গত ৮ এপ্রিল তাইওয়ান ঘিরে আবারও চক্কর দিয়েছে চীনের একঝাঁক যুদ্ধজাহাজ, হামলার মহড়া চালিয়েছে তাদের যুদ্ধবিমানগুলো। দ্বীপটি নিয়ে এশিয়া এমন এক সংঘাতের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে, যা আমেরিকাকেও টেনে আনতে পারে এবং এ অঞ্চলে এমন এক যুদ্ধ শুরু হতে পারে যার প্রভাব হবে ইউরোপে চলমান যুদ্ধের চেয়েও সুদূরপ্রসারী। এটি পরাশক্তিগুলোর মধ্যে একটি উত্তেজনাপূর্ণ মুহূর্ত, যখন ট্রান্সআটলান্টিক মিত্রদের মুখ থেকে উচ্চারিত কূটনৈতিক শব্দগুলো সর্বোচ্চ সতর্কতার সঙ্গে বাছাই করা উচিত।
অথচ এমন পরিস্থিতিতেই কি না ইউরোপের অন্যতম অভিজ্ঞ নেতা এমান্যুয়েল ম্যাক্রোঁ ঘোষণা দিলেন, ‘অন্যের সংকটে জড়িয়ে পড়া তাদের কাজ নয়’। ‘কৌশলগত স্বায়ত্তশাসনের’ নামে তিনি বলেছেন, তাইওয়ানের মতো সংকটে ইউরোপকে আমেরিকার ‘অনুসারী’ হওয়া উচিত নয়। এগুলো বলে ফরাসি প্রেসিডেন্ট যেদিন চীন ছাড়েন, সেদিনই তাইওয়ান ঘিরে সামরিক মহড়া শুরু করে বেইজিং।
সাংবাদিকদের সামনে ম্যাক্রোঁর এই মন্তব্য অসহযোগিতার চেয়েও খারাপ ছিল। কথাগুলো কূটনৈতিকভাবে বিপজ্জনক ও ধারণাগতভাবে ছিল ভুল। যদিও তিনি পরে ইউরোপে পৌঁছে বক্তব্য সংশোধন করেছেন, কিন্তু ততক্ষণে ক্ষতি যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। এতে ম্যাক্রোঁ যেমন তার বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছেন, তেমনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পশ্চিমের ঐক্য।
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের বেইজিং সফরে যাওয়া ভুল ছিল না। ইউরোপের জন্য চীনের বিষয়ে নিজস্ব নীতি পরিচালনাও যুক্তিসংগত, যদিও তাদের নির্দিষ্ট বার্তায় একমত হওয়াটা কঠিন। ২০১৯ সালে এ সংক্রান্ত কৌশলগত ঝুঁকির বিষয়ে সতর্ক করেছিলেন কিছু ইউরোপীয় নেতা। কর্তৃত্ববাদী চীন যে বিপদ ডেকে আনছে, সে বিষয়ে অবগত ছিলেন ম্যাক্রোঁও। তা সত্ত্বেও চীন সফরে গিয়ে তিনি দুটি ফাঁদে পা দিয়েছেন। চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং অবশ্যই এতে আনন্দিত।
ফরাসি প্রেসিডেন্টের প্রথম ভুল ইউরোপীয়দের বিভক্ত করা এবং আমেরিকার সঙ্গে দূরত্ব তৈরির ক্ষেত্রে চীনের উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে আরও এগিয়ে নেয়া। সাম্প্রতিক সফর এ দুটিতেই অবদান রেখেছে। তিনি ইউরোপীয় ঐক্য প্রদর্শনের আশা করেছিলেন। চীনাদের কাছে জোর দিয়েছিলেন, তার সঙ্গে ইউরোপীয় কমিশনের (ইসি) প্রধান উরসুলা ভন ডার লিয়েনকে আনবেন। কিন্তু সেই বিশ্বাস চীনা প্রটোকলের ভারে ভেঙে পড়ে। ম্যাক্রোঁ আশা করেছিলেন জিনপিং ও ভন ডার লিয়েনকে নিয়ে একসঙ্গে কয়েক ঘণ্টা সময় কাটাবেন। কিন্তু কঠোর বক্তৃতা দিয়ে চীনে পৌঁছানো ইসি প্রেসিডেন্ট তাদের পাশে সময় পান মাত্র ঘণ্টাখানেক।
ম্যাক্রোঁর মন্তব্য তাদের বিস্তৃত প্রভাব পরিমাপ করতে উদ্বেগজনক ব্যর্থতাকে প্রতিফলিত করেছে। এমন একটি উত্তেজনাপূর্ণ সময়ে যখন উদার গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর সমন্বিত শক্তি প্রদর্শনের প্রয়োজন, সেখানে তিনি একজন কর্তৃত্ববাদী শাসকের সঙ্গে দেখা করে ঘোষণা দিয়েছেন, এ ধরনের সংকটে ইউরোপের যুক্তরাষ্ট্রের দেখানো পথ অনুসরণ করা উচিত নয়।
ম্যাক্রোঁর দ্বিতীয় ভুল তাইওয়ানের প্রতি সমর্থন কমানো। শুধু কূটনীতি যুদ্ধের ঝুঁকি কমাতে পারবে না। এর জন্য সংঘাত উসকে না দিয়ে পশ্চিমাদের প্রতিরোধ ব্যবস্থাকেও জোরদার করতে হবে। এ জাতীয় প্রচেষ্টায় অন্য ইউরোপীয় শক্তিগুলোর তুলনায় বেশি অবদান রাখতে পারে ইন্দো-প্যাসিফিকে সামরিক ঘাঁটি থাকা ফ্রান্স।
এ সপ্তাহে চীনের মহড়া চলাকালে তাইওয়ান প্রণালী দিয়ে একটি ফরাসি ফ্রিগেট যাত্রা করেছিল, যা প্রশংসার দাবিদার। তবে যা হতে পারতো মিত্রদের ঐক্য ও সংকল্পের প্রদর্শন, তাইওয়ান ইউরোপের সমস্যা নয়- ম্যাক্রোঁর এই বক্তব্যে তা নিশ্চিতভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে।
তাইওয়ানের ভবিষ্যৎ ইউরোপের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যদি কোনো ইউরোপীয় দেশ যুদ্ধ করতে না চায় বা চীন আক্রমণ করলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে অনিচ্ছুক হয়, তবে তা মিত্রদের মধ্যে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে আলোচনা হওয়া উচিত, উন্মুক্ত ভাষণে নয়। অধিকন্তু, আমেরিকা থেকে ইউরোপীয় স্বায়ত্তশাসনের ওপর জোর দিয়ে ফরসি প্রেসিডেন্ট সেসব মার্কিনিদের জীবন কঠিন করে তুলেছেন, যারা ইউক্রেনকে সহায়তার প্রশ্নে দেশীয় সমালোচকদের বিরোধিতা করছেন। এই সমালোচকরা চান, ইউক্রেনের পেছনে ব্যয় করা অর্থ অন্য কোথা খরচ করা হোক।
বর্তমানে তাইওয়ান পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করছে ভবিষ্যৎ বৈশ্বিক ক্ষমতার ভারসাম্য, গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার সুরক্ষা ও বিশ্ব বাণিজ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ উন্নত প্রযুক্তি। এই ক্ষেত্রে আমেরিকান ও ইউরোপীয়দের স্বার্থ অভিন্ন। ম্যাক্রোঁ মনে করেন, তিনি স্বাধীনভাবে কাজ করে সফলভাবে তাদের রক্ষা করতে পারবেন। কিন্তু এটি ভ্রান্ত ধারণা। ইউরোপ-আমেরিকা একসঙ্গে থাকতে পারে বা না-ও পারে। কিন্তু তাদের বিচ্ছেদে চীনা শতাব্দীর সূচনা অবধারিত।