ট্রলারে ১০ জনের মরদেহ উদ্ধার
তিন আসামির জবানবন্দিতে বের হয়ে এলো প্রকৃত ঘটনা
প্রকাশ : ০৩ মে ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
এএইচ সেলিম উল্লাহ, কক্সবাজার
কক্সবাজারে ট্রলারে ১০ জনের অর্ধগলিত লাশ উদ্ধারের ঘটনায় ১৬৪ ধারা জবানবন্দি দিয়েছে গ্রেপ্তারকৃত কামাল হোসেন এবং আবু তৈয়ব ও ফজল কাদের। সোমবার সন্ধ্যা এবং আগের দিন রোববার পৃথক তিন আসামি তাদের জবানবন্দি দেন। সোমবার কক্সবাজার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আখতার জাবেদ এবং রোববার শ্রীজ্ঞান তঞ্চঙ্গ্যা আসামিদের জবানবন্দি রেকর্ড করেন।
কামাল হোসেন মহেশখালীর মাতারবাড়ীর সাইরারডেইল এলাকার বাসিন্দা এবং অপর দুই আসামি (ট্রলারের মাঝি) আবু তৈয়ব ও ফজল কাদের চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার কুদুকখালী গ্রামের বাসিন্দা।
পৃথক পৃথকভাবে আদালতে জবানবন্দি দেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কক্সবাজার সদর থানার পরিদর্শক দুর্জয় বিশ্বাস।
জবানবন্দিতে আসামিরা দাবি করেছেন, ডাকাতি করায় ১০ জনকে পিটিয়ে হত্যা করার পর লাশ গুম করতে ট্রলারটি সাগরে ডুবিয়ে দেয়া হয়। তবে তারা কেউ ঘটনার সঙ্গে জড়িত নন বলে দাবি করেছেন।
আদালতের একটি সূত্র জানিয়েছে, জবানবন্দিতে প্রধান অভিযুক্ত কামাল হোসেন ঘটনার সময় কক্সবাজার শহরে অবস্থান করছিলেন বলে দাবি করেন।
তিনি বলেন, আমি শহরে অবস্থান করলেও ঘটনার আগে ও পরে কয়েকজন জেলের সাথে আমার কথা হয়। তাদের সাথে কথা বলে নিশ্চিত হয়েছি, ১০ জনের ট্রলারটি সাগরে ডাকাতি করতে নেমেছিল। ডাকাতির এক পর্যায়ে কয়েকটি মাছ ধরার ট্রলারের সাধারণ জেলেরা ১০ জনের ট্রলারকে ধাওয়া করে আটকিয়ে প্রথমে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করে। এরপর লাশ গুম করতে বরফ রাখার কক্ষে লাশগুলো রেখে ট্রলারটি সাগরে ডুবিয়ে দেয়। কামাল হোসেন জবানবন্দিতে আরো বলেন, ৯ এপ্রিল দিবাগত রাত সাড়ে ৩টার দিকে আনোয়ার বহদ্দারের ট্রলার সাগরে জাল ফেলে। হঠাৎ আরেকটি ছোট ট্রলার তার পাশে আসে। এ সময় আনোয়ারের ট্রলারের জেলে ফোরকান টর্চলাইট মেরে কাছে ভেড়ার কারণ জানতে চান। কিছু বুঝার আগেই ছোট ট্রলারের (ডাকাতদের বোট) লোকজন দা, কিরিচ, রড ও বন্দুক নিয়ে আনোয়ারের ট্রলারে উঠে পড়ে এবং আনোয়ারের ট্রলারের জেলেদের এলোপাতাড়ি মারতে থাকে। একপর্যায়ে ট্রলারের কায়সার (আনোয়ারের ট্রলারের চালক) ও জয়নাল মাঝি ছাড়া অবশিষ্ট জেলেদের জাল রাখার কক্ষে ঢুকিয়ে রাখে। এরপর ডাকাতেরা কায়সারকে ট্রলারের ইঞ্জিন চালু এবং জয়নাল মাঝিকে ট্রলার চালাতে বাধ্য করে ডাকাতেরা। ট্রলারটি কিছু দূর যাওয়ার পর ডাকাতরা জয়নাল ও কায়সারকে রেখে ট্রলারের অবশিষ্ট জেলেদের সাগরে ফেলে (নিক্ষেপ) দেয়। তারপর ডাকাতরা আনোয়ারের ট্রলার অন্য একটি ট্রলারের সঙ্গে ভেড়াতে বলেন। কিন্তু ট্রলার ভেড়াতে দেরি হওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়ে ডাকাতেরা জয়নাল ও কায়সারকেও মারধর করে সাগরে নিক্ষেপ করে। এ সময় আনোয়ারের ট্রলারে ডাকাত ছাড়া অন্য কেউ ছিল না।
এরপর ডাকাতেরা আনোয়ারের ট্রলারের সঙ্গে তাদের (ডাকাতের) ছোট ট্রলারটি বেঁধে উত্তর-পূর্ব দিকে যাচ্ছিল। তখন সামনে পড়ে আফসার মাঝি ও বাবুল মাঝির দুই ট্রলার। দুই মাঝি আনোয়ারের ট্রলার চিনতে পেরে কাছে ভেড়ানোর চেষ্টা করে এবং ট্রলারের জেলে জয়নাল, কায়সার ও মালিক আনোয়ারকে নাম ধরে ডাকতে থাকেন। তাতেও সাড়াশব্দ না পেলে আফসার ও বাবুল মাঝির সন্দেহ হয় তাদের। এরপর বাবুল মাঝির ট্রলারটি ডাকাতের কবলে থাকা আনোয়ারের ট্রলারটির কাছে ভেড়ানোর চেষ্টা করলে ডাকাতেরা গুলি ছুড়তে থাকে। উপায় না দেখে বাবুল মাঝি ও আফসার মাঝি বাঁশের মাথায় কাপড় বেঁধে ট্রলারে তুলে দেয় (এটি এক ধরনের বিপদ সংকেত)। এর ২০-৩০ মিনিটের মধ্যে ঘটনাস্থলে পৌঁছায় আরো ৭/৮টি ট্রলার। পরে তারা ডাকাতের ট্রলারটি চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে। এ সময় ডাকাত দলএলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে থাকে।
অবস্থা বেগতিক দেখে এক পর্যায়ে ডাকাতেরা আনোয়ারের ট্রলারে বাঁধা নিজেদের ছোট ট্রলারটি রশি কেটে দিয়ে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। এরপর ট্রলার নিয়ে পালাতে চেষ্টা করে ডাকাত দল। কিছুদূর যাওয়ার পর ট্রলারের জ্বালানি তেল শেষ হয়। তখন চট্টগ্রামের বাঁশখালী ও কুতুবদিয়ার দুটি ট্রলার দুই পাশ থেকে ঘিরে ডাকাতের ট্রলারটি (আনোয়ারের) আটকায়। অন্যান্য ট্রলারগুলো একযোগে ডাকাত দলের উপর হামলা চলায়। তারা ডাকাতদের হাত-পা রশি দিয়ে বেঁধে ফেলে।
এরপর বাঁশখালী ও কুতুবদিয়ার দুটি ট্রলারের সঙ্গে বাবুল মাঝি, আফসার মাঝি, আমান উল্লাহসহ অন্য ট্রলারের জেলেরা সাগরে নিক্ষিপ্ত আনোয়ারের ট্রলারের জেলেদের উদ্ধার করে। এরপরই সব জেলেরা ডাকাত দলের সদস্যদের মারধর করে হত্যা করে। এক পর্যায়ে লাশগুলো গুম করতে ডাকাত দলের ছোট ট্রলারের বরফ রাখার কক্ষে ঢুকিয়ে ঢাকনা দিয়ে মুখ বন্ধ করেন। তারপর লাশ গুম করার উদ্দেশ্যে ট্রলারটি সমুদ্রে ডুবিয়ে দেয়া হয়।
মামলার অপর দুই আসামি (ট্রলারের মাঝি) আবু তৈয়ব ও ফজল কাদের ঘটনার সাথে নিজেরা জড়িত না হলেও ঘটনাটি স্বচক্ষে দেখেছেন বলে দাবি করেন।
রোববার সন্ধ্যায় ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিতে আবু তৈয়ব বলেছেন, ১১ রোজার দিন ট্রলারে ১৮ জন জেলে নিয়ে তিনি বাঁশখালী থেকে সাগরে রওনা দেন। ট্রলারটি মহেশখালী ও কুতুবদিয়া উপকূলের মাঝামাঝি ৮ বিআর লাইন নামক স্থানে পৌঁছায়। তিন দিন পর ওই এলাকায় দেখা হয় ফজল (ফজল কাদের) মাঝির ট্রলারের। ১৭ রোজার দিন (৯ এপ্রিল) ভোর ৫টার দিকে তারা সমুদ্রে গোলাগুলির শব্দ শুনতে পান।
প্রথমে তারা ধারণা করেন, নৌবাহিনীর প্রশিক্ষণ চলছে। সকাল সাড়ে ৭টার দিকে ফজল মাঝি জানান, খুটা জাইল্যাদের (ছোট মাছ ধরার জেলে) একটা ট্রলারে ডাকাতি হয়েছে। খুটা জাইল্যাদের ট্রলারটি ফ্ল্যাগ (নিশানা) তুলে পূর্ব দিকে চলে গেছে। এরপর তৈয়ব ও ফজল মাঝির ট্রলার দুটি পূর্ব দিকে যেতে থাকে।
কাছাকাছি গিয়ে তারা দেখতে পান খুটা জাইল্যাদের পাঁচটি ট্রলার আরেকটি ট্রলারকে ঘিরে রেখে ট্রলারটির লোকজনকে লাঠি দিয়ে মারধর করছে। দূর থেকে মারধরের এই দৃশ্য দেখতে থাকেন আরও কিছু জেলে।
আবু তৈয়ব বলেন, হঠাৎ দেখতে পান, একজন লোক টাঙ্কিতে (প্লাস্টিক গ্যালন) ভেসে তার ট্রলারের কাছে আসছেন। লোকটিকে তারা ট্রলারে তুলে নেন। লোকটির বয়স আনুমানিক ৫০ বছর, মুখে সাদা দাড়ি। লোকটি ট্রলারে উঠে তাকে জানান, ডাকাতেরা তাকে মাছ ধরার কথা বলে সাগরে নিয়ে এসেছে। লোকটি বারবার তাকে বাঁচানোর জন্য বলছিলেন। চার থেকে পাঁচ মিনিট পর খুটা জাইল্যাদের একটি ট্রলার এসে তার (তৈয়ব) ট্রলারে আশ্রয় নেয়া লোকটিকে ছিনিয়ে নিয়ে যায় এবং আশ্রয় দেয়ার কারণে তাকে গালমন্দ করে।
জবানবন্দিতে তৈয়ব বলেন, কিছুক্ষণ পর তিনি দেখতে পান, খুটা জাইল্যারা ডাকাত বলে ঘিরে রাখা ট্রলারের লোকগুলোকে বাঁশ, বরফ ভাঙার মুগুর ও লাঠি দিয়ে বেদম পিটুনি দিচ্ছেন। মারের চোটে কয়েকজনের মৃত্যু হয়েছে। সেটা দূর থেকে আন্দাজ করা যাচ্ছিল। ভয়াবহতা দেখে তৈয়ব ও ফজল মাঝি তাদের ট্রলার নিয়ে ঘটনাস্থল থেকে পশ্চিম দিকে চলে যান। ২৫ রোজা পর্যন্ত সাগরে ছিলেন তৈয়ব। এরপর ট্রলার নিয়ে বাঁশখালীতে পৌঁছে লোকজনকে ঘটনার কথা খুলে বলেন। পৃথক জবানবন্দিতে ফজল কাদেরও একই রকম জবানবন্দি দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন সূত্রটি।
স্থানীয় সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য মতে, কামাল হোসেনের একটি ভাসা জালের ট্রলার আছে। ৯ এপ্রিল সন্ধ্যায় তিনি জানতে পারেন সমুদ্রে তাঁর ভাই আনোয়ারের (মামলার পলাতক আসামি) ট্রলারে ডাকাতি হয়েছে। এরপর মাতারবাড়ীর আবদুল গফুর, সাগরে থাকা দুই ট্রলারের জেলে বেলাল ও আক্কাসের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলে ডাকাতির বিষয়টি নিশ্চিত হন কামাল। ১০ এপ্রিল সকালে আক্কাসের সঙ্গে তার দ্বিতীয় দফায় আরও ১৫ মিনিট কথা হয়। আক্কাস তখন ঘটনাস্থলে ট্রলারে ছিলেন।
এ বিষয়ে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কক্সবাজার সদর থানার পরিদর্শক দুর্জয় বিশ্বাস বলেন, এ পর্যন্ত এ মামলায় তিনজন আদালতে ১৬৪ ধারায় জবাবন্দি দিয়েছেন। তারা কেউ ঘটনার সাথে জড়িত থাকার কথা স্বীকার না করলেও তাদের কাছ থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। জানা গেছে, ঘটনার অনেক কিছুই। তদন্তের স্বার্থে আপাতত কিছুই বলা যাচ্ছে না।
কক্সবাজার সদর থানার ওসি মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, ১০ লাশ উদ্ধারের মামলায় মঙ্গলবার পর্যন্ত ৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে দুজন এজাহার নামীয় এবং বাকিরা সন্দিগ্ধ আসামি। এদের মধ্যে ৫ জনকে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। ৪ জনের রিমান্ড শেষ হয়েছে। তিনজন আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। এছাড়া এ মামলার অপর দুই এজাহারনামীয় আসামি আনোয়ার হোসেন ও বাবুল মাঝিকে গ্রেপ্তার করতে পুলিশের অভিযান চলমান রয়েছে।
উল্লেখ্য, ২৪ এপ্রিল কক্সবাজার শহরতলীর নাজিরারটেক উপকূলে ডুবন্ত একটি মাছ ধরার ট্রলার থেকে অর্ধগলিত অবস্থায় ১০ জেলের লাশ উদ্ধার করে।
নিহতরা হলেন– মহেশখালী উপজেলার হোয়ানক ইউনিয়নের ছনখোলা পাড়ার রফিক মিয়ার ছেলে ওই বোট মালিক শামসুল আলম (২৩), শাপলাপুর ইউনিয়নের মিঠাছড়ি গ্রামের দেলোয়ার হোসেনের ছেলে সাইফুল ইসলাম (১৮), জাফর আলমের ছেলে শওকত উল্লাহ (১৮), মুসা আলীর ছেলে ওসমান গনি (১৭), সাহাব মিয়ার ছেলে সাইফুল্লাহ (২৩), মোহাম্মদ আলীর ছেলে পারভেজ মোশাররফ (১৪), মোহাম্মদ হোসাইনের ছেলে নুরুল কবির (২৮), চকরিয়া উপজেলার কোনাখালী ইউনিয়নের কবির হোসাইনের ছেলে সাইফুল ইসলাম (৩৪), শাহ আলমের ছেলে মোহাম্মদ শাহজাহান (৩৫) ও চকরিয়া পৌরসভার চিরিঙা এলাকার জসিম উদ্দীনের ছেলে তারেক জিয়া (২৫)।
এ ঘটনায় ট্রলার মালিক নিহত শামসু মাঝির স্ত্রী রোকিয়া আকতার বাদী হয়ে কক্সবাজার সদর মডেল থানায় মামলা করেন। মামলায় চারজনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে ৫০-৬০ জনকে।