জন্মনিয়ন্ত্রণে মোবাইল অ্যাপ

প্রকাশ : ১৭ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  আলোকিত ডেস্ক

জন্মনিয়ন্ত্রণের অন্যতম উপায়ে নারীরা দীর্ঘদিন ধরে জন্মনিরোধক পিল ব্যবহার করে আসছেন। গত শতাব্দীতে জন্মনিরোধক পিল যখন প্রথম বাজারে আসে, তখন এটিকে নারীর স্বাধীনতা ও শরীরের ওপর তার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার মাধ্যম হিসেবে ধরে নেয়া হয়েছিল। যুক্তরাজ্যের নারীরা জীবনের অধিকাংশ সময়ই জন্মনিয়ন্ত্রণের জন্য জন্মনিরোধক পিলের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। তবে বর্তমানে কেউ কেউ এখন জন্মনিয়ন্ত্রণের জন্য জন্মনিরোধক বা হরমোনাল পিলের পরিবর্তে প্রাকৃতিক পদ্ধতি অনুসরণের জন্য প্রযুক্তির দিকে ঝুঁকছেন।

ব্রিটেনে টেলিভিশন চ্যানেল আইটিভির অত্যন্ত পরিচিত মুখ এবং লাভ আইল্যান্ড নামক শোয়ের কারণে জনপ্রিয়তা পাওয়া মনটানা ব্রাউন জানান, হরমোনভিত্তিক জন্মনিরোধ পদ্ধতির ব্যবহার ছেড়ে দেয়ার দুই বছর পর তিনি অন্তঃসত্ত্বা হতে যাচ্ছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ইনস্টাগ্রামে এক পোস্টে তিনি জানান, মাসিকের হিসাব নিকাশ অনুসারে তিনি যৌন সম্পর্ক করে আসছিলেন। একে বলা হয় প্রাকৃতিক জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি। তিনি বলেন, ‘এ পদ্ধতির কারণে আমি আমার মাসিক সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারি, জানতে পারি বাচ্চা নিতে হলে কখন কী করতে হবে। শরীরের এ বিষয়টিতে আমি খুব অভ্যস্ত হয়ে পড়ি।’

মনটানা ব্রাউনের পোস্টটি ছিল ন্যাচারাল সাইকেলস নামের একটি অ্যাপের বিজ্ঞাপন। এ পোস্টটির জন্য তাকে পারিশ্রমিকও দেয়া হয়েছিল। ২০১৩ চালু হওয়া এ অ্যাপ বর্তমানে প্রায় ২৫ লাখ নিবন্ধিত ব্যবহারকারী রয়েছেন। ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসনও ন্যাচারাল সাইকেল অ্যাপটিকে ব্যবহারের জন্য অনুমোদন দেয়। জন্মনিয়ন্ত্রণের বিষয়ে কর্তৃপক্ষের অনুমোদন পাওয়া প্রথম অ্যাপ এটি।

ন্যাচারাল সাইকেল অ্যাপের নির্মাতারা জানান, শরীরের তাপমাত্রা পরিমাপের মাধ্যমে অ্যালগরিদমের ভিত্তিতে সন্তান ধারণের জন্য একজন নারী কখন সবচেয়ে বেশি উর্বর থাকে, তা নির্ধারণ করা সম্ভব। এ অ্যাপে সফলতার হার ৯৩ শতাংশ বলে দাবি অ্যাপের নির্মাতাদের।

ন্যাচারাল সাইকেল অ্যাপ তৈরির মূল উদ্দেশ্য হলো প্রচলিত জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির বিকল্প ব্যবস্থা তুলে ধরা। এ পদ্ধতিতে হিসাব নিকাশ করে বলে দেয়া হয় একজন নারীর কখন অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। একেকজন নারীর ঋতুস্রাব সংক্রান্ত চক্রের ধরনের ওপর এ বিষয়টি নির্ভরশীল। তবে ন্যাচারাল সাইকেল অ্যাপের ফলাফল যে প্রশ্নবিদ্ধ হয়নি, তাও না। কোনো কোনো নারীর ভাষ্যমতে, অ্যাপটি ব্যবহার করেও তারা অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েছেন। ন্যাচারাল সাইকেল অ্যাপের এক মুখপাত্র বলেন, ‘সব ধরনের জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির ব্যাপারে একটা বিষয় গুরুত্বপূর্ণ যে, পদ্ধতিটি সঠিকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে কি না। কারণ তার উপরেই কার্যকারিতা নির্ভর করে। সঠিক উপায়ে ব্যবহারের পরও গর্ভধারণ ঠেকাতে কোনো পদ্ধতিই শতভাগ সফল না। তবে এ অ্যাপের কার্যকারিতা অন্য যে কোনো সচেতনতামূলক পদ্ধতির চেয়ে বেশি।’

জন্মনিয়ন্ত্রণের জন্য ব্রিটেনে জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা এনএইচএস কনডম ব্যবহারের ওপর জোর দিয়ে থাকে। সংস্থাটি জানায়, কনডম ব্যবহারের মাধ্যমে শুধু গর্ভধারণ প্রতিরোধই না, যৌনবাহিত রোগ থেকেও সুরক্ষা পাওয়া যায়। যুক্তরাজ্যে বিজ্ঞাপনের মানের ওপর নজর রাখা কর্তৃপক্ষ ২০১৮ সালে ফেইসবুকে ন্যাচারাল সাইকেল অ্যাপটির বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ করেছিল। কারণ ওই বিজ্ঞাপনে দাবি করা হয়েছিল যে, অ্যাপটি ‘অত্যন্ত নির্ভুল’। কর্তৃপক্ষ তখন বিজ্ঞাপনটিকে বিভ্রান্তিকর বলে উল্লেখ করেছিল। তারপরও ব্রিটেনের লাখ লাখ মানুষ এ অ্যাপটি ব্যবহার করে আসছেন।

জন্মনিয়ন্ত্রণের জন্য প্রযুক্তিনির্ভর পদ্ধতির জনপ্রিয়তা বাড়ার পেছনের কারণ এপ্রিল ইন্সকিপ নামের এক নারী হরমোনাল পিল ব্যবহারের পর প্রায় এক দশক ধরে জন্মনিয়ন্ত্রণের প্রাকৃতিক পদ্ধতি অনুসরণ করেন। এক পর্যায়ে শরীরের জন্য হরমোনাল উপযোগী না বলে এ পদ্ধতি অনুসরণের সিদ্ধান্ত নেন। এপ্রিল ইন্সকিপ বলেন, ‘বয়স বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি বুঝতে পারি যে শরীরের ওপর পিলের অনেক প্রভাব পড়ছে। আমি অলস হয়ে গিয়েছিলাম। মেজাজ খিটখিটে হয়ে থাকত, ত্বক ফেটে যেতে লাগল। তখন আমি এ অবস্থার আর অবনতি হতে দিতে চাইনি।’

সকালে নিজের শরীরের তাপমাত্রা মেপে সেটা মোবাইল ফোনের একটি অ্যাপে রেকর্ড করে রাখেন এপ্রিল ইন্সকিপ। প্রতিদিনের এই ভার্চুয়াল চার্ট দেখে তিনি জানতে পারেন কোন সময়ে তার গর্ভধারণের সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি এবং কখন সবচেয়ে কম থাকে।

তিনি বলেন, ‘কোনো একটি অ্যাপের করা বিশ্লেষণের চেয়েও আমি পুরো চার্টটি দেখতে চাই। আমার আত্মবিশ্বাসী যে আমি আমার শরীরকে ভালো বুঝতে পারি এবং এই পদ্ধতি ব্যবহার করার ব্যাপারেও আমি স্বস্তিবোধ করি।’

তবে গর্ভনিরোধের জন্য বেছে নেয়া সব পদ্ধতিতেই ঝুঁকি রয়েছে উল্লেখ করে এপ্রিল ইন্সকিপ বলেন, ‘আপনার যদি সন্দেহ থাকে এবং আপনি এখন মা হতে না চান, তাহলে এ পদ্ধতির একটা বিকল্প রাখবেন। মনে রাখবেন, কনডমও কিন্তু ১০০ শতাংশ কার্যকরী না।’

হেলেন নামের আরেক নারী গত তিন বছর ধরে জন্মনিয়ন্ত্রণের প্রাকৃতিক পদ্ধতি অনুসরণ করছেন। এর আগে তিনি হরমোনাল পিল ব্যবহার করতেন। সেই সময়ের কথা মনে করে হেলেন জানান, কয়েক বছর ধরে পিল খাওয়ার সময় তিনি দেখেন যে তার মনমেজাজের ওপর জন্মনিয়ন্ত্রণ পিলের প্রভাব পড়ছে।

তিনি বলেন, ‘তখনই আমি কোনো ধরনের পরিবর্তন হয় কি না, তা দেখার জন্য হরমোনাল পদ্ধতি থেকে বের হয়ে আসার কথা চিন্তা করি। আমি খুব ভালো অনুভব করতে থাকি। আমার মাসিক স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে দুই বছরের বেশি লাগেনি।’

অদূর ভবিষ্যতে ৩৩ বছর বয়সি হেলেনের সন্তান নেয়ার কোনো পরিকল্পনা নেই। তবে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে গেলে সেই পরিস্থিতি সামালানোর মতো মানসিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা দুটোই তার ছিল বলে মনে করেন তিনি।

৩০ বছর বয়সে হরমোনাল পিল খাওয়া বন্ধ করে দেয়া হেলেন এখন ফোনের একটি অ্যাপের সাহায্যে তিনি তার মাসিকের ওপর নজর রাখেন। তিনি বলেন, ‘এ অ্যাপের সাহায্যে আমার মাসিক ও শরীরের বিষয়ে অনেক কিছু জানতে পেরেছি। আমি বুঝতে পেরেছি শরীরে কী ধরনের পরিবর্তন ঘটে, কোনটা স্বাভাবিক এবং কোনটা অস্বাভাবিক।’

৩৩ বছর বয়সি লরা বর্তমানে এক সন্তানের মা। এ নারী জানান, ১৭ থেকে ২৯ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি হরমোনাল পিল ব্যবহার করেছেন। ২১ বছর বয়সে ছয় মাসের জন্য পিল খাওয়া বন্ধ করে দিলেও তখন তার মাসিক স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসেনি।

লরা বলেন, ‘তখন আমার বয়স কম ছিল। বাচ্চা নেয়ার ব্যাপারে আমি তখনো কিছু চিন্তা করিনি। আমার শরীরে পিলের কী ধরনের প্রভাব পড়ছে, সে বিষয়েও আমি ভাবিনি।’

লরা জানান, আর সন্তান নেয়ার পরিকল্পনা না থাকায় তিনি প্রাকৃতিক পদ্ধতি ব্যবহার করছেন। এ কারণে তিনিও ফোনে এ সংক্রান্ত অ্যাপ ব্যবহার করেছেন। তবে তিনি প্রযুক্তির ওপরে সবকিছুর দায় ছেড়ে দেননি।

তিনি বলেন, ‘আমি আমার শরীরের দিকে নজর রেখেছি। আমি শরীরের কথা শুনেছি। বোঝার চেষ্টা করেছি কখন কী হচ্ছে। আপনি যদি মাসিকের ব্যাপারে জানতে পারেন, তাহলে বুঝতে পারবেন যে আপনি উর্বরতার কোন পর্যায়ে আছেন।’

এ পদ্ধতি ব্যর্থ হয়ে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়লে সেটি অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারনের ঘটনা হবে না উল্লেখ করে লরা বলেন, ‘দ্বিতীয় সন্তানের জন্য আমরা এখনো প্রস্তুত নই। কিন্তু সন্তান হচ্ছে আশীর্বাদ। যদি এরকম হয়েই যায়, আমরা খুশিই হবো যে আমি আবার মা হতে পারছি।’

এনএইচএসের ভাষ্যমতে, জন্মনিয়ন্ত্রণ পিলের কারণে একজনের মানসিক অবস্থা ওঠানামা করতে পারে। এমনকি বমি বমি ভাব, স্তনে হালকা ব্যথা এবং মাথাব্যথাও হতে পারে। তবে হরমোনাল পিল ব্যবহারে রক্ত জমাট বেঁধে যাওয়া অথবা সার্ভিক্যাল ক্যান্সার হওয়ার মতো বড় ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ঝুঁকি খুব কম বলেও জানায় তারা।

এনএইচএস জানায়, একজন নারী হরমোনাল পিল খাওয়া বন্ধ করে দিলে তার মাসিক স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে কিছুটা সময় লাগতে পারে। ফিরে আসার পরেও সেটা অনিয়মিত হতে পারে। কারণ পিলে থাকা হরমোন প্রতি মাসে ডিম্বাণুর জন্মকে ঠেকিয়ে দেয়। এনএইচএসের তথ্যমতে, পিরিয়ড স্বাভাবিক হতে তিন মাসের মতো সময় লাগতে পারে।

এনএইচএস বলে, ‘পিল খাওয়ার কারণে আপনি সন্তান জন্ম দেয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলবেন না। পিল খাওয়া বন্ধ করে দেয়ার পরপরই আপনি গর্ভধারণ করতে পারবেন। সন্তান জন্ম দেয়ার সক্ষমতার ব্যাপারে এটি কোনো সমস্যা তৈরি করে না।’

সবার জন্য উপযোগী না

এনএইচএসের মতে প্রাকৃতিক পদ্ধতি অনুসরণকারী একজন নারীকে তার মাসিকের চক্রের সময় কী ধরনের লক্ষণ ও উপসর্গ দেখা যায় সেগুলো বুঝতে হবে। এসবের মধ্যে রয়েছে- এ চক্র কতদিন ধরে চলে সেটা দেখা, প্রতিদিনের তাপমাত্রা পরিমাপ করা এবং উর্বর সময়ে জরায়ুর মুখ থেকে পানির মতো বের হয়ে আসে পদার্থে কী ধরনের পরিবর্তন ঘটে সেসব বিষয়ের ওপর নজর রাখা। এ বিষয়গুলোকে যদি নিয়মিত ও সঠিকভাবে অনুসরণ করা হয়, তাহলে এই পদ্ধতি ৯৯ শতাংশ কার্যকরী হতে পারে।

তবে এনএইচএসে যৌন স্বাস্থ্যবিষয়ক চিকিৎসক এনাবেল সোয়েমিমো জানান, এই পদ্ধতি সবার জন্য উপযোগী না। যেসব নারীর মাসিক নিয়মিত নয়, যাদের পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোম আছে অথবা যেসব নারী মাত্রই সন্তান জন্ম দিয়েছেন, তাদের এই পদ্ধতি ব্যবহারের জন্য সুপারিশ করা হয় না।

এনাবেল সোয়েমিমো বলেন, ‘আপনার জীবনযাত্রা যদি স্থিতিশীল না হয়, যদি সবসময় আপনার হাতের কাছে ক্যালেন্ডার, থার্মোমিটার না থাকে, আপনার ঘুমের ধরন যদি অনিয়মিত হয়, তাহলে এ পদ্ধতির ওপর নির্ভরতা কমে যাবে।’

প্রাকৃতিক পদ্ধতি অনুসরণ করতে গিয়ে যেসব প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে, সেগুলোর বিষয়েও কিছু উদ্বেগ রয়েছে জানিয়ে এ চিকিৎসক বলেন, ‘আমরা যেসব অ্যাপ দেখতে পাই, সেগুলো সাবস্ক্রাইব করতে হয়, ফলে জন্মনিয়ন্ত্রণের এসব পদ্ধতি থেকে তারা মুনাফা অর্জন করে,’ বলেন তিনি। ‘এজন্য তারা এগুলো আসলে যা এর চেয়েও বেশি কার্যকরী হিসেবে দেখাতে চায়।’ তিনি আরো বলেন, ‘তবে কিছু কিছু অগ্রগতি হয়েছে যার আসলেই সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু সেগুলোর নির্ভরযোগ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষার আগেই বাজারে চলে আসছে। কারণ প্রস্তুতকারীদের দিক থেকে প্রচুর চাপ দেয়া হচ্ছে বাজারে ছাড়ার জন্য।’