে সূর্যমুখী ফুল গাছ রোপণ করেছেন। নকলা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসহ কয়েকটি অফিসের সামনে সৌন্দর্য বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে সূর্যমুখী ফুলের গাছ রোপণ করা হয়েছে।

ভোজ্যতেলের মধ্যে সূর্যমুখীর তেল মানব শরীরের জন্য খুব উপকারী। সূর্যমুখীর আবাদ কৃষকের কাছে জনপ্রিয় করে তুলতে উপজেলা কৃষি অফিস কর্তৃক পরীক্ষামূলকভাবে কয়েক বছর ধরেই এর আবাদ করা হচ্ছে। এসব জমিতে সূর্যমুখীর বাম্পার ফলনও হয়েছে। ফলন দেখে অন্যান্য কৃষকরা তাদের পতিত জমিতে এই তেলবীজ ফসল চাষের দিকে ঝুঁকছেন। এসব সূর্যমুখীর ক্ষেতের ফুলের সৌন্দর্য দেখতে এসে অনেক দর্শনার্থী এই ফসল চাষ করার নিয়মণ্ডকানুন জেনে নিচ্ছেন বলে গৌড়দ্বার গ্রামের সূর্যমুখী চাষি হাসেম মিয়া জানান।

এ উপজেলার মাটি ও আবহাওয়া সূর্যমুখী চাষাবাদের জন্য বেশ উপযোগী। কম সময় ও অর্থ ব্যয় করে সূর্যমুখী চাষ করে লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই কৃষি বিভাগ সাধারণ কৃষকদের সূর্যমুখী চাষে উদ্বুদ্ধ করতে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় সূর্যমুখী আবাদ পরীক্ষামূলকভাবে শুরু হয়েছে গত কয়েক বছর থেকেই। দ্রুত সময়ের মধ্যে সূর্যমুখী ফুলের চাষ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে দেয়া সম্ভব হবে বলে আশা ব্যক্ত করেন কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা। উপজেলার গৌড়দ্বার ইউনিয়নের গৌড়দ্বার গ্রামের সূর্যমুখী চাষি মো. হাসেম মিয়া বলেন- কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তেলজাতীয় ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি প্রকল্পের আওতায় তেলজাতীয় ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য প্যাটার্নভিত্তিক একক প্রদর্শনীর মাধ্যমে সূর্যমুখী-আউশ-রোপা আমন প্যাটার্নের আওতায় ৫০ শতাংশ জমিতে হাইসান-৩৩ জাতের সূর্যমুখী চাষ করেছি। এতে আমার নিজস্ব খরচ হয়েছে সব মিলিয়ে ৮-১০ হাজার টাকা। তবে কৃষি অফিস থেকে প্রণোদনা হিসেবে বীজ ও সার এবং মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ৩ হাজার টাকা কৃষি প্রণোদনা হিসেবে দেয়া হয়েছে। বাম্পার ফলনের সম্ভাবনা দেখে হাসেম মিয়ার মুখে রঙিন হাসি ফুটে উঠেছে। তিনি আশা করছেন সূর্যমুখী-আউশ-রোপা আমন প্যাটার্নভুক্ত এই ৫০ শতাংশ জমির সূর্যমুখী থেকেই অর্ধলক্ষাধিক টাকা আয় হবে। তবে স্থানীয়ভাবে চাহিদা ও বাজারজাতের ব্যবস্থা করতে পারলে তার ৫০ শতাংশ জমির সূর্যমুখী থেকে লাখ টাকা আয় করা সম্ভব বলে তিনি মনে করছেন। তিনি জানান, ৫০ শতাংশ জমি প্রতি বছরের জন্য ৮ হাজার টাকায় বন্ধক নিয়েছেন। তার এই জমিতে আগে আমন ধান চাষ করা হয়েছিল। এখন সূর্যমুখী চাষ করা হয়েছে। এরপরে রোপা আমন বা পাট চাষ করা হবে। মধ্যবর্তী ও অপ্রধান এ তেলবীজ ফসল চাষে অনেকে আগ্রহী হলেও, বাজারজাত নিয়ে চিন্তা থাকায় অনেক কৃষকদের মধ্যে পিছুটান রয়েছে বলেও তিনি জানান।

কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা কৃষিবিদ শেখ ফজলুল হক মনি জানান, নভেম্বরের প্রথমার্ধে সারিবদ্ধভাবে সূর্যমুখীর বীজ বপন করা হয়। বীজ বপনের ৯০ দিন থেকে ১০০ দিনের মধ্যে ফসল তোলা যায়। সামান্য সার ও ২-৩ বার সেচ ছাড়া আর তেমন কোন যত্ন নিতে হয় না। সূর্যমুখী গাছ জ্বালানি হিসেবেও ব্যবহার করা যায়। এ তেলবীজ আবাদে ব্যয়ের তুলনায় কয়েকগুণ লাভ পান কৃষকরা।

চিকিৎসা বিজ্ঞানের মতে, সূর্যমুখীর তেল অন্যান্য সাধারণ তেলের চেয়ে বেশ আলাদা। কোলেস্টেরলমুক্ত সূর্যমুখীর তেলে প্রচুর পরিমাণ প্রাণশক্তি থাকায় এটি আমাদের শরীরের দুর্বলতা কমায় ও কার্যক্ষমতা বাড়ায়। রান্নার জন্য সয়াবিন তেলের চেয়ে সূর্যমুখীর তেল প্রায় ১০ গুণ বেশি পুষ্টিসমৃদ্ধ। শরীর সুস্থ রাখতে ও হাড় মজবুত করতে সূর্যমুখীর তেল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে বলে পুষ্টিবিদরা মনে করেন।

সূর্যমুখী তেলে থাকা ম্যাগনেসিয়াম আমাদের মানসিক চাপ দূর করে। এই তেল মানবদেহের অনেকটাই মহৌষধ হিসেবে ভূমিকা পালন করে বলে জানান নকলা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মোহাম্মদ গোলাম মোস্তফা। তিনি আরো জানান, সূর্যমুখীর বীজ থেকে উৎপাদিত তেলে লিনোলিক এসিড থাকে, যা মানব হার্ট ভালো রাখতে ভূমিকা পালন করে। এই তেলের উৎপাদন বাড়লে একদিকে মানুষ স্বাস্থ্যসম্মত তেল পাবেন, অন্যদিকে লাভবান হবেন চাষিরা। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ আব্দুল ওয়াদুদ জানান, অন্য ফসলের চেয়ে সূর্যমুখী চাষে খরচ কম; কিন্তু লাভ বেশি পাওয়া যায়। এতে ২-৩ বার সেচ ছাড়া তেমন কোনো সার ও কীটনাশক লাগে না বললেই চলে। এ তেলবীজ চাষে তেমন বাড়তি পরিচর্যারও দরকার হয় না। তাছাড়া অন্যান্য তেলবীজের তুলনায় অনেক বেশি তেল পাওয়া যায়। ভোজ্য তেলের চাহিদা পূরণে প্রতি বছর বিদেশ থেকে সূর্যমুখীর বীজ ও এর তেল আমদানি করতে হয়। দেশে এ তেলবীজ ফসলের আবাদ বৃদ্ধি করা গেলে তেলের আমদানি কমবে; ফলে বাড়বে কৃষি আয়। পতিত ও অপেক্ষাকৃত অনুর্বর জমিতে সূর্যমুখী চাষ করে স্বাবলম্বী হওয়া সহজ। তাই কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করাসহ নিয়মিত পরামর্শ প্রদান করা হচ্ছে বলে জানান কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ আব্দুল ওয়াদুদ।