উপকূল এলাকা থেকে দূর সাগরের ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত নজরদারির আওতায় আনার লক্ষ্যে কক্সবাজারের চারটিসহ মোট সাতটি রেডিওস্টেশন স্থাপনের ২০১৪ সালে প্রকল্প হাতে নেয় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। ওই প্রকল্পের আওতায় ঢাকায় একটি ১১ তলা ভবন, কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন, কুতুবদিয়া, নিঝুম দ্বীপ, কুয়াকাটা, চরকুকরিমুকরি, দুবলারচরে সাতটি কোস্টাল রেডিওস্টেশন হওয়ার কথা। প্রতিটি সাইটে দুটি ভবন ও একটি টাওয়ার বসবে।
প্রকল্পটির বাজেট ধরা হয় প্রায় ৭৭৯ কোটি টাকা। যার অংশীদার কোরিয়া থাকলেও ৬০ শতাংশের বেশি বাংলাদেশ। দক্ষিণ কোরিয়ার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সামহী পূর্তের (অবকাঠামো) কাজ এবং এলজি করবে আইসিটির কাজ। ২০১৪ সালে সরকারি অনুমোদন পাওয়া প্রকল্পটি ২০১৬ সালে সম্পন্ন হওয়ার কথা। কিন্তু নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির কবলে পড়া প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার প্রকল্পটিতে একে একে ৩ দফায় আরডিপিপি সংশোধনী আনা হয়েছে। শেষবারের মতো তৃতীয় সংশোধনী অনুমোদিত প্রকল্পের মেয়াদ ২০২২ থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়েছে। কনসালটেন্ট, কোরিয়ান ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সামহী কনস্ট্রাকশনের অসহযোগিতা এবং প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে কাজ তেমন এগুচ্ছে না বলে জানা গেছে। এখনো অবকাঠামোতে সীমাবদ্ধ। যে কারণে নির্ধারিত সময়ে প্রকল্প সমাপ্তি নিয়ে শঙ্কা করছে সংশ্লিষ্টরা।
মহাপরিচালক দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬-২০২০ সালের জুন পর্যন্ত প্রথম দফায় আরডিপিপি সংশোধনী আনা হয়। এই সময়ে প্রকল্প পরিচালক ছিলেন নৌপরিবহন অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী এসএম নাজমুল হক। তার সময় কাজ হয়েছে ১০ শতাংশের মতো। দুর্নীতির মামলায় বরখাস্ত হয়ে তিনি জেলে যান। তার পরে দায়িত্বে আসেন একেএম জসীম উদ্দিন সরকার। তিনি ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করে এখন অবসরে। তার বিরুদ্ধেও ৬২ কোটি টাকার অডিট আপত্তি ওঠে। তাতে প্রায় ১৩ কোটি টাকার আত্মসাতের ঘটনা ধরা পড়ে মন্ত্রণালয়ের অডিট কমিটির মাধ্যমে। এরই মধ্যে তিনি অবসর গ্রহণ করলেও তার পেনশন আটকে রাখা হয়েছে।
২০২১ সালের ডিসেম্বরে পিডির দায়িত্ব নেন আবু সাইদ মো. দেলোয়ার রহমান। ২০২২ সালের জুন নাগাদ অবকাঠামোগত কাজের সর্বোচ্চ অগ্রগতি হয়েছে ৩৫ শতাংশ। গেল নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি এই চার মাসে ৭০ শতাংশ অগ্রগতি হয়েছে। এরপর থেকে বিভিন্ন প্রকার অনিয়ম ও দুর্নীতি কারণে গতি বাধাগ্রস্ত হয়। এসব বিষয় জানিয়ে গত ২০ মার্চ নৌপরিবহন সচিবকে চিঠি লিখেন মহাপরিচালক কমডোর মো. নিজামুল হক। প্রকল্প পরিচালক আবু সাইদ মো. দেলোয়ার রহমানকে প্রতিস্থাপন প্রসঙ্গে পাঠানো ওই পত্রে তিনি উল্লেখ করেন, আগামী জুনের মধ্যে পূর্তের কাজ শেষ করা না হলে ইকুইপমেন্ট স্থাপনসহ প্রকল্প ২০২৪ সালের জুন মাসের মধ্যে সম্পন্ন করা অসম্ভব মনে হচ্ছে। প্রকল্পের গতি ত্বরান্বিত ও সঠিক সময়ে বাস্তবায়নের স্বার্থে অসযোগিতা ও অদক্ষতার দায়ে কোরিয়ান কনসালটেন্ট মি. পিটারকে ২০২২ সালের অক্টোবরে অব্যাহতি দেয়া হয়। কোরিয়ান ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সামহী কনস্ট্রাকশনের স্থানীয় কর্মকর্তাদের অনিয়ম ও অসযোগিতার জন্য সতর্ক করে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। কাজ না করে ঠিকাদারদের বিল প্রদান, মালামাল ক্রয় না করে বিল পরিশোধের মতো মারাত্মক অভিযোগও আছে। দোষী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে দিয়েই প্রকল্পের কাজ চলছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
এসব বিষয় সামনে আসায় ঠিকাদারদের অর্থছাড় বন্ধ করে দেন প্রকল্প পরিচালক। যে কারণে কাজের গতি কমে আসে, এমনটি অভিযোগ।
কোরিয়ান ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের দুই নাগরিক মি. কেসপার ও মি. হার, পিডি আবু সাইদ মো. দেলোয়ার রহমান, কর্মকর্তা বিপ্লব জলিল ও প্রতীক প্রবণ দাসের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম, দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে।
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, কোরিয়ান ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের দুই নাগরিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে ব্যবস্থা নিতে তাদের প্রতিষ্ঠানকে পত্র লিখেন মহাপরিচালক কমডোর মো. নিজামুল হক। পাশাপাশি পিডিকে প্রতিস্থাপনের জন্য মন্ত্রণালয় বরাবর চিঠি পাঠান। মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে পিএসসি সভা আহ্বান করে গেল ৩ এপ্রিল। ১০ দিনের মধ্যে সিদ্ধান্ত জানানোর কথা। এখনো কোনো সিদ্ধান্ত পাওয়া যায়নি। এরইমধ্যে গেল গত ২৫ এপ্রিল পিডি আবু সাইদ মো. দেলোয়ার রহমান নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিবের নিকট পদত্যাগপত্র জমা দেন। ইমিগ্রেশন সূত্রে জানা গেছে, কোরিয়ান দুই নাগরিক মি. কেসপার ও মি. হার ২০১৯ সাল থেকে ভিসা জালিয়াতি করে ট্যাক্স ও ভ্যাট ফাঁকি দিয়ে বাংলাদেশে অবৈধভাবে অবস্থান করছে জানিয়ে তাদের পাসপোর্টসহ ইমিগ্রেশনে হাজির করতে অতিরিক্ত মহাপুলিশ পরিদর্শক (এসবি) বরাবর পত্র দেয়া হয়।
অনুসন্ধান বলছে, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সিল ও লোগো জালিয়াতি করে ভুয়া অনুমোদনের মাধ্যমে আগার গাঁওয়ের ১১ তলা ভবনে ‘ফায়ার ফাইটিং সিস্টেম’ বসানো হয়। যেখানে কোরিয়ান দুই নাগরিক ও সিনার্জি লজিস্টিকসের গফফার সম্পৃক্ত। পিডি আবু সাঈদ মো. দেলোয়ার রহমানের সঙ্গে বিপ্লব জলিল ও প্রতীক প্রবণ দাস জড়িত বলে জানা গেছে। জিওবি তহবিলের কোনো বিল ভাউচার জমা করেন না পিডি।
গত ১৪ জুলাই বালুর স্থলে ড্রেজিংয়ের কাদা-মাটি দিয়ে জমি ভরাট করে ৬ কোটি ৫৭ লাখ টাকার একটি বিল মহাপরিচালকের অনুমোদন ছাড়া গোপনে প্রকল্প পরিচালক নিজে অনুমোদন দিয়ে পাস করিয়ে নেন। এছাড়া, ডিপিপির জিসিসি ও এসসিসির অধিকাংশ কন্ট্রাক্ট ক্লস ভঙ্গ করে প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নেয়া হচ্ছে।
এদিকে, শত কোটি টাকার অনিয়ম যখন দৃশ্যমান হয় তখন পিডি আবু সাইদ মো. দেলোয়ার রহমাকে অপসারণ ও নতুন পিডি নিয়োগের জন্য মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব প্রেরণ করেন মহাপরিচালক কমডোর মো. নিজামুল হক। কিন্তু এখনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। পদত্যাগপত্র দিয়েও বহাল তবিয়তে পিডি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে কমডোর মো. নিজামুল হক বলেন, ২০২১-২২ অর্থবছরে ১২১ কোটি টাকা জিওবি থেকে খরচ হয়েছে। যেখানে অধিকাংশের বিল ভাউচার নেই। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১৭ কোটি টাকার মতো খরচ করেছেন পিডি। সরকারি তহবিলের টাকা খরচের হিসাব বছর অনুযায়ী। ২২-২৩ অর্থবছরে সাড়ে ৫ কোটি টাকার একটি ব্যয়ে আমার অনুমোদন আছে। ১২ কোটি পিডি করেছেন।
তিনি বলেন, নির্মাতা সহযোগী প্রতিষ্ঠান কোরিয়ান সামিহ কন্সট্রাকশন লি. ও বর্তমান প্রকল্প পরিচালকের বিভিন্ন দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাতের তথ্য পাওয়ায় নৌপরিবহন অধিদপ্তরের একটি অভ্যন্তরীণ অডিট চলমান রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট প্রকল্প পরিচালক, পরামর্শক প্রতিষ্ঠানসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পিআইসি সভায় উত্থাপন করা হয়েছে। মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। অবশেষে কোরিয়ান নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের চারজন সদস্যকে প্রকল্প হতে বরখাস্ত করা হয়েছে বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে।
নানা অনিয়ম ও অভিযোগ প্রসঙ্গে প্রকল্প পরিচালক আবু সাইদ মো. দেলোয়ার রহমানের নিকট জানতে চাইলে বলেন, অভিযোগসমূহের বিষয়ে সুস্পষ্ট কারণ উল্লেখসহ লিখিত জবাব দিয়েই পদত্যাগপত্র দিয়েছি। তবে এখনো গৃহীত হয়নি। কারণ, ইচ্ছা করলেই পদত্যাগ কিংবা প্রতিস্থাপন করা যায় না। এজন্য কমিটি করা আছে। তাদের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। এদিকে একটি সূত্র বলছে, প্রকল্প পরিচালকসহ প্রকল্পের আরো দুই কর্মকতা এবং কোরিয়ান ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট দুর্নীতির অভিযোগে তাকে প্রত্যাহারের উদ্যোগ নেয়ায় মহাপরিচালকের বিরুদ্ধে একটি মহল বিভিন্ন অপপ্রচারে লিপ্ত হয়েছে। দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের রক্ষায় তৎপর হয়েছে একটি মহল। যা প্রকল্পের ভবিষ্যৎকে অনিশ্চয়তায় ফেলেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।