নজরদারির অভাবে বেপরোয়া অসাধু চক্র
নকল ও ভেজাল দুধে বাজার সয়লাব : হুমকিতে জনস্বাস্থ্য
প্রকাশ : ০৬ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
শাহজাদপুর (সিরাজগঞ্জ) প্রতিনিধি
পবিত্র রমজান মাস উপলক্ষ্যে দেশে তরল দুধের চাহিদা বাড়লেও বাড়েনি উৎপাদন। বিশেষ করে দুগ্ধশিল্পের কেন্দ্রবিন্দু নিউজিল্যান্ড খ্যাত জনপদ শাহজাদপুরসহ পাবনা-সিরাজগঞ্জে উৎপন্ন গরুর তরল দুধের চাহিদা সারা দেশে বহুলাংশে বেড়েছে। কিন্তু বাড়েনি দুধের উৎপাদন। বাঘাবাড়ি মিল্কশেড এরিয়ায় উৎপন্ন তরল দুধ দেশের মোট চাহিদা পূরণ করতে পারছে না। চাহিদার তুলনায় প্রতিদিন ঘাটতি থেকে যাচ্ছে প্রায় দেড় লাখ লিটার। আর এই ঘাটতি পূরণের সুযোগে এক শ্রেণির মুনাফালোভী অসাধু দুধ ব্যবসায়ী, মধ্যস্বত্বভোগী ও ঘোষ সম্প্রদায় বিভিন্ন কেমিক্যাল মিশ্রণ করে ভেজাল ও নকল দুধ তৈরি করে বাড়তি চাহিদানুযায়ী ঢাকাসহ সারাদেশে সরবরাহের মহোৎসবে মেতে উঠেছে।
সংশ্লিষ্টদের নিয়মিত নজরদারির অভাবে ওই অসাধু চক্রটি ছানার টক পানি, মিল্ক পাউডার, সয়াবিন তেল, হাইড্রোজ, লবণ, কেমিক্যালসহ নানা ধরনের উপকরণ মিশিয়ে ভেজাল ও নকল দুধ দেদারসে তৈরি করছে।
অসাধু চক্রটি প্রথমে টাটকা দুধ থেকে ননি তুলে ননি দিয়ে ঘি তৈরি করছে, ননিবিহীন দুধ (টানা দুধ) দিয়ে কেউবা নিম্নমানের ছানা তৈরি করে সেটা শারাম দুধের ছানার দামে বিক্রি করছে; আবার অনেকে ননিবিহীন টানা দুধের সাথে সয়াবিন, চিনি ও কেমিক্যাল মিশিয়ে দুধের ঘনত্ব তৈরি করে খাঁটি বা শারাম দুধের দামে বিক্রি করছে। আবার অনেকে ড্রামকে ড্রাম ছানার টক পানি সংরক্ষণ করে সেই পানির সাথে ফরমালিন ও কাটিং ওয়েলসহ মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর নানা কেমিক্যাল মিশিয়ে ভেজাল ও নকল তরল দুধ তৈরি করে দুধের বর্ধিত চাহিদা পূরণে ঢাকাসহ সারাদেশে সরবরাহ করছে। নানা অসাধু উপায়ে দুধে ভেজালকারী ওই চক্রটি এ দুধ বিক্রি করে রাতারাতি আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ বনে যাচ্ছে। দেশের সর্ববৃহৎ সমবায়ী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ দুগ্ধ উৎপাদনকারী প্রাথমিক সমবায় সমিতি লিমিটেড মিল্কভিটা ও এ অঞ্চলের বিভিন্ন বেসরকারি ডেইরি প্রজেক্ট কর্তৃক নির্ধারিত প্রতি লিটার দুধের দামের চেয়ে ভেজাল ও নকল দুধ তৈরিকারী চক্রটি অবৈধ পন্থায় তাদের উপার্জিত বিপুল অবৈধ অর্থের দাপটে রমজানে গো-খামারিদের দুধের দাম লিটারপ্রতি বেশি দিয়ে দুধ ক্রয় করে তার সাথে ভেজাল মিশ্রণ করে অতিরিক্ত চাহিদার এক দেড় লাখ লিটার নকল ও ভেজাল দুধ তৈরি করে ঢাকাসহ সারাদেশে সরবরাহ করছে। এসব কেমিক্যাল মিশ্রিত নকল ও ভেজাল দুধ খেয়ে দেশের শিশুরা আক্রান্ত হচ্ছে নানান জটিল রোগে। ফলে তাদের জীবন ও ভবিষ্যৎ বিপন্ন হতে চলেছে। অন্যদিকে, ভেজালকারীদের অবৈধ ও অনৈতিক দৌরাত্ম্য আর দাপটে দুগ্ধ ব্যবসায়ের ভরা মৌসুমে মিল্কভিটার বাঘাবাড়ি ও মোহনপুর কারখানায় দুধ সংগ্রহের হার আশঙ্কাজনক হারে কমে যাওয়ায় হুমকির মুখে পড়েছে মিল্কভিটা। ২০০৮ সালের পর দুয়েক বছর নকল ও ভেজাল দুধ তৈরিকারকদের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত নিয়মিত অভিযান চালিয়ে তাদের কোনঠাসা করলেও গত প্রায় ১ যুগে নকল ও ভেজাল দুধ তৈরিকারী অসাধু চক্রের বিরুদ্ধে উল্লেখযোগ্য কোনোে ব্যবস্থা নেয়নি কেউ। ফলে ভেজালকারীদের সংখ্যা ও দৌরাত্ম্য আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। জানা যায়, স্বাধীনতার পর সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর উপজেলার বাঘাবাড়ী বড়াল নদীর উত্তর পাশে স্থাপন করা হয় বাংলাদেশ প্রাথমিক দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় সমিতি লিমিটেড (মিল্কভিটা) এর প্রধান কারখানা। মিল্কভিটাকে কেন্দ্র করে বাঘাবাড়ি মিল্কশেড এরিয়ায় গড়ে উঠেছে প্রায় ৪২ সহস্রাধিক গো-খামার। এসব গো-খামারে প্রতিদিন গড়ে ৪ লাখ লিটার দুধ উৎপন্ন হয়। এছাড়া বাঘাবাড়ি মিল্কসেড এরিয়ার পাবনা, সিরাজগঞ্জ ও নাটোর জেলার প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই গাভী লালন-পালন করা হয়। এসব গাভী থেকেও দৈনিক আরো প্রায় ১ লাখ থেকে সোয়া লাখ লিটার দুধ পাওয়া যায়। দৈনিক উৎপন্ন ৫ থেকে সোয়া ৫ লাখ লিটার গরুর দুধ মিল্কভিটাসহ বেসরকারি নানা ডেইরি প্রজেক্টের কুলিং সেন্টার ও ঘোষ সম্প্রদায়সহ মধ্যস্বত্বভোগীদের কাছে খামারিরা বিক্রি করে আসছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার ঘোষ সম্প্রদায় ও দুধ ব্যবসায়ীদের শতাধিক কারখানায় প্রতিদিন প্রায় ১ লাখ লিটার দুধের ছানা তৈরি করা হয়। এসব কারখানায় অত্যাধুনিক বৈদ্যুতিক অটোমেটিক মেশিনের মাধ্যমে নিমিষেই দুধ থেকে শতভাগ ননি (ফ্যাট) বের করে নেয়া হয়। পরে ওই ননিবিহীন দুধ (টানা দুধ) জ্বালিয়ে তাতে ময়দা মিশিয়ে নিম্নমাণের ছানা (টানা দুধের ছানা) তৈরি করে তা উৎকৃষ্ট ও খাঁটি ছানা (শারাম দুধের ছানা) হিসেবে বেশি দামে বিক্রি করে ভোক্তাদের সাথে প্রতারণা করা হয়। আবার এসব কারখানায় অসাধু ব্যবসায়ীরা ননী বিহীন টানা দুধের সাথে চিনি, সোয়াবিন তেল, জ্বাল দেয়া তরল আটা ও ক্ষতিকর কেমিক্যাল মিশিয়ে দুধের কৃত্রিম ঘনত্ব প্রস্তুত করে বিভিন্ন বেসরকারি ডেইরি প্রজেক্টের কুলিং সেন্টারের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা বা কর্মচারীর সহযোগিতায় লিটারপ্রতি কমিশন বাণিজের ভিত্তিতে শতভাগ ননিবিহীন ভেজাল দুধকে ননীযুক্ত শতভাগ টাটকা দুধ হিসেবে খাঁটি দুধের দামেই অসাধু উপায়ে চালিয়ে দিয়ে প্রতিদিন মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। তথ্যানুসন্ধানে আরো জানা গেছে, প্রতি মন ছানার পানিতে আধা কেজি ননি, আধা কেজি স্কিমমিল্ক পাউডার, সামান্য পরিমাণ লবণ, খাবার সোডা, ১ কেজি চিনি ও দুধের কৃত্রিম সুগন্ধি (এসেন্স) মিশিয়ে অবিকল দুধ তৈরি করা হচ্ছে, যা রাসায়নিক পরীক্ষা ছাড়া আসল না নকল তা নির্ণয় করা সম্ভব নয়। কতিপয় অসাধু ঘোষ ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে এই ভেজাল ও নকল দুধ সংগ্রহ করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কিছু অসাধু কর্মকর্তারা লিটার প্রতি কমিশন নিয়ে
টাটকা খাঁটি দুধ হিসেবে বেসরকারি দুধ প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্রে ঢুকিয়ে দিতে সহযোগিতা করছে। এসব দুগ্ধ সংগ্রহ কেন্দ্রে নকল দুধের সাথে খাঁটি দুধ মেশানোর ফলে সব দুধই ভেজালে পরিণত হচ্ছে। তাছাড়া, এসব অসাধু দুধ ব্যবসায়ীরা দুধকে সতেজ রাখতে মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর ফরমালিন ব্যবহার করছে। তাছাড়া, দুধ থেকে শতভাগ ফ্যাট (ননি) বের করে নেয়ার ফলে দুধের পুষ্টিমানও কমে যাচ্ছে। আর এ দুধ বেশি দামে কিনেও অজান্তেই ভোক্তারা প্রতিনিয়ত প্রতারিত হচ্ছেন।
সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর উপজেলার বাঘাবাড়ির খামারি মো. জাকির হোসেন বলেন, গো-খাদ্যের দাম অস্বাভাবিক বেড়েছে। সে তুলানায় দুধের দাম বাড়েনি। দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রতিষ্ঠানগুলো ৪ দশমিক ৫০ স্ট্যান্ডার্ড ফ্যাটের (ননী যুক্ত) দুধ প্রতি লিটার ৫০ থেকে ৫১ টাকা দরে কিনছে। এই মানের দুধ খুব কম উৎপন্ন হয়। খোলা বাজারে প্রতিলিটার দুধ ৬৫ থেকে ৭০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। বেশির ভাগ গো-খামারি দাদন নেয়ায় দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রতিষ্ঠানগুলোতে কম দামে দুধ সরবরাহ করতে বাধ্য হচ্ছেন। ফলে, অব্যাহত লোকসানে অনেক খামারিরা গরু বিক্রি করে দিচ্ছেন। তিনি বলেন, তার খামারে শতাধিক গরু ছিল। এখন মাত্র ৩ থেকে ৪টি গাভী আছে। তাদের দুগ্ধ সমিতিতে আগে ৪৩-৪৪ ক্যান দুধ হতো। এখন মাত্র ৩ থেকে ৪ ক্যান দুধ পাওয়া যায়। তার মতো অনেকে খামারি গরু বিক্রি করে দিয়ে অন্য পেশায় চলে গেছে। তাদের কাছে এক সময়ের সম্ভাবনাময় দুগ্ধ শিল্প এখন লাভজনক নয় বলেও তিনি উল্লেখ করেন। নাভানা মিল্কের ব্যবস্থাপক জগলুল হায়দার জানান, দুধ শুধু আমরাই নয়, আড়ং, আকিজ, আমোমিল্ক, আফতাব, মিল্কভিটাসহ অন্যান্য কোম্পানি সংগ্রহ করে থাকে। তবে তাদের দুধ সংগ্রহ পদ্ধতি শতভাগ ভেজালমুক্ত। তারা সরাসরি গো-খামারী ও ব্যবসায়দের কাছ থেকে কোম্পানির নিজস্ব কর্মচারী দ্বারা আধুনিক যন্ত্রপাতি ও রাসায়নিক পরীক্ষায় ভেজালমুক্ত নিশ্চিত হয়ে তবেই দুধ সংগ্রহ করে থাকেন। রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজের সাবেক অধ্যাপক ডা. মো. জামাল হায়দার চৌধুরী জানান, কেমিক্যাল মিশ্রিত তরল দুধ দীর্ঘদিন পান করলে মানবদেহে এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে। ফরমালিন মেশানোর ফলে হেপাটোটক্সিকিটি বা লিভার ও কিডনি সংক্রান্ত রোগ ও ক্ষতিকর মিল্ক পাউডারের ফলে মানবদেহে হাড়ের মধ্যকার দুরত্ব সৃষ্টি হতে পারে। এর ফলে শরীরের পেছনের অংশে ব্যাথা অনুভব, চর্মরোগ, হজমে সমস্যা, পেটের পীড়াসহ নানা উপসর্গ দেখা দিতে পারে। এসব বিষয়ে কথা হয় মিল্কভিটা’র সাবেক চেয়ারম্যান হাসিব খান তরুণের সাথে। তিনি বলেন, ‘দীর্ঘ সময় অসাধু দুগ্ধ ব্যবসায়ী, মধ্যস্বত্বভোগী ও ঘোষ সম্প্রদায়ের কারখানায় নকল ও ভেজাল দুধ তৈরি রোধে নিয়মিত নজরদারি ও প্রশাসনিক অভিযান পরিচালনা না করায় দুগ্ধশিল্পে চরম এ দুরববস্থার সৃষ্টি হয়েছে। অসাধু এ চক্রকে প্রতিহত করতে অনতিবিলম্বে নিয়মিত তদারকি ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সেইসাথে গো-খাদ্যের মূল্য খামারিদের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আনা ও ভেজালমুক্ত গো-খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। সেইসাথে করোনাকালীন সময়ের মতো বর্তমানেও এ অঞ্চলের গো-খামারিদের মাঝে অর্থিক সহযোগিতা প্রদানসহ দুগ্ধশিল্পে ভর্তুকির ব্যবস্থা চালু করতে হবে। তাহলেই গো-খামারি ও দুগ্ধশিল্প ঘুরে দাঁড়াবে।