ঢাকা ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বাড়ছে অস্থিরতা : মার্চে ৯ খুন

কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়া ফিরে গেল মিয়ানমারের প্রতিনিধি দল

কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়া ফিরে গেল মিয়ানমারের প্রতিনিধি দল

ক্যাম্পভিত্তিক মাদক চোরাচালান, মানবপাচার, হাটবাজারের চাঁদাবাজি, অপহরণ-মুক্তিপণ আদায়, হামলা, খুন ও আগুন সন্ত্রাস মিলে অস্থির হয়ে উঠেছে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি রোহিঙ্গা ক্যাম্প। এই অস্থিরতায় চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ২১ মার্চ পর্যন্ত ক্যাম্পে খুনের ঘটনা ঘটেছে ১৮টি, যার মধ্যে মার্চে ২১ দিনে খুন হয়েছে ৯ জন।

এর মধ্যে সর্বশেষ ২১ মার্চ দুপুরে উখিয়ার তাজনিমারখোলা এলাকার ১৩ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সশস্ত্র দুষ্কৃতিকারীদের গুলিতে দুই রোহিঙ্গা নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছে আরো একজন। নিহতরা হলেন ১৩ নম্বর ক্যাম্পের জি ব্লকের বেসা আলির ছেলে মো. রফিক (৩২), একই ক্যাম্পের মাহমুদ হাসানের ছেলে মো. রফিক (৩০)। আহত হয়েছেন একই ক্যাম্পের মোহাম্মদ হোসেনের ছেলে মো. ইয়াছিন (২৮)।

উখিয়া থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ মোহাম্মদ আলী জানিয়েছেন, দুপুরে পাঁচ থেকে ছয়জন অজ্ঞাত সশস্ত্র দুষ্কৃতকারী ১৩ নম্বর ক্যাম্পে হামলা চালায়। এ সময় রফিক নামের দুইজন এবং ইয়াছিনকে লক্ষ্য করে গুলি করে। এ সময় মো. রফিক (৩২) এর বুকের বাম পাশে গুলি লাগে। তাকে পাশের এনজিও হাসপাতালে আনা হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করে। অপর রফিক (৩০) এর ডান চোখের ওপর গুলি লেগে মাথার পেছন দিয়ে বের হয়ে যায় এবং বাম হাতের কব্জির ওপরে গুলি লাগে। তিনি ঘটনাস্থলে মারা যান। এছাড়া ইয়াছিন গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন। তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য কক্সবাজার সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। কক্সবাজার জেলা পুলিশের তথ্য বলেছে, চলতি মার্চের ২১ দিনে খুন হয়েছে ৯ জন। এর আগে ১৮ মার্চ, ১৭ মার্চ, ১৬ মার্চ, ১৫ মার্চ, ৮ মার্চ, ৭ মার্চ, ৩ মার্চ একজন করে সাতটি খুনের ঘটনা ঘটে। আর এসব ঘটনায় নিহতদের বেশিভাগ রোহিঙ্গা ক্যাম্পের কমিউনিটি নেতা ও স্বেচ্ছাসেবক। পুলিশের দেয়া তথ্য মতে, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ১২৯টি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। এর সাথে জানুয়ারি থেকে ২১ মার্চ পর্যন্ত ১৮টি হত্যাকাণ্ড হলো।

ক্যাম্পের নিরাপত্তায় নিয়োজিত এপিবিএন, জেলা পুলিশ প্রতিটি ঘটনার জন্য ‘আধিপত্য বিস্তারের জেরে’ সশস্ত্র গোষ্ঠীকে দায়ি করে আসছে।

সম্প্রতি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির এক প্রতিবেদনে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অস্থিরতার জন্য আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মিসহ (আরসা) তিনটি সন্ত্রাসী গ্রুপ ও সাতটি ডাকাত দল রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকায় সক্রিয় রয়েছে বলা হয়েছে। এসব সশস্ত্রগোষ্ঠী আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে হত্যাসহ নানা অপরাধ হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

উখিয়াস্থ ১৪ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) অধিনায়ক অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক (এডিআইজি) ছৈয়দ হারুন অর রশিদ বলেন, ‘রোহিঙ্গা শিবিরে কয়েকটি দুষ্কৃতিকারী দল সক্রিয় রয়েছে। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে একের পর এক হত্যাকাণ্ড হচ্ছে। সাধারণ রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের সশস্ত্রগোষ্ঠী আরসা’র সন্ত্রাসীরা এ ঘটনার নেপথ্যে রয়েছে বলে দাবি করে আসছে। বিষয়টি নিয়ে এপিবিএন তৎপর রয়েছে। ঘটনায় জড়িতদের চিহ্নিত করে গ্রেপ্তারে অভিযান চালানো হচ্ছে।

এদিকে রোহিঙ্গা নেতাদের দাবি, এসব ঘটনার পেছনে কথিত সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো জড়িত। আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জোবায়ের বলেন, দুটি কারণে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কমিউনিটি নেতাদের খুন করছে কথিত সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো। এক হচ্ছে, কথিত সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর ব্যাপারে কেউ তথ্য দিলে তা তারা জেনে যায়। তারপর নির্দিষ্ট সময়ে গিয়ে তথ্য দাতাকে ধরে গুলি ও কুপিয়ে হত্যা করছে। কারণ, ক্যাম্পে তাদের অসংখ্য নেটওয়ার্ক রয়েছে। আর দ্বিতীয় হচ্ছে, আগে অনেক কমিউনিটি নেতা কথিত সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোকে সহযোগিতা করত। কিন্তু এখন না করাতে ‘মুনাফিক’ হয়ে গেছে বলে টার্গেট করে হত্যা করছে।

শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. মিজানুর রহমান বলেন, ক্যাম্পে আইনশৃঙ্খলার অবণতি হলে তো আমরা অবশ্যই চিন্তিত। তবে, ক্যাম্পে তিনটি আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) রয়েছে। পুলিশের ডিআইজি ও অতিরিক্ত ডিআইজি প্রতিনিয়ত কাজ করছেন। আমরা তাদের সঙ্গে সমন্বয় করছি। এছাড়া বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কাজ করছে। তারপরও কিছু ঘটনা ঘটছে। তবে, এসব ঘটনা নিয়ে আমরা কিছুটা চিন্তিত। আমরা সবাই চেষ্টা করছি, কীভাবে ক্যাম্পে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা যায়।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দায়িত্বে থাকা ৮-আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক (অতিরিক্ত ডিআইজি) মো. আমির জাফর বলেন, ক্যাম্পে বেশ কিছু গ্রুপ কাজ করে, যাদের কাজ হচ্ছে মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, অপহরণসহ নানা অপরাধ নিয়ন্ত্রণ। আর এসব নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে আধিপত্য বিস্তার একটা বিষয় থাকে। এরা নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করতে এসব অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হচ্ছে।

মো. আমির জাফর আরো বলেন, আমরা প্রতিনিয়ত অভিযান পরিচালনা করছি। কখনো এপিবিএন পুলিশ একা করছে, কখনো জেলা পুলিশ বা র‌্যাবকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করছে। তবে সবার সমন্বিত প্রচেষ্টায় আশা করি, ক্যাম্পের এই অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। এদিকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে কোনো প্রকার সিদ্ধান্ত ছাড়াই ফিরে গেলেন মিয়ানমারের প্রতিনিধি দল। গতকাল সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ১৭ সদস্যের প্রতিনিধি দলটি কক্সবাজারের টেকনাফের জালিয়াপাড়া জেটি ঘাট হয়ে মিয়ানমারে ফিরে যান।

তবে বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমের সাথে কোনো কথা বলতে রাজি নন কক্সবাজারের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার কার্যালয়ের সংশ্লিষ্টরা। তবে একটি সূত্র বলেছেন কক্সবাজারের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. মিজানুর রহমান বর্তমানে ঢাকায় অবস্থান করছেন। ওখানে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়ে একটি সভা হওয়ার কথা রয়েছে। মিয়ানমারের প্রতিনিধি দলটি সাত দিন টেকনাফ অবস্থান করে ফিরে গেলেও প্রত্যাবাসন নিয়ে কার্যত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। মন্ত্রণালয়ের সভায় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হবে।

এর আগে গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় কক্সবাজারের অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. সামছু-দ্দৌজা জানিয়েছিলেন, মিয়ানমারের প্রতিনিধি দলটি সাত দিনে ৪৫০ রোহিঙ্গার তথ্য যাচাই করেছেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, গেল সাত দিনে ১৪৯ পরিবারের ৪৪৯ জন রোহিঙ্গার তথ্য যাচাই-বাছাই করেছে মিয়ানমার প্রতিনিধি দল। এর মধ্যে গত ১৫ মার্চ ৪ পরিবারের ২৭ জন, ১৬ মার্চ ২৩ পরিবারের ৭৮ জন, ১৭ মার্চ ২৮ পরিবারের ৭৪ জন, ১৮ মার্চ ২৬ পরিবারের ৬৯ জন, ১৯ মার্চ ২৬ পরিবারের ৭৫ জন, ২০ মার্চ ২৬ পরিবারের ৮৬ জন ও ২১ মার্চ ১৬ পরিবারের ৪০ জন রোহিঙ্গার সাথে আলাপ করে প্রতিনিধি দলটি। টেকনাফ স্থলবন্দরের মালঞ্চ সম্মেলন কক্ষে চলে রোহিঙ্গাদের তথ্য যাচাই ও সাক্ষাৎকার গ্রহণের কাজটি।

প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশ থেকে পাঠানো তালিকাভুক্ত রোহিঙ্গাদের তথ্য যাচাই করতে ১৫ মার্চ কক্সবাজারের টেকনাফ হয়ে বাংলাদেশে আসে মিয়ানমারের ২২ সদস্যদের প্রতিনিধি দল। দেশটির মিনিস্ট্রি অব ফরেন অ্যাফেয়ার্সের মংডুর আঞ্চলিক পরিচালক অং মাইউ’র নেতৃত্বে আসা সদস্যদের পাঁচজন প্রাথমিক আলোচনা শেষে মিয়ানমার ফেরত গেলেও টেকনাফে ছিলেন ১৭ সদস্য। তারা গতকাল মিয়ানমারে ফিরে গেলেন।

উল্লেখ্য, ২০১৭ সালে মিয়ানমারের নির্যাতনের মুখে পালিয়ে আসা প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা উখিয়া টেকনাফের ৩৩টি ক্যাম্প ও ভাসানচরে আশ্রিত আছেন।

এদিকে, এ পরিস্থিতিতে সোমবার জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর এক বিবৃতি দিয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতি বর্তমানে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের টেকসই প্রত্যাবাসনের ‘উপযোগী নয়’। মিয়ানমারে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবাসনের বিষয়ে ইউএনএইচসিআরের অবস্থান অপরিবর্তিত রয়েছে। সম্ভাব্য প্রত্যাবাসন নিয়ে দুই দেশের মধ্যে একটি দ্বিপক্ষীয় পাইলট প্রকল্পে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের একটি গ্রুপের সঙ্গে দেখা করতে মিয়ানমারের একটি প্রতিনিধিদলের বাংলাদেশে সফর সম্পর্কে অবগত রয়েছে তারা। তবে ইউএনএইচসিআর এসব আলোচনায় জড়িত নয়।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত