ঢাকা ০৪ অক্টোবর ২০২৪, ২০ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

রাবি ফার্মেসি বিভাগের গবেষণা

তুঁত গাছে মিলবে কঠিন রোগের প্রতিষেধক

তুঁত গাছে মিলবে কঠিন রোগের প্রতিষেধক

রাজশাহীতে খুব সাধারণ একটি গাছের গবেষণায় আশ্চর্যজনক কঠিন রোগের প্রতিষেধকের সন্ধান পাওয়া গেছে। তুঁত গাছের পাতা, ফল, বাকল এমনকি মূল সবই ঔষধি গুণসম্পন্ন যা গবেষণায় উঠে এসেছে। ক্যান্সার, হৃদরোগ, ডায়াবেটিকস, কিডনি রোগ প্রতিরোধকসহ বিভিন্ন রোগের নিরাময় হিসেবে কাজ করে তুঁত ফল। এ সুযোগ কাজে লাগানো গেলে খাদ্য ও ওষুধ শিল্পে বিপুল সম্ভাবনাময় বহুমুখী এ উদ্ভিদে পাল্টে যেতে পারে উত্তরাঞ্চলের অর্থনীতি। ২০১০ সাল থেকে একদল গবেষককে সঙ্গে নিয়ে তুঁতের ক্যান্সার প্রতিরোধী ভূমিকা নিয়ে গবেষণা করে আসছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ফার্মেসি বিভাগের অধ্যাপক ড. এএইচএম খুরশীদ আলম। তিনি বলেন, রেশম পোকার পুরো জীবনচক্র আবর্তিত হয় তুঁত পাতায়। এর কারণ খুঁজতে গিয়েই পাতাটির অবাক করা পুষ্টিগুণ পাই। একটা পর্যায়ে তুঁত ফল, বাকল ও মূল নিয়েও আলাদাভাবে গবেষণা করি। সব অংশেই কম-বেশি প্রায় একই পুষ্টিগুণ পাওয়া যায়। ২০১৩ সালের ১৯ জানুয়ারি এ গবেষণাপত্র প্রকাশ করে যুক্তরাজ্যভিত্তিক বিজ্ঞান সাময়িকী বায়োমেড সেন্ট্রাল রিসার্চ নোট। পরে আরেকটি গবেষণা নিয়ে ২০১৬ সালের ৯ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিজ্ঞান সাময়িকী ‘পোলস ওয়ান’- এ গবেষণাপত্র প্রকাশ পায়। এর জন্য ওই বছর বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন স্বর্ণপদকও পাই।

এ গবেষক আরো বলেন, তুঁত ফলের ৮৫ শতাংশই পানি। এছাড়া ও কার্বোহাইড্রেট, ২ শতাংশ ফাইবার, ১ দশমিক ৫ শতাংশ প্রোটিন ও দশমিক ৫ শতাংশ চর্বি বিদ্যমান। প্রতি কাপ অর্থাৎ ১৫০ গ্রাম তুঁত ফলে শক্তি থাকে মাত্র ৬০ কিলোক্যালরি। ভিটামিন-সি থাকে ৩০ দশমিক ২ মিলিগ্রাম। এছাড়া ভিটামিন এ ও বি, আয়রন, ক্যালসিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ ও পটাশিয়ামও আছে। কিশমিশের মতো শুকিয়ে তুঁত সংরক্ষণ করা যায়। এতে প্রোটিনের মাত্রা বাড়ে। শুকনো তুঁত ফলে ২ শতাংশ কার্বোহাইড্রেট, ১৪ শতাংশ ফাইবার, ১২ শতাংশ প্রোটিন ও ৩ শতাংশ চর্বি রয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, সতেজ একটি তুঁত পাতায় ৪.৭২-৯.৯৬ শতাংশ অপরিশোধিত প্রোটিন, ৮.১৫-১১.৩২ শতাংশ ফাইবার, ৪.২৬-৫.৩২ শতাংশ অ্যাশ, ০.৬৪-১.৫১ শতাংশ অপরিশোধিত চর্বি ও ৮.০১-১৩.৪২ শতাংশ কার্বোহাইড্রেট থাকে। এছাড়া প্রতি ১০০ গ্রাম তাজা তুঁত পাতায় ১৬০ থেকে ২৮০ মিলিগ্রাম অ্যাসকরবিক অ্যাসিড ও বিটা ক্যারোটিন, ৪.৭০-১০.৩৬ মিলিগ্রাম খনিজ লৌহ, ০.২২-১.১২ মিলিগ্রাম দস্তা, ৩৮০ থেকে ৭৮৬ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম এবং ১১৩ থেকে ২২৪ কিলোক্যালরি শক্তি বিদ্যমান। পাতা এবং ফলের মতো তুঁত গাছের বাকল এমনকি মূলেও যথেষ্ট পুষ্টি উপাদান পাওয়া যায়। ড. এএইচএম খুরশীদ আলম বলেন, মূলত তুঁত পাতা অ্যান্টি-থাইরোসিনেস, অ্যান্টি-ডায়াবেটিক, অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট এবং অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি। তুঁত ফল অ্যান্টি-ক্যান্সার, অ্যান্টি-ডায়াবেটিক, অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট এবং অ্যান্টি-নিউরোডিজেনারেটিভ। তুঁত গাছের বাকল, অ্যান্টি-মাইক্রোবিয়াল এবং অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি। এছাড়া মূল অ্যান্টিহাইপারলেপিডেমিয়া এবং কার্ডিওভাসকুলার ট্রাবল রিলিভার।

তিনি যোগ করেন, বিশ্বজুড়ে সবচেয়ে প্রাণঘাতি ব্যাধি ক্যান্সার। কিন্তু ক্যান্সার চিকিৎসায় সফল ও নিরাপদ ওষুধ খুবই কম। তুঁত পাতা, ফল এবং মূল ক্যান্সার প্রতিরোধী। এর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট দেহের ফ্রি র‌্যাডিক্যালগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষার কাজ করে। এর ফলে ক্যান্সার প্রতিরোধ হয়।

এ গবেষক বলছেন, এখনকার সময়ে অন্যতম সমস্যা স্থূলতা। এটি ক্যান্সার, ডায়াবেটিকস, হৃদরোগসহ নানা রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। খাবারের আগে তুঁত পাতার নির্যাস খেলে কোলেস্টরেলের মাত্রা কমে আসে। এতে শরীরের অস্বাভাবিক চর্বি কমে যায়। তুঁত ফলের রস কিংবা পাতার নির্যাসে জৈব যৌগ ১-ডি অক্সিনোজিরিমাইসিন বিদ্যমান। এটি রক্তের শর্করার মাত্রা কমিয়ে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে আনে। একই সঙ্গ অগ্ন্যাশয় এবং কিডনির জটিলতা ঠেকায়। তিনি বলেন, তুঁতে জেক্সানথিন বিদ্যমান। এটি চোখের রেটিনাকে ক্ষতি থেকে বাঁচায়। আবার চোখে ছানিপড়াও আটকে দেয়। তুঁত ফলে থাকা ক্যালসিয়াম হাড়ের স্বাস্থ্য ভালো রাখে। তুঁতে ডায়েটরি ফাইবার বিদ্যমান। এটি হজম তরান্বিত করে কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। তুঁতে উপস্থিত অ্যালকালয়েডগুলো দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। তুঁত গাছে গুরুত্বপূর্ণ ফ্ল্যাভনয়েড রেসভেরট্রোল পাওয়া যায়। যা স্ট্রোক ও হার্টঅ্যাটাকের ঝুঁকি কমায়। এছাড়া তুঁত ফল এবং পাতার নির্যাস স্ট্রেস প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। এর ছালে অ্যান্টিভাইরাল এবং অ্যান্টিফাঙ্গাল রোগের চিকিৎসায় ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখায়। ব্রণের বৃদ্ধি রোধ করে। তুঁত স্নায়ু-অবক্ষয় বিলম্ব করতে পারে। এটি লিভার সুস্থ রাখে। তুঁত ত্বক ও চুলকে স্বাস্থ্যকর এবং চকচকে চেহারা প্রদান করে। তুঁতকে অন্যান্য ঠান্ডা, ফ্লু-এর মতো সমস্যাগুলোর চিকিৎসার জন্যও ব্যবহার হয় বলে জানা যায়। মূলত উত্তরাঞ্চল, বিশেষ করে রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ তুঁত চাষের জন্য প্রসিদ্ধ। দেশের পূর্বাঞ্চল ও পাহাড়ি অঞ্চলেও তুঁত চাষ হয়। সাধারণত ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে তুঁত গাছে ফুল আসে। ফল পাকে মার্চণ্ডএপ্রিলে। দেশে উৎপাদিত তুঁত ফল বেশি সুস্বাদু। পাকা এবং অপরিপক্ব তুঁত ফল চাটনি তৈরির জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় ছয় মাস থেকে এক বছরের জন্য হিমাগারে সংরক্ষণ করে ব্যবহার করা যায়। তুঁতের কচি পাতা সবজি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আবার শুকনো পাতার গুঁড়া উষ্ণ গরম পানিতে ভিজিয়ে চায়ের মতো করে পান করা যেতে পারে। তুঁত ফলের নির্যাস দইয়ের রঙের জন্য ব্যবহৃত হয়। এই নির্যাস ব্যবহার করা যেতে পারে পেস্ট্রি উৎপাদনেও। নানাবিধ রোগ প্রতিষেধক বিভিন্ন উপকরণের ব্যবহার্য এই তুঁত ফল এর গুণাগুণ জেনে এখন খাবারের প্রতি আগ্রহ বেড়েছে। ভদ্রা মোড়ের ফল ব্যবসায়ী ওয়াসিম জানান এটা কখনো আগে ফলের দোকানে বিক্রি হয়নি এই প্রথম বেশ ভালো দামে বিক্রি হচ্ছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত