সবুজ পাহাড়, স্বচ্ছ নীলাকাশ ও নয়নাভিরাম কাপ্তাই হ্রদবেষ্ঠিত পাহাড়ি জেলা রাঙ্গামাটিতে প্রাণের উৎসব‘ বৈসাবি’কে ঘিরে আনন্দের জোয়ারে ভাসছে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়। পাহাড়ি জনপদের গ্রামগুলোতে এখন সাজ-সাজরব। পুরোনো বছরকে বিদায় আর নতুন বছরের বরণকে সামনে রেখে জেলা শহর ছাড়িয়ে প্রত্যন্ত পাহাড়ি গ্রামগুলোতে চলছে নানা প্রস্তুতি। হাটবাজারগুলোতে পড়েছে কেনাকাটার ধুম। চারিদিকে যেন উৎসব উৎসব ভাব।
বৈসাবি উৎসব সামনে রেখে হোটেল-মোটেলে আগাম বুকিং হয়ে গেছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, সরকারি উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা ও নৃ-গোষ্ঠী নেতারা পৃথক বার্তায় সুখ, সমৃদ্ধি কামনা করেছেন। শুধুমাত্র পার্বত্য অঞ্চলের এই উৎসবকে আরো রঙীন করে তুলতে সরকারের পক্ষ থেকে আজ থেকে ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত বিশেষ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। বর্ষ বিদায় ও বরণকে ঘিরে বৈসাবি হচ্ছে পাহাড়ের সবচেয়ে বড় উৎসব। ত্রিপুরা, মারমা, চামকাদের যথাক্রমে বৈসু, সাংাই, বিজু এই উৎসবের মিলিত রূপ হচ্ছে বৈসাবি। ফুল ভাসানোর মধ্যদিয়ে মূলত বিজুর আনুষ্ঠিকতা শুরু হয়। তিনদিনব্যাপী এই উৎসবের প্রথম দিনকে চাকমা ভাষায় ফুল বিজু, দ্বিতীয় দিনকে মূল বিজু এবং তৃতীয় দিনকে নুয়াবঝরবা গোজ্যা পোজ্যা দিন বলা হয়। এভাবেই ত্রিপুরারা প্রথম দিনকে হারিকুইসুক, দ্বিতীয় দিনকে বুইসুকমা এবং তৃতীয় দিনকে বিসিকাতাল নামে অভিহিত করে। বৈসাবি উৎসবকে ঘিরে তিন দিন পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামজুড়ে বিরাজ করে উৎসবের আমেজ। পাহাড়ের বাসিন্দারা মহাসমারোহে পালন করে তাদের সবচেয়ে বড় সামাজিক উৎসব বৈসাবি। উৎসবে পাহাড়ি-বাঙালির মিলনমেলা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বড় পরিচয় ফুটে উঠে।
বিজু : ফুল বিজু মূলত চাকমাদের উৎসব হলেও সবার অংশগ্রহণে তা সার্বজনীন রূপ নেয়। বাংলা ঋতু চৈত্র মাসের শেষ দিনে আয়োজন করা হয় ফুল বিজুর। বন থেকে সংগ্রহ করা বিজু ফুল ছাড়াও মাধবীলতা, অলকানন্দা, নিমপাতা, রঙ্গন, জবাসহ বাহারি ফুল কলাপাতায় করে নদীর জলে ভাসানো হয়। দেবী গঙ্গার উদ্দেশ্যে নদীর পাড়ে মোমবাতি জ্বালানো হয়। গ্রামগুলোর ঘরে ঘরে গৃহসজ্জার আয়োজন চলে। বাড়িতে বাড়িতে নানান পদেও বাহারি সবজি দিয়ে ঐতিহ্যবাহী সুস্বাদু পাঁচন রান্নার আয়োজন। এই সুস্বাদু পাঁচন ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সবার কাছে খুবই প্রিয়, খেতেও মজা।
বৈসুক : ত্রিপুরাদের ধর্মীয় এবং সামাজিক উৎসবের মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় এবং প্রধান উৎসব হলো বুইসুকবা বৈসুক। চৈত্র মাসের শেষের দুই দিন ও নববর্ষের প্রথম দিনসহ তিন দিন ধরে পালন করা হয় এই উৎসব। চৈত্র মাসের শেষ দুই দিনের প্রথম দিন টিকে ত্রিপুরারা হারিবুইসুক এবং শেষ দিনটিকে বুইসুকমা বলে। আর নববর্ষের প্রথম দিনকে তারা বলে বিসিকাতাল। বৈসুক শুরুদিন থেকে গেরুয়া নৃত্য দল গ্রামের গ্রামে গিয়ে প্রত্যেক ঘরের উঠোনে নৃত্য করে। এই আনন্দদায়ক ও চিত্তাকর্ষক নৃত্যকে ত্রিপুরারা গেরুয়া নৃত্য বা খেরেবানৃত্য বলে। সাংগ্রাই : মারমাদের অন্যতম সামাজিক উৎসব হলো সাংগ্রাই বা জল উৎসব। মারমারা সাধারণত মঘীসনের চান্দ্র্র মাস অনুসারে এই দিনটি পালন করে থাকে। বছরের শেষ দুই দিন এবং নববর্ষেও প্রথম দিন পালিত হয় এই উৎসব। সাংগ্রাই উৎসব এবং পানি খেলার সময় এক জায়গায় পানি ভর্তি রেখে যুবক যুবতীরা একে অপরের দিকে পানি ছুঁড়ে মারেন। স্নিগ্ধতায় ভিজিয়ে দেয় পরস্পরকে। প্রতি বছর রুটিন করে মারমা অধ্যুষিত এলাকায় এ জল উৎসব পালন করা হয়। এ বছর ১৬ এপ্রিল রাজস্থলী উপজেলার বাঙ্গালহালিয়া উচ্চবিদ্যালয় মাঠে অনুষ্ঠিত হবে জলউৎসব। এ উৎসবে হাজার হাজার পাহাড়ি-বাঙালি অংশ নিয়ে জলউৎসবে মেতে উঠেন। প্রসঙ্গত, ১৯৮৫ সাল থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত তিন সম্প্রদায়ের বিভিন্ন সংগঠনের সম্মিলিত উদ্যোগে ‘বৈসাবি’ নামে এ উসব পালন করে আসছে, যা সময়ের ব্যবধানে নিজ নিজ সম্প্রদায়ের লোকদের কাছে ‘বৈসাবি’ শব্দটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।