কক্সবাজারের টেকনাফের পৃথক তিনটি ইউনিয়নে বারবার অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। কোন অবস্থায় এ অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না পুলিশ। গত ৬ মাসে টেকনাফের তিনটি স্থান থেকে বিভিন্ন সময় অর্ধশত স্থানীয় ও রোহিঙ্গা অপহরণের শিকার হয়েছেন। অপহরণের শিকার ব্যক্তিদের মধ্যে অন্তত ৩৫ জনকে মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়িয়ে নিয়েছে ভুক্তভোগী পরিবার। সর্বশেষ গতকাল রবিবার সকালে টেকনাফ বাহারছড়ায় পানের বরজে কাজ করার সময় স্কুলছাত্রসহ দুইজন অপহরণের শিকার হয়েছে। এ সময় আরো দুইজনকে কুপিয়েছে অপহরণকারীরা।
গতকাল অপহরণের শিকার দুজন হলেন, ৬নং ওয়ার্ডের জাহাজপুরার বাসিন্দা বাছা মিয়ার ছেলে রহিম উদ্দিন (৩২) ও মো. সরোয়ারের ছেলে মো. রিদুয়ান (১৯)। তারা সম্পর্কে চাচা-ভাতিজা। আর আহতরা হলেন, একই এলাকার বাসিন্দা দুই সহোদর আবদুল আমিন (২৫) ও আবদুল্লাহ (১৭)।
পুলিশ বলছে, অপহরণকারীদের ধরতে কাজ করছে তারা। এর আগে গেল ১৬ মার্চ সকালে জাহাজপুরা এলাকা থেকে কলেজ শিক্ষার্থী গিয়াস উদ্দিন (১৭), রশিদ আলম (২৬), জানে আলম, (৪৫), জাফর আলম (৪০), জাফরুল ইসলাম (৩০), ফজল করিম (৩০) ও আরিফ উল্লাহ (৩০) অপহরণের শিকার হন। ১৯ মার্চ জাদিমুড়ার জুম্মা পাহাড়ি এলাকা থেকে অপহরণের শিকার হন মোহাম্মদ ছৈয়দ। ২৪ মার্চ রহমত উল্লাহ নামে আরেকজন অপহরণের শিকার হন। ২ মার্চ অপহরণের শিকার হন ৪ মার্চ ৭০ হাজার টাকায় মুক্তিপণে ফিরে আসেন টেকনাফ বাহারছড়ার মারিশবনিয়া এলাকা থেকে প্রবাসী হোসন আলীর ছেলে মো. সালমান (৫) এবং মো. আলীর ছেলে ওবাইদুল্লাহ (১৩)।
২৪ এপ্রিল দুপুরে হ্নীলা দমদমিয়া ন্যাচার পার্কে ঘুরতে গিয়ে শিবিরের সি-ব্লকের বাসিন্দা হাবিবুর রহমানের ছেলে মো. বেলাল (১৩), মোহাম্মদ ইলিয়াসের ছেলে নূর কামাল (১২), মো. উবায়দুল্লাহর ছেলে নূর আরাফাত (১২), বি ব্লকের মো. রফিকের ছেলে ওসমান (১৪) এবং ডি ব্লকের মাহাত আমিনের ছেলে নুর কামাল (১৫) অপহরণের শিকার হন। তারা ২৮ এপ্রিল মুক্তিপণ দিয়ে ফিরে আসেন।
২৮ জানুয়ারি বাহারছড়া ইউনিয়নের চৌকিদার পাড়া এলাকা থেকে অপহরণ হন নুরুল আমিনের ছেলে রহমত উল্লাহ (২৫) ও আলী আকবর এর ছেলে আব্দুল হাফিজ।
৯ জানুয়ারি উপজেলার হ্নীলা ইউনিয়নের লেচুয়াপ্রাং এলাকা থেকে অপহরণের শিকার আবুল হোসেনের ছেলে আব্দু সালাম, গুরা মিয়ার ছেলে আব্দুর রহমান, রাজা মিয়ার ছেলে মুহিব উল্লাহ ও রাজা মিয়ার ছেলে আব্দুল হাকিম। স্থানীয়দের দেয়া তথ্য মতে, এসব অপহরণের সাথে স্থানীয় অপরাধীরা জড়িত।
তথ্য মতে, টেকনাফ বাহারছড়ার জাহাজপুরা, হ্নীলা ইউনিয়নের রঙ্গীখালী এবং হোয়াইক্যং ইউনিয়নে বারবার অপহরণের ঘটনা ঘটছে। কখনো স্থানীয় আবার কখনো রোহিঙ্গারা অপহরণের শিকার হচ্ছে। অনেকে মুক্তিপণ দিয়ে ফিরে এলেও অনেকে আর ফিরে আসেননি। এসব এলাকার কিছু চিহ্নিত অপরাধী ও জনপ্রতিনিধি এ অপরাধের সাথে সরাসরি যুক্ত রয়েছে।
বাহারছড়া ইউনিয়নের ৫ ওয়ার্ডের স্থানীয় ইউপি সদস্য হুমায়ুন বলেন, আমরা শুনতে পেয়েছি, আমাদের মহিলা ইউপি সদস্য এবং ৬ নং ওয়ার্ড চকিদার ইসহাক অপহরণ চক্রের সাথে জড়িত। আমরা বারবার অভিযোগ করার পরও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। এ অবস্থায় চরম নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছি আমরা।
তিনি আরো বলেন, এর আগে চকিদার ইসহাক অপহরণের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়ে কারাভোগ করেছেন। কিন্তু ইউপি সদস্য মুবিনা আক্তারকে আটক করা হয়নি। তাদের আটক করা গেলে অপহরণের সঠিক তথ্য বেরিয়ে আসবে বলেও মনে করেন তিনি। তবে ফোন রিসিভ না করায় মুবিনা আক্তারের বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।
অপরদিকে হ্নীলা ইউনিয়নের রঙ্গীখালী এলাকার শাহ আলম গ্রুপের মো. ইউনুস এর ছেলে ইয়াসিন আরাফাত, দিল মোহাম্মদের ছেলে সাদেক এবং বাইদুল প্রকাশ ওদুল্লাহ অপহরণের সাথে জড়িত। কিন্তু তাদের অবস্থান পাহাড়ি এলাকায় হওয়ায় তাদের সহজে গ্রেপ্তার করতে পারে না পুলিশ। সম্প্রতি গ্রুপ প্রধান শাহ আলম পুলিশের হাতে আটক হয়েছেন। রয়েছে গিয়াস উদ্দিন গ্রুপ নামে আরো একটি গ্রুপ। সম্প্রতি অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে রয়েছেন গিয়াস উদ্দিন। স্থানীয় এ চক্রের সঙ্গে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের যোগসংযোগ রয়েছে বলে দাবি স্থানীয়দের। গেল ৬ মাসে এসব ইউনিয়ন থেকে কৃষক ও ছাত্রসহ ৬২ জন অপহরণের শিকার হয়েছেন। তাদের মধ্যে ৩৪ জন স্থানীয় বাসিন্দা, বাকি ২৮ জন রোহিঙ্গা।
আহতদের বরাত দিয়ে বাহারছড়া ইউপির ৬ নং ওয়ার্ড সদস্য রফিকুল ইসলাম ভুক্তভোগীদের বরাত দিয়ে বলেন, প্রতিদিনের মতো রবিবার সকালে পাহাড়ের পাদদেশে পানের বরজে কাজ করতে যান তারা চারজন। এ সময় কয়েকজন অজ্ঞাতনামা সন্ত্রাসী অস্ত্রের মুখে তাদের অপহরণের চেষ্টা করলে উভয়ের মধ্যে হাতাহাতি ও ধস্তাধস্তির ঘটনা ঘটে। একপর্যায়ে সন্ত্রাসীদের কোপ খেয়ে দুইজন পালিয়ে এলেও দুজনকে অস্ত্রের মুখে অপহরণ করে গহিন পাহাড়ে নিয়ে যায়।
অপহরণের শিকার স্কুল শিক্ষার্থী রিদুয়ানের পিতা সওয়ার আলম বলেন, পানের বরজে কাজ করা অবস্থায় আমার ছেলেসহ দুইজনকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। এখন মুক্তিপণ দাবি করছে ৫ লাখ টাকা। কিন্তু এত টাকা আমি কিভাবে দিব। ছেলে উদ্ধারে আমি প্রশাসনের সহায়তা কামনা করছি।
গতকাল অপহরণকারীদের হাতে আহত আমিন ও আব্দুল্লাহ হাসপাতালে প্রতিবেদককে জানিয়েছেন, সন্ত্রাসীরা সবাই মুখোশ পরা ছিল। তাদের হাতে বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র ছিল। কোনো রকমে আমরা পালিয়ে আসতে পারলেও রহিম উদ্দিন ও রিদুয়ানকে ধরে নিয়ে গেছে। ধারাল অস্ত্রের কোপে আমরা হাতে ও মাথায় আঘাত পেয়েছি।
জানতে চাইলে বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের পরিদর্শক মশিউর রহমান বলেন, জাহাপুরা পাহাড়ি এলাকায় কিছু বসতি আছে। তারা পানের বরজ, সুপারি, সবজি বাগান করে। বাগান পরিচর্যার জন্য গেলে অপহরণের শিকার হন তারা। তাদের উদ্ধারে অভিযান চালানো হচ্ছে।
পুলিশের এ কর্মকর্তা বলেন, স্থানীয় কিছু চক্র জড়িত আছে বলে আমরাও শুনেছি। তাদের চিহ্নিত করার পাশাপাশি অভিযোগের তদন্ত করা হচ্ছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ভুক্তভোগী কেউ সহজে পুলিশকে তথ্য দিতে চায় না।
হ্নীলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রাশেদ মো. আলী বলেন, গেল কয়েক মাসে আমার এলাকা থেকে অন্তত ২০ জন অপহরণের শিকার হয়েছেন। রঙ্গীখালী এলাকায় কিছু অপরাধী রয়েছে। তাদের সাথে রোহিঙ্গাও জড়িত। এসব অপরাধীকে আইনের আওতায় আনা গেলে অপহরণসহ সব ধরনের অপরাধ কমে আসবে। কিন্তু শৃঙ্খলা বাহিনীকে আরো কঠোর হতে হবে।
টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল হালিম বলেন, যেহেতু এলাকাগুলো দুর্গম, তাই কৃষকদের আমরা বলেছিলাম, তারা যেন পাহাড়ি এলাকায় সংঘবদ্ধ থাকে। কিন্তু তারা বিষয়টি আমলে না নিয়ে যে যার মতো কাজে যায়। আর সুযোগ বুঝে তাদের অপহরণ করে অপরাধীরা। এতে আমদেরও বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়। তারপরও আমাদের সীমাবদ্ধতার মাঝে অপহরণকারীদের চিহ্নিত করে কিভাবে অপরাধ নির্মূল করা যায় তা নিয়ে কাজ করছি আমরা।
জানতে চাইলে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রফিকুল ইসলাম বলেন, আমরা সকল তথ্য নিয়ে এগুচ্ছি। অপরাধী চক্রকে সমূলে বিনাশ করাই আমাদের মূল লক্ষ্য। তবে দুর্গম পাহাড় হওয়ায় কাজ করা আমাদের জন্য দুরূহ হয়ে পড়ছে।