অরক্ষিত নাইক্ষ্যংছড়ি-কক্সবাজার সীমান্ত
চোরাই পথে আসছে মিয়ানমারের গরু
প্রকাশ : ১৩ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
এএইচ সেলিম উল্লাহ, কক্সবাজার
ঈদুল ফিতরকে টার্গেট করে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি ও কক্সবাজারের রামু সীমান্ত দিয়ে চোরাই পথে ঝাঁকে ঝাঁকে গরু আনছে একটি সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট। টেকনাফ উপজেলার শাহপরীরদ্বীপ করিডোর কয়েক বছর ধরে বন্ধ থাকার সুযোগকে ব্যবহার করে পাচারকারী চক্রের সদস্যরা এই তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। এতে চোরাই পথে আসা মিয়ানমারের গরুতে সয়লাব হয়ে গেছে নাইক্ষ্যংছড়ি ও রামু উপজেলার প্রত্যন্ত জনপদ। গরু নিয়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বিজিবির সঙ্গে চোরাকারবারিদের সংঘর্ষে প্রাণহানিসহ নানা অপ্রীতিকর ঘটনার কারণে এ দুটি উপজেলায় বিরাজ করছে চরম উদ্বেগ-উৎকন্ঠা।
সীমান্তের লোকজন জানিয়েছেন, নাইক্ষ্যংছড়িতে মিয়ানমার সীমান্তের বেশ কয়েকটি পয়েন্ট দিয়ে নির্বিঘ্নে এদেশে পাচার হচ্ছে দলে দলে গরু। কখনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে, কখনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনী-জনপ্রতিনিধিদের ম্যানেজ করে এবং এলাকার বখাটে-সন্ত্রাসী লোকজনকে দিয়ে প্রভাব খাটিয়ে বানের পানির মতো পাচার করা হচ্ছে গরু।
বিজিবি ও পুলিশের তথ্য বলছে, গরু আনতে গিয়ে প্রতিনিয়ত সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবিসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে চোরাকারবারিদের মধ্যে সংঘর্ষ, গোলাগুলিসহ অপ্রীতিকর ঘটনা সংঘটিত হচ্ছে। পাচারকালে গরু জব্দ করার জেরে বিজিবির সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে পাচারকারীরা। এতে ঘটছে প্রাণহানির ঘটনাও। আবার জব্দ করা গরু ফেরত নিতে বিজিবি ক্যাম্পে হামলাও চালিয়েছে চোরাকারবারিরা। অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী চক্র বিভিন্ন স্থানে গরু লুটের ঘটনাও সংঘটিত করছে। গরু নিয়ে সংঘর্ষের ঘটনায় আহত হয়েছেন বিজিবির অনেক সদস্যও। সর্বশেষ গত ৮ এপ্রিল রাতে রামু উপজেলার কাউয়ারখোপ ইউনিয়নের পূর্ব কাউয়ারখোপ এলাকায় মিয়ানমার থেকে পাচার হয়ে আসা গরুর চালান জব্দ করে বিজিবি সদস্যরা। এসময় পাচারকারিরা জব্দ করা গরুগুলো ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা চালায়। এক পর্যায়ে তারা বিজিবির সদস্যদের লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। তখন আত্মরক্ষার্থে বিজিবির সদস্যরা ফাঁকা গুলি ছুড়লে ঘটনাস্থলে প্রাণ হারান আব্দুল জব্বার (৪০) নামের এক দোকান কর্মচারী। এ ঘটনায় বিজিবির ৪ সদস্য, নারীসহ স্থানীয় একাধিক গ্রামবাসী আহত হন। এ ঘটনায় নিহত আবদুল জব্বার রামুর কাউয়ারখোপ ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের পূর্ব কাউয়ারখোপ এলাকার মৃত জাকের আহমদের ছেলে। এ ঘটনায় ২৫০ জনকে আসামি করে পৃথক ২টি মামলাও করেছে বিজিবি। এর আগে গত ১ এপ্রিল জব্দ করা গরু ফেরত নিতে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের বাইশফাঁড়ি বিজিবি ক্যাম্পে হামলা চালায় চোরাকারবারিরা। ওই হামলায় আহত হন বিজিবির সদস্য হাবিলদার চম্বক কুমার পাল, নায়েক মুশফিকুর রহমান ও নায়েক মো. হাছান। ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ৪ জনকে আটক করা হয়েছে। তারা হলেন সুমন তঞ্চ্যঙ্গা (২৮), চুতিঅং তঞ্চ্যঙ্গা (৩৬) রৈশমং তঞ্চ্যঙ্গা (৬০) ও আনতুমং তঞ্চ্যঙ্গা (৪০)। এর আগে গত ২৯ মার্চ রামু উপজেলার কচ্ছপিয়ায় গুলি ছোড়ে আতংক সৃষ্টি করে এবং দুইজন গরু ব্যবসায়িকে দা দিয়ে কুপিয়ে মিয়ানমারের ৯টি গরু ছিনতাই করে স্থানীয় কিছু বখাটে।
এলাকাবাসী জানিয়েছেন, ওইদিন রাতে চোরাকারবারি জসিম, আবুল কালাম ও কালু গং নাইক্ষ্যছড়ি সীমান্তের ৪৬-৪৭ পিলার থেকে বার্মিজ ২৪টি গরু নিয়ে আসে কচ্ছপিয়া ইউনিয়নের বালুবাসা গ্রামে। সেখান থেকে এসব গরু শুকমুনিয়া-দৌছড়ি ও কচ্ছপিয়া গ্রামের টেকপাড়া হয়ে মাঝির কাটা পার করছিল পাচারকারীরা। পথিমধ্যে জনৈক রাসেল বাহিনীর ১৩/১৪ জন সদস্য এসে গরুগুলো লুট করতে বিস্ফোরকদ্রব্য ফোটায়। এতে এলাকাবাসী ও নামাজরত মুসল্লিরা ভয়ে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েন। এ ঘটনায় বখাটেরা ৯টি গরু লুট করে পালিয়ে যায়। পরে দায়ের কোপে আহত মাহবুবুর রহমান নামের এক যুবককে এলাকাবাসী মুমূর্ষু অবস্থায় কক্সবাজার সদর হাসপাতালে নিয়ে যায়। তার অবস্থা সংকটাপন্ন বলে জানিয়েছেন হাসপাতালের আবাসিক মেডিক্যাল কর্মকর্তা (আরএমও) ডা. আশেকুর রহমান।
এদিকে, মিয়ানমার থেকে আসা চোরাই গরু মজুত করতে রামু উপজেলার কচ্ছপিয়া, গর্জনিয়া এবং নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার অসংখ্য বাড়িতে এখন গড়ে তোলা হয়েছে অস্থায়ী খামার। মূলত খামারি সেজে এসব বাড়িতে মিয়ানমারের চোরাই গরু মজুত করেন। আর এসব গরু বিক্রির কৌশলে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ থেকে গরুর প্রত্যায়ন পত্র সংগ্রহ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সম্প্রতি ব্যাপক আলোচনা হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পাওয়া তথ্য নিয়ে স্থানীয়দের সাথে আলাপ করে জানা যায়, গত ৩ এপ্রিল কক্সবাজারের রামু উপজেলার কচ্ছপিয়া ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের দোছড়ি এলাকার বাসিন্দা মো. মুছাদেক এর ছেলে নেছার উদ্দিনকে স্থানীয় ইউপি প্যানেল চেয়ারম্যান ছালেহ আহমদ ও ইউপি সদস্য মো. আবু আইয়ুব আনছারী স্বাক্ষরিত ‘গরুর’ একটি প্রত্যয়নপত্র দেন। এতে গরুটির গায়ের লাল রঙ এবং শিংয়ের দৈর্ঘ্য ৪ ইঞ্চি উল্লেখ করা হয়। আর নিজ বাড়িতে নেছার উদ্দিনের দীর্ঘদিনের পালিত গরুটি টাকার বিশেষ প্রয়োজনে স্থানীয় গর্জনিয়া বাজারে বিক্রি করবে বলে তথ্য উল্লেখ করা হয় প্রত্যয়নপত্রে। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ টাকা নিয়ে এমন প্রত্যয়নপত্র দেয়ার তথ্যও মিলেছে অনুসন্ধানে। রামু উপজেলা ডেইরি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা মোজাফ্ফর আহমদ জানান, সীমান্ত অরক্ষিত থাকার কারণেই মূলত প্রতিদিন শত শত গরু মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে নাইক্ষ্যংছড়ি-রামু হয়ে এদেশে পাচার হচ্ছে।
সীমান্ত এভাবে অরক্ষিত হলে যে কোনো অঘটনও সংঘটিত হতে পারে। যা উদ্বেগজনক। তিনি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে মিয়ানমারের গরু বানের পানির মতো এদেশে আসছে। এর ফলে দেশীয় খামারি ও প্রান্তিক গরু মালিকরা নিঃস্ব হয়ে পড়েছে। আগামী ঈদে গরু বিক্রি করে স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন এখন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। অনেকে এখন পুঁজি হারানোর পথে। এভাবে চলতে থাকলে দেশে গরু লালন-পালন সবাই ছেড়ে দেবে। বিজিবি সেক্টর কমান্ডার (রামু) কর্নেল মো. মেহেদী হোছাইন কবির বলেন, সীমান্তে অন্যান্য চোরাচালানের পাশাপাশি গবাদি পশু চোরাচালান বৃদ্ধি পেয়েছে। বিভিন্ন স্তরের লোকজন এ কাজে জড়িয়ে পড়েছে। বিশেষ করে এ কাজে যারা জড়িত তাদের পাশাপাশি গড় ফাদারদেরও আইনের আওতায় আনা হবে। গত কয়েক মাসে সীমান্তরক্ষীরা দেড় হাজার গবাদি পশু জব্দ করে সীমান্তের এ পয়েন্টে। যা পাচারের ১০ ভাগ মাত্র। বাকিগুলো পাচার হয়ে গেছে। অথচ সরকার চাচ্ছে প্রাণিসম্পদ বাড়াতে। চোরাচালান বন্ধে তিনি জনপ্রতিনিধি, সমাজকর্মী, সরকারি-বেসরকারি সকলের সহায়তা কামনা করেন। ওই সভায় নাইক্ষ্যংছড়ি ১১ বিজিবি অধিনায়ক লে. কর্নেল মো. রেজাউল করিম বলেন, সীমান্তে গরু চোরাচালান বন্ধে বিজিবি সজাগ রয়েছে। এজন্য বিজিবি সদস্যরা দিন-রাত কাজ করে যাচ্ছে। রামু থানার ওসি আনোয়ারুল হোসাইন জানান, মিয়ানমার থেকে সাম্প্রতিক সময়ে চোরাই পথে গরু আসছে। পুলিশ নিয়মিত অভিযান চালিয়ে গরু আটক করছে। গরু পাচারে জড়িতদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।