সুসংবাদ প্রতিদিন
দিনাজপুরে আশা জাগাচ্ছে সমতলের চা-বাগান
প্রকাশ : ২৬ মার্চ ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
আলোকিত ডেস্ক
কৃষিনির্ভর জেলা দিনাজপুরে জলোচ্ছ্বাস, ঝড়সহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ তেমন নেই। এখানকার মাটিও উর্বর। ধান, লিচু, ভুট্টাসহ সব ধরনের ফসল উৎপাদনও বেশি হয় এই জেলায়। দেশের খাদ্য উৎপাদন যথেষ্ট অবদান রাখছে দিনাজপুর। এখানে ধান, লিচু ও ভুট্টার পাশাপাশি সমতল ভূমিতে চা-চাষের সাফল্য দিন দিন বেড়েই চলছে। পতিত জমি ছাড়াও ধান ও ভুট্টার জমিতে চা চাষ শুরু করেছেন কৃষকরা। চা চাষ করে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখতে শুরু করেছেন এ অঞ্চলের চাষিরা। দিনাজপুর অঞ্চলের মাটি ও আবহাওয়া উপযুক্ত থাকায় চা ভালো উৎপাদন হয়। ফলে পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারীর সাফল্যের পর দিনাজপুরেও চা চাষ শুরু হয়েছে। আগামীতে চা চাষ বদলে দিতে পারে দিনাজপুরের অর্থনৈতিক অবস্থা। ২০১৪ সালে উত্তরাঞ্চলের সমতল ভূমি দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলায় প্রথম ক্ষুদ্র পর্যায়ে চা চাষ শুরু হয়। ধীরে ধীরে এর পরিধি বেড়ে জেলার বোচাগঞ্জ, পার্বতীপুর, বিরামপুর, খানসামা ও চিরিরবন্দরে এখন বাণিজ্যিকভাবে চাষ হচ্ছে চা। চা-বাগানে সব গাছে উঁকি দিতে শুরু করেছে দুটি পাতার একটি নতুন কুঁড়ি। শুরু হয়েছে পাতা সংগ্রহের ব্যস্ততা। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, জেলায় কয়েকটি উপজেলায় প্রায় ১৪ হেক্টর জমিতে চা চাষ হচ্ছে। ধান-লিচুর জেলায় চা-পাতার ফলন বেশ ভালো হচ্ছে। চা-বাগানগুলোতে স্থানীয় কয়েকশ’ নারী-পুরুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে। বিশেষ করে নারী শ্রমিকরা বেশি কাজ করছে। আগে নারীরা বাসায় বেকার বসে থাকত। এখন চা-বাগানে কাজ করে সংসারে সচ্ছলতা আনছে। চিরিরবন্দর উপজেলার মরিয়ম টি বাগানের চা শ্রমিক দিলাপ কুমার বলেন, আমি কয়েক বছর ধরে এই বাগানে চায়ের পাতা তুলি। আগে বাসায় কাজ না থাকলে দূরে যেতাম কাজের জন্য। এখন বাসার কাছে চা-বাগান হওয়ায় কিছুটা শান্তিতে আছি। তবে চা-বাগানে কাজের মজুরিটা একটু কম। বাগানমালিক যদি আমাদের মজুরিটা বাড়িয়ে দেন তাহলে আমাদের জন্য ভালো হয়। কারণ বাজারে সব জিনিসের দাম অনেক চড়া। চাশ্রমিক অনিকা রায় বলেন, চা-বাগানটি বাসার কাছে হওয়ায় খুব ভালো হয়েছে। আগে বাসায় বসে থাকতাম, কোনো কাজ করতাম না। এখন বাসার কাছে চা-বাগান হওয়ায় এখানে কাজ করে সংসারে সহায়তা করতে পারছি। বাচ্চাদের লেখাপড়ার খরচ দিতে পারছি। তবে নারী শ্রমিকদের মজুরিটা কম হয়েছে। আমরা চাই আমাদের মজুরি আরেকটু বাড়িয়ে দেয়া হোক। চাশ্রমিক লতা রানি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আগে কৃষি জমিতে কাজ করতাম। বাসা থেকে আমার স্বামী কাজে যেতে নিষেধ করত। এখন আমরা স্বামী-স্ত্রী দুজনেই মরিয়ম টি বাগানে কাজ করি। কৃষি কাজ তো সব সময় থাকে না। আগে কাজ না থাকলে বাসায় বসে থাকতে হতো। এখন বাড়ির সঙ্গে চা-বাগান হওয়ায় দুজনে মিলে চা-বাগানে কাজ করে আমাদের সংসারে অভাব দূর করছি। পার্বতীপুর উপজেলার চা-বাগান মালিক জুলফিকার হক জুয়েল বলেন, পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য ২০১৮ সালে পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ উপজেলার ভাউলাগঞ্জে ন্যাশনাল ব্যাংকে শাখা ব্যবস্থাপক পদে যোগদান করি। সে সময় চা-বাগান মালিক ও চা শিল্পের সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তাদের উৎসাহ ও পরামর্শে ২ একর জমিতে চা-বাগান করি। তিনবার চা-পাতা আহরণ করেছি। প্রথমবার পেয়েছি ৮০০ কেজি চা-পাতা। পরের বার ১ হাজার ১০০ কেজি এবং গত বছরের ৩ জুলাই ১ হাজার ৫০০ কেজি (দেড় টন) চা-পাতা আহরণ করেছি। এবার আরো বেশি চা-পাতা হওয়ার আশা করছি।
বোচাগঞ্জ উপজেলার চা-চাষি ফজলে রাব্বি বলেন, চার বছর আগে চা-বাগান শুরু করি। ৯ বিঘা জমিতে প্রায় ১৮ হাজার চায়ের গাছ আছে। দুই বছর আগে থেকে এই বাগানের চা-পাতা বিক্রি শুরু করছি। বর্তমান ৪৫-৫০ দিন পর চা-পাতা বিক্রি করছি। একটি চা কোম্পানি বাগানে এসে চা-পাতা নিয়ে যায়। বাগান থেকে প্রতি কেজি চা-পাতা ১৬-২০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। চা-বাগান করার ফলে এলাকার কিছু মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। তিনি আরো বলেন, আমাদের এলাকায় আমরা প্রথম পরীক্ষামূলক চা-বাগান করি। আমরা মোটামুটি সফল। আমাদের এদিকে যে চাগাছ ভালোই হয় সেটা আমরাই প্রমাণ করলাম। অনেকে বলেছিল এখানে চা-বাগান হবে না। কিন্তু চেষ্টা এবং পরিশ্রম করেছি। আল্লাহর রহমতে চা-বাগান ভালোই হয়েছে। চিরিরবন্দর উপজেলার মরিয়ম টি বাগানের মালিক এম আতিকুর রহমান বলেন, কৃষির জেলা দিনাজপুর হলেও এখানকার কৃষকরা অবহেলিত। এখানকার কৃষকরা যাতে অবহেলিত না থাকে বা কৃষি শ্রমিকরাও যাতে বেকার না থাকে সেই চিন্তা থেকে জেলার চিরিরবন্দর উপজেলায় সাতলালা ইউনিয়নের ২০২০ সালে চায়ের বাগান শুরু করি। প্রথমে প্রায় ৫ একর জমিতে শুরু করি। এক বছরের মাথায় চা-পাতা তোলা শুরু করি। দেখলাম অন্য জেলার তুলনায় আমার বাগানে পাতার ফলন ভালো। তখন বাগান বাড়িয়েছি। এখন প্রায় ১০ একর জমির ওপর মরিয়ম চা-বাগান। তিনি বলেন, এখানে চা-বাগান করে স্থানীয় শতাধিক নারী-পুরুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছি। আমাদের পরিকল্পনা আছে খুব দ্রুত আমরা এখানে চায়ের ফ্যাক্টরি বানাব এবং মরিয়ম টি বাগানের চা বাইরের দেশে রপ্তানি করব। চিরিরবন্দর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জোহরা সুলতানা বলেন, চিরিরবন্দরের কৃষিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে চা চাষ। আমাদের উপজেলার সাতনালা ও ফতেজংপুর ইউনিয়নে প্রায় ১২ একর জমিতে চায়ের চাষ হচ্ছে। কৃষি অফিস থেকে সব ধরনের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে চা চাষিদের। এ বছরের পাতা তোলার কাজ শুরু হয়েছে। পাতার ফলন বেশ ভালো হয়েছে।