চট্টগ্রামে ৫০টি ‘কিশোর গ্যাং’ জড়িয়ে পড়ছে নানা অপরাধে
‘হিরো’ হওয়ার প্রবণতা থেকে একের পর এক গ্রুপ সৃষ্টি
প্রকাশ : ২৬ মার্চ ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
সাইফুদ্দিন তুহিন, ট্টগ্রাম
চট্টগ্রাম নগরীর ১৬ থানা জুড়েই ৫০টির বেশি ‘কিশোর গ্যাং’ সক্রিয়। নগরবাসীর কাছে নতুন উৎপাত-নতুন আতঙ্ক হিসেবে দেখা দিয়েছে এসব ‘কিশোর গ্যাং’। প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় থাকা কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতায় পাড়া মহল্লায় শঙ্কা বিরাজ করছে। লোকজনের ধারণা নগরীর অলিগলিজুড়ে নিয়ন্ত্রীণহীন কিশোর গ্যাংয়ের লাগাম টানতে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই। তাই অনেকটা বেপরোয়া কিশোর গ্যাং। তারা অনেকটা নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ছে। এসব গ্রুপে জড়িত অন্তত আড়াই হাজার থেকে ৩ হাজার কিশোর। গ্যাংয়ের সদস্যরা নানা ধরনের অপরাধমূলক কাজে জড়িত। এর মধ্যে আছে মাদক বেচা-কেনা, জমি দখল, চাঁদাবাজি, টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ, ফুটপাতে হকার বাণিজ্য, মারামারি, ইভটিজিংসহ নানা অপরাধ।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত ৬ ফেব্রুয়ারি নগরীর চান্দগাঁও থানাধীন কাপ্তাই রাস্তার মাথা এলাকায় চাঁদা না দেয়ায় কিশোর গ্যাং সদস্যদের ছুরিকাঘাতে আজমির হোসেন নামে এক সিএনজি অটোরিকশা চালক আহত হন। এ ঘটনায় আহত অটোরিকশা চালক বাদী হয়ে কিশোর গ্যাং লিডার আজাদসহ তিনজনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। মামলা হলেও বহাল তবিয়তে আজাদসহ অন্য আসামিরা। এতে মামলাকারী সিএনজিচালক নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন বলে পুলিশের কাছে জানিয়েছেন।
নগরীর চকবাজার এলাকায় সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েকটি ঘটনার সঙ্গে জড়িত কিশোর গ্যাং। গত ১৬ ফেব্রুয়ারি চকবাজার এলাকায় দুই কিশোর গ্যাং গ্রুপের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে সংঘর্ষ হয়। এতে অন্তত ছয়জন আহত হন। এ ঘটনায় আহত হন জিকু নাথ নামে এক কিশোর। ঘটনার পর তার মা অঞ্জনা রানী নাথ বাদী হয়ে চকবাজার থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলায় কিশোর গ্যাংয়ের ১৩ সদস্যকে আসামি করা হয়।
গত বছরের ৮ এপ্রিল নগরের কোতোয়ালি থানাধীন চেরাগী পাহাড় দৈনিক আজাদী গলিতে দুই কিশোর গ্যাং গ্রুপের প্রচন্ড মারামারি হয়। সিনিয়র জুনিয়র দ্বন্দ্বে ওই মারামারিতে প্রকাশ্যে কুপিয়ে নৃশংসভাবে খুন করা হয় আসকার বিন তারেক নামে এক কিশোরকে। এ ঘটনায় নিহতের পিতা বাদী হয়ে মামলা করেন। মামলার আসামিদের অধিকাংশই কিশোর। মামলার পর কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হলেও অধিকাংশ জামিন নিয়ে বেরিয়ে ঘুরছেন বীরদর্পে। একই ঘটনাস্থলের দেড়শ’ গজ দূরে ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে জামালখান মোড়ে প্রকাশ্যে কুপিয়ে খুন করা হয় আদনান ইফসারকে। এ মামলায় গ্রেপ্তার পাঁচ কিশোর হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি প্রদান করেন। ওই বছরের ১৫ এপ্রিল নগরীর পাহাড়তল থানার ঈদগাঁও কাঁচা রাস্তার মোড়ে দুলহান কমিউনিটি সেন্টারের সামনে দুই কিশোর গ্যাং গ্রুপের মধ্যে মারামারির ঘটনা ঘটে। আধিপত্য বিস্তার নিয়ে সংগঠিত এ ঘটনায় ছুরিকাঘাতে ফাহিম (১৬) নামে গণপূর্ত বিদ্যানিকেতনের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র নিহত হন।
নগরীর বাকলিয়া থানার ওসি মো. আবদুর রহিম জানান, কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। গত বছরের ৪ জুলাই রাতে ওই থানার সৈয়দ শাহ রোডের ওয়াপদা গেট এলাকায় মোরশেদ নামে এক ব্যক্তির ভাড়া ঘরে অভিযান চালিয়ে কিশোর গ্যাং গ্রুপের চার সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় তাদের কাছ থেকে দেশীয় তৈরি টু টু বোর পিস্তল, একটি চাইনিজ কুড়াল ও ৫০০ গ্রাম গাঁজা উদ্ধার করা হয়।
এদিকে ২৮ ফেব্রুয়ারি নগরের চকবাজার এলাকায় আধিপত্য বিস্তারে জড়িত ‘ডট গ্যাং’ নামে পরিচিত একটি কিশোর গ্যাং গ্রুপের লিডারসহ সাতজনকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। এ ব্যাপারে র্যাবের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানান, নগরীর বিভিন্ন এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের তথ্য আছে। অভিযোগ পেলে দ্রুত দ্রুত অভিযান পরিচালনা করা হয়। ‘কিশোর গ্যাং গ্রুপ ‘ডট গ্যাং’ নামে গত দেড় বছর আগে সৃষ্টি একটি গ্রুপের তথ্যও আছে। এ গ্রুপের বেশিরভাগ সদস্য আগে ‘ছুরিয়াটি’ নামের আরেকটি কিশোর গ্যাং গ্রুপের সদস্য হিসেবে ছিল। পরবর্তীতে আধিপত্য বিস্তারের জের ধরে তারা আলাদা হয়ে যায়। গ্রুপটির লিডার মিম। তার পিতা একজন চিকিৎসক, মা চাকরিজীবী। দুই ভাইয়ের মধ্যে সে ছোট। তার কিশোর গ্যাং গ্রুপে অন্তত ৪০ জন সদস্য রয়েছে। এরমধ্যে সক্রিয় ৮ থেকে ৯ জন। যেখানেই মারামারি কিংবা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হতো সেখানেই এই গ্রুপের ৮-৯ জনের উপস্থিতি দেখা যেত। মূলত চাঁদাবাজি, জমি দখল, আধিপত্য বিস্তার, ইভটিজিংসহ গ্রুপটি নানা সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা করত। এ গ্রুপের অধিকাংশ সদস্যই ২০২৩ সালের এসএসসি পরীক্ষার্থী। এরা চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্বনামধন্য স্কুলের ছাত্র। তারা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডগুলো ফেইসবুকে শেয়ার করত। অধিকাংশ সদস্যই ‘হিরো ইজম’ বা ‘হিরো’ হয়ে ওঠার প্রবণতা থেকে গ্রুপটিতে যোগদান করে। পরে তারা বিভিন্ন স্থানে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়।