রেলের উদ্যোগ

সিন্ডিকেট ঠেকাতে বোঝা বাড়ল নিম্ন আয়ের মানুষের

প্রকাশ : ১২ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ফারুক আলম

ঈদুল ফিতরে ট্রেন যাত্রায় টিকিটে কালোবাজারি ও সিন্ডিকেট ঠেকাতে টিকিটের সিস্টেম শতভাগ অনলাইনভিত্তিক করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। ফলে একশ্রেণির মানুষের মাঝে স্বস্তি দেখা গেলেও নিম্ন আয়ের মানুষের মাথায় খরচের বোঝা বাড়ছে। ঢাকাসহ বিভিন্ন শহর থেকে ঘরমুখো নিম্ন আয়ের মানুষের যাত্রা নিরানন্দের সুর ধ্বনিত হচ্ছে। কারণ নিম্ন আয়ের অনেকের কাছে স্মার্টফোন নেই, কোনো কম্পিউটারের দোকানে টিকিট কাটতে গেলেও বাড়তি টাকা গুণতে হচ্ছে। আবার বেশিরভাগ সময়ে টিকিট মিলছে না। এতে বাধ্য হয়েই ট্রেনের তুলনায় বাসে দ্বিগুণ ভাড়া দিয়ে নাড়ির টানে বাড়ি ফিরতে হবে মানুষকে।

এ বিষয়ে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের ম্যানেজার মোহাম্মদ মাসুদ সারওয়ার আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, ট্রেনের টিকিট শতভাগ অনলাইনভিত্তিক করা হয়েছে। এখানে কারা নিম্ন-মধ্য ও উচ্চবিত্ত সেটি দেখার সুযোগ নেই। অনলাইনে টিকিট প্রাপ্তি সবার জন্য সমান। তবে টিকিট পেতে সার্ভারে যে সমস্যা দেখা যাচ্ছে, সেটি হিট বেশি হওয়ায়। একসঙ্গে কোটি মানুষ সার্ভারে ক্লিক করলে সেখানে কেউ টিকিট পাবেন আবার কেউ টিকিট পাবেন না সেটিই স্বাভাবিক।

তিনি আরো বলেন, নিম্ন আয়ের যেসব মানুষ অনলাইনে টিকিট কাটতে পারবেন না, তাদের জন্য লোকাল ট্রেন আছে। যখন লোকাল ট্রেন ছাড়বে ঠিক এর আগমুহূর্তে স্টেশন থেকে টিকিট কাটতে পারবেন।

জানা গেছে, ঈদ যাত্রায় বাসগুলো ট্রেনের চেয়ে দ্বিগুণের কাছাকাছি ভাড়া বেশি নেয়। ঢাকা থেকে দূরপাল্লার বাসে গাইবান্ধার ভাড়া প্রায় ৯০০ টাকার কাছাকাছি। ঢাকা থেকে গাইবান্ধায় ট্রেনের ভাড়া সাড়ে ৪০০ টাকা। একই অবস্থা রাজশাহী, খুলনা ও বরিশালসহ বিভিন্ন এলাকার বাসের ভাড়া। বাসের চেয়ে ট্রেনের ভাড়া কম এবং যানজটমুক্ত হওয়ায় অধিকাংশ মানুষ ট্রেনে চলাচলে বেশি পছন্দ করে।

যাত্রীরা বলছেন, বাসের চেয়ে ট্রেনের টিকিট বেশি কাটছে। কারণ যেখানে বাসের ভাড়া ১ হাজার টাকা সেখানে ট্রেন ভাড়া মাত্র ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা। আবার ট্রেনে কোনো যানজটও নেই।

সারা দেশে ঈদ যাত্রায় নিম্ন-মধ্যম আয়ের মানুষের কাছে যানজটমুক্ত ও নিরাপদ বাহন হিসেবে পছন্দের তালিকায় রয়েছে ট্রেন। তবে গত কয়েক বছর ট্রেনের টিকিট পেতে কমলাপুরসহ বিভিন্ন রেলস্টেশনে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়াতে হয়েছিল টিকিট প্রত্যাশীদের। এতে ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে মানুষকে। তবে এবার লাইনে দাঁড়িয়ে ভোগান্তিতে পড়তে না হলেও অনলাইন ভোগান্তিতে পড়ছেন টিকিট প্রত্যাশীরা।

নীলফামারীর মানিক মিয়া গত পাঁচ বছর ধরে কমলাপুর রেলস্টেশনের আশপাশেই রিকশা চালান। তিনি এর আগে কমলাপুর স্টেশনে লাইনে দাঁড়িয়ে ঈদের টিকিট কেটেছেন, এবার অনলাইনে টিকিট কাটতে গিয়ে বিরম্বনার শিকার হয়েছেন। মানিক মিয়া বলেন, গত দুই দিন ধরে অনলাইনে টিকিট কাটার চেষ্টা করছি কিন্তু কোনো লাভ হচ্ছে না।

বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক মন্দায় গত কয়েক মাসে জীবনযাপনের খরচ বাড়তে থাকায় সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। পরিবারের ব্যয় মেটাতে গিয়ে নিম্ন আয়ের মানুষ কমবেশি হাঁপিয়ে উঠছেন। এরমধ্যেই নিম্ন আয়ের মানুষের গ্রামে ফেরার জন্য ট্রেনের টিকিট না পেলে বাসে বাড়তি ভাড়া গুণতে হবে।

তবে অনলাইন সিস্টেম সম্পর্কে পূর্ণ ধারণা না থাকায় টিকিট পাওয়া নিয়ে তৈরি হয়েছে সংশয়। লালমনিরহাট থেকে রিকশা চালাতে রাজধানীতে এসেছেন আক্তার হোসেন। তিনি বলেন, টিকিট পেতে অনলাইনে কোথায়? কীভাবে? দরখাস্ত করতে হয় তা জানি না। ভোটার আইডি কার্ডের ফটোকপি লাগবে, বিভিন্ন ঝামেলা। আমরা তো লেখাপড়া জানি না। আরেকজন বলেন, যারা সাধারণ মানুষ, প্রত্যন্ত অঞ্চলের তাদের কাছে অনলাইনে রেলের টিকিট প্রাপ্তি কঠিন। অনলাইন টিকিট পদ্ধতি চালু করায় আমরা যারা নিম্ন আয়ের মানুষ অনলাইনে টিকিট কাটতে পারব না, তাদের বাধ্য হয়েই বেশি ভাড়া দিয়ে বাসে চড়ে গ্রামে যেতে হবে। সিন্ডিকেট দূর করতে গিয়ে, এখন গরিবের ঈদযাত্রায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

দেশের সব মানুষের কাছে অনলাইন সিস্টেমের প্রযুক্তি পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। এতে সব ধরনের মানুষ টিকিট কাটতে পারবে না। তাহলে কেন একশ্রেণির মানুষকে টিকিট প্রাপ্তি থেকে বঞ্ছিত করা হচ্ছে।

অনলাইনে ট্রেনের অগ্রিম টিকিট বিক্রির বিড়ম্বনার শিকার হয়েছেন যাত্রীরা। ট্রেনের টিকিট-প্রত্যাশীরা রেলওয়ের টিকিট বিক্রির সার্ভার জটিলতায় পড়ছেন। ফলে দীর্ঘ সময় চেষ্টা করেও অনেকে টিকিট সংগ্রহ করতে পারেননি।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেক যাত্রী লিখেছেন, সার্ভার জটিলতায় অনেকে রেলসেবা অ্যাপে প্রবেশ করতে পারেননি। অনেকে অ্যাপে প্রবেশ করতে পারলেও টিকিট বুকিং অপশনে ক্লিক করার পর দীর্ঘক্ষণ আটকে থেকেছে।

পরবর্তী ধাপে সিলেক্ট হলেও টিকিট সংগ্রহ করা যায়নি। সার্ভার জটিলতার কথা স্বীকার করে সহজ ডটকমের ভাইস প্রেসিডেন্ট জুবায়ের আহমেদ আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, গতকাল মঙ্গলবার সকাল ৮টা থেকে সাড়ে ৮টা পর্যন্ত প্রায় ১ কোটি ৪০ লাখ মানুষ সার্ভারে হিট করেছেন। বিকাল ৫টা পর্যন্ত গতকাল ৩ কোটি সার্ভারে হিট হয়েছে। ঈদের সময়ে সার্ভারে লোড পড়েছে। তবে সার্ভার ডাউন হয়নি, স্লো হয়।

জুবায়ের আহমেদ আরো বলেন, প্রতিদিন ঢাকা থেকে বিভিন্ন গন্তব্য যাওয়ার জন্য ২৮ হাজার টিকিট সহজের মাধ্যমে বিক্রি হচ্ছে। আর সারা দেশে ১ লাখ ১০ হাজারের কাছাকাছি ই-টিকিটিং বিক্রি করা হয়। রাজশাহী, খুলনা, রংপুর, কুড়িগ্রাম, পঞ্চগড়সহ উত্তরা রেল টিকিটের চাহিদা অনেক বেশি। শুরুর দিকেই ওইসব অঞ্চলের টিকিট শেষ হয়ে যায়।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ট্রেনের টিকিট নিয়ে বিভিন্ন ধরনের মন্তব্য করছেন অনেকে। নাজমুল সাকিব নামে আরেকজন বলেন, রংপুরের টিকিট কাটার জন্য সকাল থেকে চেষ্টা করছি। কিন্তু পারছি না। পেমেন্ট অপশনে যাওয়ার পর ঘুরতে থাকে। এমডি জাভেদ নামে একজন ফেইসবুকে লেখেন, গত দুই ঘণ্টা ধরে সার্ভারের এই অবস্থা। লগইন করা যাচ্ছে না। কিন্তু টিকিট সেল হয়ে যাচ্ছে।

আবদুর রাজ্জাক সরকার নামে এক ব্যক্তি তার ফেইসবুক পোস্টে লেখেন, ট্রেনের টিকিট কাটার জন্য সকাল সাড়ে ৭টায় ঘুম থেকে উঠে কম্পিউটার, আমার মোবাইল ও বউয়ের মোবাইল, তিনটা ডিভাইস নিয়ে যুদ্ধে নামলাম। ৮টায় লগ ইন করেই হতাশ, কুড়িগ্রামের জন্য স্নিগ্ধার টিকিট দেখায় মাত্র ১০টা।

বুকিং অপশনে ২টা বুকিং করতে পারলেও পারচেজ অপশন থেকে আর লোড নিচ্ছে না। এক ঘণ্টা ধরে এই পারচেজ অপশনেই আটকে আছি। হে রেল কর্তৃপক্ষ পারচেজ অপশন পার হতে আমাকে কি ইফতারি পর্যন্ত কম্পিউটারের সামনে বসে থাকতে হবে? বলা হচ্ছে অনলাইনে শতভাগ টিকিট কিন্তু ৮টায় লগইন করে বেশিরভাগ টিকিট গায়েব। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে টিকিট উধাও কীভাবে? মিলি সেকেন্ডের মধ্যে ট্রেনের টিকিট কাটার ফার্মগেটে কোনো কোচিং থাকলে জানাবেন, ভর্তি হতে চাই।

রেলের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিচালন) সরদার শাহাদাত আলী বলেন, প্রযুক্তিগত সমস্যা যা হয়েছে সেটা সঙ্গে সঙ্গে ঠিক করা হয়েছে। চাপ বেশি থাকায় কিছু সমস্যা হতে পারে। তবে এটা আহামরি কিছু না। নিয়মিত টিকিট নিতে সমস্যা হয়নি। বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক (ডিজি) মো. কামরুল আহসানের কাছে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।