সুসংবাদ প্রতিদিন

রঙিন সুতোয় সাদা-কালো স্বপ্ন...!

প্রকাশ : ০৯ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  আরএম সেলিম শাহী, ঝিনাইগাতী প্রতিনিধি

মানুষ বরাবরই রঙিন স্বপ্ন দেখে থাকে। তবে কারো কারো জীবনে স্বপ্নের রঙ রঙিন নাও হতে পারে। তাদের স্বপ্ন হয় সাদা-কালো বা ফ্যাকাশে। এমনই একজন সীতা রানী কোচ। বয়স ষাট পেরিয়েছে। নিবাস তার গারো পাহাড়ের সীমান্ত ঘেষা জেলার নালিতাবাড়ি উপজেলার পোড়াগাঁও ইউনিয়নের অবহেলিত গ্রাম খলচান্দা কোচ পাড়ায়। সেখানে কেবল সীতা রানী কোচই নয়, রয়েছেন আরো প্রায় ৩ শত জন কোচ সম্প্রদায়ের বসতি। সীতা রানী কোচ গারো পাহাড়ের কোচ পল্লীর একটি মাটির ঘরে বসবাস করেন। স্বামী সঞ্জয় কোচ কৃষি কাজে জড়িত। দুই পুত্রসন্তানের জননী সীতা রানী সারা দিন ঘর-গেরস্তের কাজের ফাঁকে ফাঁকে মাটির উঠোনে বসে রঙিন সুতোয় সাদা-কালো স্বপ্ন বুনেন। অর্থাৎ তারা তাদের পরিধেয় শাড়ি বা তাদের ভাষায় রাঙ্গাপাতি তৈরি করে থাকেন। প্রতিটা সুতোর ফাঁকে সুতো দিয়ে নিপুণ হাতের কারুকাজে বোনা রাঙ্গপাতি তৈরি করেন মূলত নারীরাই। কালের আবর্তে তাদের সেই তাঁতের জৌলুস নেই। যেটুকুন রয়েছে তা শুধু তাদের জীবন ধারণ আর প্রয়োজনের তাগিদে সেই বিলুপ্তপ্রায় তাঁতটি এখনও দুই/এক খান টিকে আছে। সেই তাঁতের রঙিন সুতোর ভাঁজে ভাঁজে তাদের মেধা ও শ্রম ক্রমেই দিন দিন ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে। তাদের পরিবারের নানা কাজের ফাঁকে ফাঁকে কাপড় বুননের কাজ করে থাকেন বলে তাদের কিছুটা পুষিয়ে যায়। সীতা রানী কোচ জানায়, একটি রাঙ্গাপাতি তৈরি করতে সুতোর দাম পড়ে ৩০০ টাকা। আর সেই সুতো দিয়ে সনাতনী হাতের তৈরি তাঁতের মাধ্যমে রাঙ্গাপাতি তৈরি করতে সময় লাগে ৫ দিন। এরপর সেটি বিক্রি করে মূল্য পায় মাত্র ৮ শত টাকা। অর্থাৎ সুতোর দাম বাদ দিলে তার শ্রমের মূল্য দাঁড়ায় দিন প্রতি ১০০ টাকা। যদিও তারা এটি দূরের কোন বাজারে বিক্রি করে না। তাদের নিজেদের পরিধানের পাশাপাশি আশপাশের কোচরা যাদের তাঁত নেই তারাই কিনে নেয়। বাজারেও এটির মূল্য ৭ শত থেকে ৮ শত টাকা। তবে নিজের পরিধানের জন্য তৈরি করলে নিজের শ্রমটাই মজুরি হিসেবে থেকে যায়। কারণ, ৩০০ টাকা সুতোর পুঁজিতেই তাদের পরিধেয় বস্ত্র পেয়ে থাকেন। তবে স্থানীয় অন্যান্য কোচ নারীরা গ্রাম থেকে রাঙ্গাপাতি না পেলে তাদের প্রয়োজনেই বাজার থেকে একই দামে কিনে থাকে। কোচরা আধুনিকায়ন ও নানা প্রতিকূলতায় তাদের এই শত শত বছর ধরে সনাতনী বিলুপ্তপ্রায় তাঁত শিল্প। এ নিয়ে কারো কাছেই কোন অভিযোগ-অনুযোগ নেই। সরকারের কাছেও তারা কখনো সাহায্য সহযোগিতার কথা জানায়নি। বলতে গেলে সে রাস্তাটি তারা জানেনই না। তাই তো নিরবে-নিভৃতে গারো পাহাড়ের সবুজে ঘেরা উঁচু-নিচু টিলার ভাঁজে ভাঁজে তাদের সে স্বপ্নগুলো সাদা-কালোই রয়ে গেছে। একটা সময় হয়তো আসবে এ অঞ্চলের আদিবাসী সম্প্রদায় বা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী গারো, কোচ, হাজং, ডালু, বানাই, বর্মণদের অস্তিত্বই হয়তো হারিয়ে যাবে। তখন সেই শত শত বছরের ঐতিহ্যের খবর মিলবে কেবল ইতিহাসেই পাতায় আর জাদুঘরে। স্থানীয় কোচ নেতা ও অবসর প্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক পরিমল কোচ জানায়, আমাদের এ গ্রামের কোচরা রাস্তা-ঘাট, হাট-বাজার, শিক্ষা-স্বাস্থ্য থেকে শুরু করে সকল বিষয়েই পিছিয়ে আছে এবং অবহেলিত। ফলে দিন দিন আমাদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। জীবনের তাগিতে অন্যত্র পারি জমাচ্ছে। ফলে হারিয়েও যাচ্ছে আমাদেও অস্তিত্ব, ঐতিহ্য ও শিল্প। তাই এ বিষয়ে সরকারেরই উচিত এগিয়ে এসে আদিবাসী কোচদের বিলুপ্তপ্রায় তাঁত শিল্পটা বাঁচাতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া।