বৈশ্বিক মন্দার প্রভাব কাটিয়ে উঠছে দেশ

প্রকাশ : ১৮ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রবাসী আয় ও রপ্তানি আয়ের ওপর ভর করে বৈশ্বিক মন্দার প্রভাব কাটিয়ে উঠছে বাংলাদেশ। বিশেষ করে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর যে চাপ তৈরি হয়েছিল তা ধীরে ধীরে কমে আসছে। এদিকে আগামী জুনের মধ্যে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) নেতৃত্বে কো-ফান্ডিং উদ্যোগের মাধ্যমে চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশ প্রায় ২ বিলিয়ন ডলারের বাজেট সহায়তা পেতে যাচ্ছে। এর মধ্যে শুধু এডিবিই দেবে প্রায় ৭৫০ মিলিয়ন ডলার। দুই ধাপে এই তহবিল বাংলাদেশে আসবে। প্রথম ধাপে চলতি এপ্রিলে মাসে আসবে ১ দশমিক শূন্য ৫ বিলিয়ন ডলার এবং জুনে আরও প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার আসবে, যা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর ক্রমবর্ধমান চাপ কমাতে সহায়তা করবে।

এদিকে রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ) থেকে আগের মতো ঢালাও ঋণ দেওয়া হচ্ছে না। এর পরিবর্তে সময়মতো ইডিএফের টাকা ফেরত আনতে ব্যাংকগুলোকে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া যেসব ঋণ মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে পড়েছে, সেসব ঋণ সমন্বয় না হওয়া পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে নতুন করে অর্থায়ন বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে নানা ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তার দাবি, রিজার্ভ নিয়ে তারা এই মুহূর্তে কোনো দুশ্চিন্তা করছেন না। আগামী জুন পর্যন্ত যাতে রিজার্ভ স্বস্তিদায়ক থাকে, সেভাবেই ডলার খরচ করা হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী মুখপাত্র মো. সারওয়ার হোসেন জানান, আমদানি ঋণপত্রের তথ্য নিয়মিত মনিটরিং করায় আমদানি ব্যয় কমানোর সম্ভব হয়েছে। তিনি বলেন, আগে সাড়ে ৮ বিলিয়ন ডলার আমদানি হলেও এখন আমদানি নেমে এসেছে সাড়ে ৫ বিলিয়ন ডলারে। অর্থাৎ মাসে আমদানি খরচ আগের চেয়ে তিন বিলিয়ন কমে গেছে। এছাড়া আগের চেয়ে রেমিট্যান্স বাড়তে শুরু করেছে। রপ্তানি আয়ের গতিও ভালো রয়েছে।

অবশ্য বৈদেশিক মুদ্রাবাজার স্থিতিশীল রাখতে বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে ডলার বিক্রি অব্যাহত রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে ৯ এপ্রিল পর্যন্ত রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করা হয়েছে ১১ দশমিক ২২ বিলিয়ন ডলার। এর আগে পুরো অর্থবছরেও এতো ডলার বিক্রি হয়নি। গত অর্থবছরের পুরো সময়ে ডলার বিক্রির পরিমাণ ছিল ৭ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার। এদিকে, এত বেশি পরিমাণ ডলার বিক্রির পরও রিজার্ভের পরিমাণ গত এক মাসের বেশি সময় ধরে ৩১ বিলিয়ন ডলারের ঘরেই অবস্থান করছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ধারণা অনুযায়ী, আগামী জুন মাস নাগাদ রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধি হতে পারে সাড়ে সাত শতাংশ। আর চলতি অর্থবছরে রপ্তানির পরিমাণ ৫৩ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি হতে পারে। এছাড়া জুন মাসে রেমিট্যান্স ৪ শতাংশ বেড়ে চলতি অর্থবছরে প্রবাসী আয় ২৩ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি হতে পারে।

এদিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরামর্শ অনুযায়ী আগামী জুন থেকে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের প্রকৃত হিসাবায়ন করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর অংশ হিসেবে রিজার্ভের অর্থে গঠিত রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের (ইডিএফ) ঋণ দ্রুত সমন্বয়ের মাধ্যমে এর আকার কমিয়ে আনছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরই মধ্যে ১ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার কমিয়ে ইডিএফের আকার ৫ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারে নামিয়ে আনা হয়েছে। প্রতিদিন ডলার বিক্রি করলেও রিজার্ভ পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে।

ইদানীং বৈদেশিক ঋণের বড় কোনো কিস্তি পরিশোধ করতে হচ্ছে না- রিজার্ভ পরিস্থিতি উন্নতির পেছনে এটাও আরেকটি কারণ। অবশ্য আইএমএফের দৃষ্টিতে বৈদেশিক মুদ্রা আয়-ব্যয়ের হিসাবে ঘাটতি চলতি বছরে কমলেও আগামী বছরে বেড়ে যাবে। ফলে ডলার সংকট আগামী বছরে আরও বাড়বে। গত ১১ এপ্রিল রাতে প্রকাশিত আইএমএফের ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক এপ্রিল ২০২৩’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।

প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সম্পর্কে বেশ কিছু ইতিবাচক কথা বলেছে আইএমএফ। প্রতিষ্ঠানটির মতে, বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার যে সংকট চলছে তা ধীরে ধীরে কিছুটা কমে আসবে। ফলে চলতি বছর বৈদেশিক মুদ্রার চলতি হিসাবে (বৈদেশিক মুদ্রা আয় ও ব্যয়ের হিসাব) ঘাটতি হবে জিডিপির আকারের ২ দশমকি ১ শতাংশ। গত বছরে এ খাতে ঘাটতি হয়েছিল জিডিপির আকারের ৪ দশমিক ১ শতাংশ। গত অর্থবছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরে এ খাতে ঘাটতি কমে প্রায় অর্ধেক হবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী চলতি অর্থবছরে বাজারে রেকর্ড পরিমাণ ডলার বিক্রির পরও রিজার্ভ পরিস্থিতির খুব একটা অবনতি হয়নি। গত মাসে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) ১ দশমিক শূন্য ৫ বিলিয়ন ডলার দায় পরিশোধের পর থেকে রিজার্ভ ৩১ বিলিয়ন ডলারের ঘরেই অবস্থান করছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের ভাষ্য, শুধু ইডিএফের ঋণ সমন্বয়ই নয়, নিয়মিত মনিটরিংয়ের মাধ্যমে পণ্যমূল্য যাচাইয়ের পদক্ষেপও রিজার্ভ ধরে রাখার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে। এছাড়া বৈদেশিক ঋণ, রেমিট্যান্স বৃদ্ধি ও রপ্তানি আয়ও রিজার্ভের পতন ঠেকাতে সহায়ক হচ্ছে।

জানা গেছে, প্রকৃত রিজার্ভ বাড়ানোর উদ্যোগ হিসেবে রিজার্ভের অর্থে গঠিত তহবিলগুলো আলাদা করে দেখানো এবং এগুলো পর্যায়ক্রমে গুটিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরই মধ্যে রিজার্ভের অর্থে গঠিত গ্রিন ট্রান্সফরমেশন ফান্ড থেকে পুনঃঅর্থায়ন পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আর ইডিএফের আকার ধীরে ধীরে কমিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ কারণে এ তহবিল থেকে অর্থায়নে নানা কড়াকড়ি আরোপ করা হচ্ছে।

সর্বশেষ গত রোববার রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ) থেকে ঋণ নেওয়ার সীমা কমিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আগে এ তহবিল থেকে ঋণ নেওয়ার সীমা ছিল ২ কোটি ৫০ লাখ ডলার। আর এখন নিতে পারবেন সর্বোচ্চ ২ কোটি ডলার।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের গবেষক ও অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধরে রাখতে বাস্তবসম্মত উদ্যোগ নিয়েছে। তিনি বলেন, ব্যালেন্স অব পেমেন্টে চাপ পড়ার কারণে বিনিময় হার তথা টাকার মান কমে গেছে। এছাড়া মূল্যস্ফীতি হয়েছে। এ ছাড়া বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কিছুটা কমে গেছে। তিনি বলেন, বালাদেশ ব্যাংক এতোদিন যেটা করে এসেছে তা হলো এই তিনটিরই সমন্বয় করেছে।

তিনি উল্লেখ করেন, বাজারের সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডলারের বিনিময় হারের যে গ্যাপ রয়েছে, তা ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে আসছে। এছাড়া রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাবও কাটিয়ে উঠতে শুরু করেছে বাংলাদেশ। রিজার্ভ বাড়ার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রয়েছে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়। এখন এমনিতেই রেমিট্যান্স বাড়ছে। সামনে দুটি ঈদ আছে, ফলে রেমিট্যান্স আরও বাড়বে।