ঢাকার রাজধানীখ্যাত গুলিস্তানের নাম শুনলেই চোখের সামনে ব্যস্ততম একটি জায়গার ছবি ভেসে ওঠে। এই ব্যস্ততম এলাকায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের কাছেই দেশ সেরা স্থাপত্য নকশায় মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে যাচ্ছে ‘বঙ্গবন্ধু টাওয়ার’। গুলিস্তান মোড়ে ‘৭ ও ৮’ নম্বর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে বঙ্গবন্ধু টাওয়ার নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। এই টাওয়ারের সব কিছুতেই থাকছে নতুনত্বের ছোঁয়া। টাওয়ার হবে নজরকাড়া আঙ্গিকে যা মানুষকে সহজেই আকৃষ্ট করবে।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, গুলিস্তান মোড়ে বঙ্গবন্ধু স্কয়ার পাতাল সড়কের পাশেই ‘৭ ও ৮’ নম্বর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে দুই প্লটেই জরাজীর্ণ চার তলা ভবন দাঁড়িয়ে আছে। জরাজীর্ণ এই দুই ভবন ঘিরেই রাষ্ট্রায়ত্ব প্রতিষ্ঠান জীবন বীমা কর্পোরেশনের অফিস। নিচে রাজ হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট, রাজধানী হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট, সিঙ্গার প্লাস, পাপ্পু সুজ এবং নাদিয়া সুজসহ বিভিন্ন ধরনের দোকান ও অফিস রয়েছে। এই জরাজীর্ণ ভবন ভেঙে বঙ্গবন্ধু টাওয়ার নির্মাণের ব্যাপারে স্থানীয় মানুষের মধ্যে উৎসাহ দেখা গেছে। এই ঘিঞ্জি এলাকায় নান্দনিক টাওয়ার হলে সৌন্দর্য সহজেই মানুষকে বিমোহিত করবে। বিশেষ দিনগুলো উপলক্ষে দূরদূরান্ত থেকে বঙ্গবন্ধু টাওয়ারে পণ্য কেনাকাটায় মানুষ ভিড় জমাবে।
গণপূর্তের কয়েকজন প্রকৌশলী জানান, বঙ্গবন্ধু এভিনিউ টাওয়ার নির্মাণে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব কাজী ওয়াছি উদ্দিন গুরুত্ব দিয়েছেন। দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই তিনি বঙ্গবন্ধু টাওয়ার নির্মাণে বিশেষ তাগিদ দিয়ে আসছেন। ১৯ কাঠা জায়গার উপর বিশ্বমানের বাণিজ্যিক টাওয়ার হবে এটি। টাওয়ারে দৃষ্টিনন্দন ও আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা থাকবে। ভিআইপি লাউঞ্জ, সাংবাদিক লাউঞ্জ, স্বতন্ত্র কার পার্কিং, একাধিক লিফট, সিঁড়ি ও অগ্নি প্রতিরোধক ব্যবস্থা থাকবে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, গুলিস্তানের ‘৭ ও ৮’ বঙ্গবন্ধু এভিনিউ চার তলা ভবনে তৎকালীন পাকিস্তান বীমা কর্পোরেশনের অফিস ছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সেখানে বাংলাদেশের জাতীয় বীমা কর্পোরেশনের অফিস করা হয়। দেখা যায়, কিছুদিন পরই পাকিস্তানি বংশো™ূ¢ত পরিচয়ে ভবনের দাবিদার বের হয়। ভবনের মালিকানা নিয়ে দীর্ঘদিন আদালতে মামলা চলে। অবশেষে সেই মামলা সরকারের পক্ষে রায় আসে। এর পরই বঙ্গবন্ধু টাওয়ার নির্মাণের পরিকল্পনা নেয়া হয়।
গুলিস্তান মোড়ে ৭ নম্বর বঙ্গবন্ধু এভিনিউ প্লটে ১৫ কাঠা এবং ৮ নম্বর বঙ্গবন্ধু এভিনিউ প্লটে ৪ কাঠা। মোট ১৯ কাঠা জমির উপর ‘বঙ্গবন্ধু টাওয়ার’ নির্মাণের পরিকল্পনা চলছে। ইতোমধ্যেই স্থাপত্য অধিদপ্তর বঙ্গবন্ধু টাওয়ারের কয়েকটি ডিজাইন তৈরি করেছে। প্রধানমন্ত্রী সিডিউল দিলেই তাঁকে ডিজাইন দেখানো হবে। এরপরেই প্রকল্প আকারে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) করা হবে।
বঙ্গবন্ধু টাওয়ার নির্মাণের বিষয়ে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব কাজী ওয়াছি উদ্দিন আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতি সরংক্ষণ ও নতুন প্রজন্মের নিকট জাতির পিতার অবদান তুলে ধরার লক্ষ্যে ঢাকার রাজধানী খ্যাত গুলিস্তানে ‘বঙ্গবন্ধু টাওয়ার’ নির্মাণ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বঙ্গবন্ধু টাওয়ারের মাধ্যমে প্রজন্মের পর প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অবদান, মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সৃষ্টির ইতিহাস সম্পর্কে আরো বেশি জানতে পারবে। খুব শিগগিরই বঙ্গবন্ধু টাওয়ার নির্মাণের সকল কার্যক্রম হাতে নেয়া হবে।’
সচিব বলেন, ‘আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের পাশেই নান্দনিক ‘বঙ্গবন্ধু টাওয়ার’ নির্মাণ করা হবে। এটি সম্পন্ন বাণিজ্যিক টাওয়ার এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে ফ্লোর ভাড়া দেওয়া হবে। টাওয়ারের সামনে আলোকোজ্জ্বল দৃষ্টিনন্দন পানির ফোয়ারা থাকবে, যা দেখে মুগ্ধ হবেন সবাই।’
তিনি আরো বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু টাওয়ার নির্মাণের ব্যাপারে গত বছরের অক্টোবরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। তিনি (প্রধানমন্ত্রী) বলেছেন- বঙ্গবন্ধু টাওয়ারের আশেপাশে ভ্রাম্যমাণ হকারদের পণ্য বিক্রির ব্যবস্থা রাখতে হবে। এসব ভ্রাম্যমাণ হকারদের কাছ থেকে কোনো ভাড়া নেয়া হবে না।’
জানা গেছে, ঢাকা মহানগর বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) অনুযায়ী বঙ্গবন্ধু টাওয়ার নির্মাণ করা হবে। কারণ, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) আওতাধীন এলাকায় ভবন নির্মাণ করতে হলে দুই ধরনের অনুমোদন নিতে হয়। প্রথমত, ভূমি ব্যবহারের ছাড়পত্র। দ্বিতীয়ত, নির্মাণ অনুমোদন। ভূমি ব্যবহারের ছাড়পত্র দেয়া হয় ড্যাপ অনুসরণ করে। অন্যদিকে নির্মাণ অনুমোদন দেয়া হয় ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুসারে। এসব নিয়মণ্ডনীতি মেনেই বঙ্গবন্ধু টাওয়ার নির্মিত হবে। গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টরা জানান, গুলিস্তানের ‘৭ ও ৮’ বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে ‘বঙ্গবন্ধু টাওয়ার’ নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের পরই শুরু হবে প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ। সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন প্রকল্পের (এডিপি) অধীনেই নির্মাণ হবে বহুতল টাওয়ার। সরকারের কাছে সেভাবেই প্রস্তাব দেয়া হবে। ব্যাংক, বীমা, নতুন উদ্যোক্তাদের উৎপাদিত পণ্য বিক্রয়, প্রদর্শনী স্থান, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও আন্তর্জাতিক মানের সেমিনার কক্ষসহ বিভিন্ন কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের অফিস থাকবে ‘বঙ্গবন্ধু টাওয়ারে’। এই টাওয়ারে বাণিজ্যিক ব্যবহার ছাড়া কোনো কাজে ব্যবহার করা যাবে না।
গুলিস্তান এলাকার বাসিন্দা ষাটোর্ধ্ব ফজল মিয়া বলেন, বঙ্গবন্ধু মানে বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন সংগ্রাম-ই বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম, বাঙালির মুক্তির সংগ্রাম। বঙ্গবন্ধু আমাদের স্বাধীন স্বদেশ ভূমি উপহার দিয়েছেন। তিনি আমাদের মহান মুক্তির দূত। বাংলার হাজার বছরের ইতিহাসে অবিস্মরণীয় অনন্য এক বিস্ময়কর মহানায়ক। তার নামে গুলিস্তান বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে টাওয়ার হবে, এটি আমাদের গর্বের। বহু আগেই বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে ‘বঙ্গবন্ধু টাওয়ার’ নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া উচিত ছিল বলে মনে করেন ফজল মিয়া। এ ব্যাপারে ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, ‘বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইতিহাসের সাক্ষি হয়ে থাকা জায়গাগুলো সংরক্ষণ করে রাখা হয়। ঐতিহাসিক জায়গাগুলো কেন্দ্র করে প্রতি বছর দেশ-বিদেশ থেকে বহু পর্যটক ঘুরতে আসেন। কিন্তু আমাদের দেশে ঐতিহাসিক জায়গাগুলো সংরক্ষণ করে রাখা হয় না। স্বাধীনতা যুদ্ধের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে নিউমার্কেট ও গুলিস্তান এলাকা। ঐতিহাসিক জায়গা হিসেবে গুলিস্তান বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে বঙ্গবন্ধুর নামে টাওয়ার নির্মাণ করা হবে, এটি নিঃসন্দেহে ভালো উদ্যোগ। বহু আগেই এখানে বঙ্গবন্ধু টাওয়ার নির্মাণ করা দরকার ছিল। বঙ্গবন্ধু টাওয়ার নির্মাণের পাশাপাশি গুলিস্তানে সৌন্দর্যবর্ধনের কার্যক্রম হাতে নিলে নগরের মানুষ স্বস্তি পাবেন।’
এ ব্যাপারে গণপূর্ত রক্ষণাবেক্ষণ সার্কেলের (ঢাকা) তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. মনিরুল ইসলাম আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, ‘গুলিস্তান বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে ‘৭ ও ৮’ নম্বর ভবন দুটি পরিত্যক্ত বাড়ি বা সম্পত্তি। এই পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে ড্যাপের প্রচলিত নিয়ম অনযায়ী বঙ্গবন্ধু টাওয়ার নির্মাণ করা করা হবে। ১৯ কাঠা জমিতে আন্ডারগ্রাউন্ডসহ ২৩ তলা টাওয়ার নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, গুলিস্তানের মতো ব্যস্ততম এলাকায় ‘বঙ্গবন্ধু টাওয়ার’ শুধু বাণিজ্যিক টাওয়ার হিসেবেই নির্মিত হবে না, এই টাওয়ার দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে উজ্জ্বল অধ্যায়, বছরের পর বছর বহন করে চলবে। ‘বঙ্গবন্ধু টাওয়ার’ থেকে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আদায় করবে সরকার।’
প্রসঙ্গত, ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, আইয়ুবের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, ’৬৪-এর দাঙ্গার পর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা, ’৬৬-এর ছয় দফা আন্দোলন ও ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের পথ বেয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সংগ্রাম-লড়াই এবং ১৯৭১ সালের নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধ তথা সশস্ত্র জনযুদ্ধের মাধ্যমে ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। বাঙালির মহাজাগরণের পথিকৃৎ বঙ্গবন্ধুর নামে কয়েক যুগ পর টাওয়ার নির্মাণ হচ্ছে।