ঢাকা ০৪ অক্টোবর ২০২৪, ২০ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে খুনাখুনি ও মাদক কারবার

ভেতরে বাইরে সর্বত্র আতঙ্ক

ভেতরে বাইরে সর্বত্র আতঙ্ক

রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে খুনোখুনি ও মাদক কারবারসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চলে আসছে। নানা কারণে কখনো কখনো রোহিঙ্গাদের এসব অপরাধ কর্মকাণ্ড আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। গত ৫ মাসে ক্যাম্পগুলোতে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের হাতে অন্তত ৩২ জন রোহিঙ্গা নাগরিক নিহত হয়েছেন। প্রায় প্রতিদিনই ক্যাম্প এলাকায় কোনো না কোনো সন্ত্রাস ও অপরাধমূলক ঘটনা ঘটছে। এতে করে ক্যাম্পগুলোর আশপাশের স্থানীয় নাগরিকরাও অনিরাপদ হয়ে পড়েছে। কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে নিত্যদিনের এসব ঘটনা অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনায় সবসময় আতঙ্কে থাকছে শিবিরের ভেতরে রোহিঙ্গা ও বাইরে স্থানীয় লোকজন।

পুলিশ ও রোহিঙ্গা ক্যাম্প সূত্র বলছে, গত পাঁচ মাসে ক্যাম্পগুলোতে ৩০টির বেশি সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনায় ৩২ রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ১৫ জন রোহিঙ্গা মাঝি, ৮ জন আরসা ও আরএসও সন্ত্রাসী। অন্যরা সাধারণ রোহিঙ্গা। ক্যাম্পে মাদক, অস্ত্র ও সোনার চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ, আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠী ‘আরাকান স্যালভেশন আর্মি (আরসা) ও আরাকান রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও) এবং রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী নবী হোসেন বাহিনী ও মাস্টার মুন্না বাহিনীসহ ক্ষুদ্র আরো একাধিক বাহিনী আধিপত্য বিস্তারে প্রতিদিন কোনো না কোনো ক্যাম্পে অপরাধ কর্মকাণ্ড মানুষকে ভাবিয়ে তুলছে। তবে, সবচেয়ে বেশি গোলাগুলি ও হত্যার ঘটনা ঘটছে মিয়ানমারের উখিয়া সীমান্তের নিকটবর্তী বালুখালী, কুতুপালং ক্যাম্পে।

প্রতিদিনই ক্যাম্পগুলোতে গোলাগুলি ও সংঘর্ষ লেগে আছে। সর্বশেষ গত ৩১ মার্চ রাত ২টার দিকে উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প-৮ (ডব্লিউ) পচাবাজার এলাকায় অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ফের দুই সন্ত্রাসী গ্রুপের মধ্যে গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় ক্যাম্পের এক পাহারাদার নিহত হন। এ সময় এক শিশু গুলিবিদ্ধসহ আহত হয়েছেন আরো অন্তত ৫ জন। উখিয়ার ক্যাম্প ১২ জি-৭ এলাকায় সশস্ত্র দুর্বৃত্তের গুলিতে রোহিঙ্গা হাফেজ মাহবুব (২৭) নিহত হন। তিনি ১৯ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ব্লক/ডি-৯ এর সৈয়দ আমিনের ছেলে। এছাড়াও ৮ মার্চ কুতুপালং ২ নাম্বর ক্যাম্পে সকাল ৭টার দিকে ডব্লিউ ব্লকে রোহিঙ্গা নেতা সৈয়দ হোসেন ওরফে কালা বদাকে (৩৭) গুলি করে হত্যা করা হয়। তিনি ২ নম্বর ক্যাম্পের হেড মাঝি (নেতা) ছিলেন। ৭ মার্চ ক্যাম্প-৯ রাত ১টার দিকে রোহিঙ্গা নেতা নূর হাবি ওরফে ডা. ওয়াক্কাসকে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। ৩ মার্চ উখিয়ার ক্যাম্প-১৯ এলাকায় দুর্বৃত্তের গুলিতে খুন হন মুহাম্মদ রফিক (৩৫)। ২৫ ফেব্রুয়ারি ভোরে উখিয়ার ক্যাম্প-২০ এর পাহাড়ি এলাকার ছরার কাছে মরদেহ মিলেছে মৌলভী সামসু আলমের (৩৮)। তিনি ক্যাম্প-১৭ ব্লক-সি সাব এইচের মৃত মিয়া চাঁনের ছেলে। ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে কুতুপালং ক্যাম্প-৫ এ আরসা ও আরএসওর মধ্যে কয়েক ঘণ্টা ধরে গোলাগুলি ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন রোহিঙ্গা মাঝি (নেতা) সলিম উল্লাহ (৩৪)। একই দিন দুপুরে বালুখালী ক্যাম্প-৮ আরসা ও আরএসও সন্ত্রাসীদের মধ্যে গোলাগুলিতে দুই রোহিঙ্গা শিশু গুলিবিদ্ধ হয়। উম্মে হাফসা নামের ১১ বছর বয়সি শিশুর কোমরে এবং আট বছর বয়সি আবুল ফয়েজের ডান পায়ে গুলি লাগে। এভাবে গত ৫ মাসে ৩২ জন হত্যার শিকার হয়েছেন। উখিয়ার বালুখালী ক্যাম্পের রোহিঙ্গা নেতা মুহাম্মদ ইয়াকুব আলী বলেন, মিয়ানমারের দুটি সশস্ত্র গোষ্ঠী এবং অর্ধডজনাধিক রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী বাহিনীর কারণে সাধারণ রোহিঙ্গারা শান্তিতে থাকতে পারছে না। দিনের বেলায় এপিবিএন ক্যাম্পে টহল দিলেও সন্ধ্যার পর ক্যাম্পগুলো অরক্ষিত হয়ে পড়ে। তখন রাজত্ব শুরু হয় দুর্বৃত্তদের। গভীর রাত পর্যন্ত চলে গোলাগুলি-সংঘর্ষ, অপহরণ ও খুনোখুনির ঘটনা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক রোহিঙ্গা মাঝি বলেন, ক্যাম্পে মাদক চোরাচালানের অন্যতম হোতা রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী নবী হোসেন। তার বাহিনীর কয়েকশ’ সদস্য ইয়াবা, আইস ও সোনার ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে। শুরুর দিকে আরসার সঙ্গে মিলেমিশে মাদক চোরাচালান করতেন। দেড় বছর আগে রোহিঙ্গাদের শীর্ষ নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের পর আরসা থেকে বেরিয়ে মাদক চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ শুরু করে নবী হোসেন। দল ভারি করতে নবী হোসেন কাছে টানেন আরএসওকে। এখন আরএসও এবং নবী হোসেন বাহিনী মিলে ক্যাম্প থেকে আরসাকে উৎখাত করতে মরিয়া। আর আরসা সদস্যরা মরিয়া আরএসওকে ঠেকাতে। ফলে আধিপত্য বিস্তারে খুনোখুনি লেগেই আছে।

তথ্যমতে, উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি ক্যাম্পে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা বর্তমানে সাড়ে ১২ লাখ ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে ৮ লাখ এসেছে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য নিপীড়নের মুখে। এসব ক্যাম্পগুলোর আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত আছেন আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) পৃথক তিনটি ব্যাটালিয়নের ২ হাজার ৩০০ সদস্য।

ক্যাম্পের একাধিক রোহিঙ্গা নেতা, বেসরকারি সংস্থার কর্মী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) কার্যালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, ক্যাম্পের পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে হলে সেখানে মাদক, অস্ত্র চোরাচালান রোধ এবং রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের গ্রেফতারে যৌথ অভিযান জরুরী।

উখিয়ার ২৬টি ক্যাম্পের ১৫টির নিরাপত্তা দিচ্ছে ১৪ এপিবিএনের সাত শতাধিক সদস্য। এখানে রোহিঙ্গার সংখ্যা প্রায় পাঁচ লাখ। অপর ১১টি ক্যাম্পের নিরাপত্তা দিচ্ছে ৮ এপিবিএনের সমসংখ্যক সদস্য। এখানে রোহিঙ্গা রয়েছে প্রায় তিন লাখের বেশি। এপিবিএনের সদস্যরা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত টহল ও চৌকিতে তল্লাশি, মাদক, অস্ত্র উদ্ধার ও অপরাধীদের ধরতে অভিযান চালান। কিন্তু সন্ধ্যার পর নিরাপত্তার অভাবে আশ্রয়শিবিরের দুর্গম পাহাড়ের সরু অলিগলিতে টহল পরিচালনা সম্ভব হয় না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

সম্প্রতি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে আরসা ও নবী হোসেন বাহিনীর মধ্যে প্রায়ই মুখোমুখি সংঘর্ষে হতাহতের ঘটনা ঘটছে। আরসার উপস্থিতি ও তাদের সন্দেহজনক কার্যক্রমে নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, ২০২১ সালে আশ্রয়শিবিরে ২২টি হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটলেও ২০২২ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩২টিতে। ২০২১ সালে অপহরণের ঘটনা ঘটেছে ১৭৩টি। ২০২২ সালে ঘটেছে ৮৬টি। ১৪ এপিবিএন অধিনায়ক ও অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক ছৈয়দ হারুনুর রশিদ বলেন, আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ক্যাম্পে মিয়ানমারের দুটি সশস্ত্র গোষ্ঠীসহ কয়েকটি রোহিঙ্গা ডাকাত বাহিনী খুনোখুনিতে জড়িয়ে পড়েছে। ক্যাম্প অস্থিতিশীল করা-ই তাদের লক্ষ্য। গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি এবং সাঁড়াশি অভিযানের মাধ্যমে সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার অভিযান চালাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, রাতের বেলায় ক্যাম্পগুলোতে সন্ত্রাসীদের গোলাগুলি-সংঘর্ষের ঘটনায় সাধারণ রোহিঙ্গারা অতিষ্ঠ-তটস্থ। দিনদুপুরেও খুন-সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। ক্যাম্পে কাজ করা এনজিও-আইএনজিওর কর্মীরাও উদ্বিগ্ন। রোহিঙ্গাদের এসব অপকর্মে অনেকে নিরাপত্তাহীনতায় থাকার কথা জানিয়েছেন।

আরআরআরসিও যৌথ অভিযান চান উল্লেখ করে বলেন, ক্যাম্পগুলোতে শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষায় আমরা পুলিশের ঊর্ধ্বতন মহলের সঙ্গে কথা বলছি। আমরা চাচ্ছি যৌথ অভিযান পরিচালনার মাধ্যমে ক্যাম্পগুলোকে মাদক, অস্ত্র ও সন্ত্রাসমুক্ত রাখতে। ক্যাম্পের চারিদিকে দ্রুত কাঁটাতারের বেড়ার নির্মাণকাজ শেষ করে, সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন, পর্যবেক্ষণ টাওয়ারের কার্যক্রম বৃদ্ধি ও গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানোর তাগিদও দেয়া হচ্ছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

কক্সবাজার সিএসও এনজিও ফোরামের (সিসিএএফ) কো-চেয়ারম্যান আবু মোর্শেদ চৌধুরী বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর পরিস্থিতি দিন দিন অবনতির দিকে যাচ্ছে। অপহরণ, ধর্ষণ, খুনোখুনি বেড়েছে। ক্যাম্পে কর্মরত এনজিও-আইএনজিওর কর্মীদের স্বাভাবিক কাজে ঘটছে ব্যাঘাত। যৌথ অভিযানে সন্ত্রাসীদের নির্মূল করা না হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।

উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্প অধ্যুষিত পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ক্যাম্পের ভেতরে ৩০-৩৫ হাজারের মতো দোকানপাট রয়েছে। অধিকাংশ দোকানপাটের মালিক রোহিঙ্গারা। সেখানেই চলে মাদকের বেচাবিক্রি। রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পের ভেতরে রাখা না গেলে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও মাদক চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ কোনোভাবে সম্ভব নয়।

হোয়াইক্যং ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ নুর আহমদ আনোয়ারী বলেন, অবস্থা দেখে মনে হয় মাদকের টাকায় রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা ভারী অস্ত্র ও গোলাবারুদ কিনছে। আর কৌশলে ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা প্রায় টেকনাফের কৃষকদের অপহরণ করে পাহাড়ে নিয়ে বর্বর নির্যাতন ও মুক্তিপণ আদায় করছে। এসব নির্মূলে যৌথ অভিযান দরকার।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দায়িত্বে থাকা ৮-আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক (অতিরিক্ত ডিআইজি) মো. আমীর জাফর বলেন, মাদক-চাঁদাবাজি, অপহরণসহ নানা অপরাধ নিয়ন্ত্রণে ক্যাম্পে কয়েকটি গ্রুপ কাজ করছে। এসব নিয়ে আধিপত্য বিস্তার করতে অপরাধে জড়ায় তারা। আমরাও অভিযান পরিচালনা করছি। কখনো এপিবিএন একা করছে, কখনো জেলা পুলিশ বা র‌্যাবকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত