চাঁদপুরে পরিত্যক্ত ইটভাটায় বিষমুক্ত নানা জাতের বিদেশি ফল চাষ করে সফল হয়েছেন উদ্যোক্তা ও সাংবাদিক হেলাল উদ্দিন। তিন বছর আগে চাঁদপুর সদর উপজেলার শাহমাহমুদপুর ইউনিয়নের শাহতলী গ্রামের ডাকাতিয়া নদীর পাড়ে পৈতৃক পরিত্যক্ত ইটভাটায় বালু ভরাট করে ফ্রুটস ভ্যালি এগ্রো নামে একটি খামার গড়ে তোলেন তিনি। সেখানে তিনি বিশ্বখ্যাত ৪৭ জাতের আম চাষ করে ব্যাপক সাড়া ফেলেছেন। শুরু থেকে পরীক্ষামূলকভাবে সম্পূর্ণ অর্গানিক পদ্ধতিতে একের পর এক বিভিন্ন প্রজাতির ফল চাষ করে সফল হয়েছেন এই উদ্যোক্তা। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, তিনি ২০২০ সালে খামারটি গড়ে তোলেন। শুরু থেকে এখন পর্যন্ত উচ্চমূল্যের প্রায় অর্ধশতাধিক প্রজাতির বিদেশি ফলের আবাদ করেছেন তিনি। অধিকাংশ জাতই নতুন। এখানে প্রথমে বিদেশি রসালো ফল রকমেলন, মাস্কমেলন চাষ করেন এবং সফলও হন। এরপর থেকে নানা প্রজাতির ফলের চাষ করে সফল হন হেলাল উদ্দিন। বর্তমানে তার খামারে বিশ্বখ্যাত ৪৭ জাতের আম চাষ হচ্ছে। খামার ঘুরে দেখা গেছে, আম গাছে ঝুলছে নানা রঙের আম। কাঁচা-আধা পাকা আমে ভরে গেছে বাগান। থোকায় থোকায় ঝুলছে হালকা খয়েরি, হালকা কাঁচা হলুদ, লাল হলুদ ও সবুজ রঙের আম। আম গাছ পোকাণ্ডমাকড় থেকে রক্ষা করতে পরিচর্যায় ব্যস্ত রয়েছেন শ্রমিকরা। ফ্রুটস্ ভ্যালি এগ্রোতে চাষ করা বিদেশি ৪৭ জাতের আমের মধ্যে রয়েছে- টমি-এ্যাটকিনস, আতাউল্ফ, বেইলি মার্বেল লফানসো, মেন, হেডেন, মায়া, ভ্যালেন্সিয়া প্রাইড, ক্রিমমন প্রাইড, অস্টিন, অস্টিন গোল্ড, ক্যাংমিংটন প্রাইড, কারাবাও, রেড আইভরি, সিরাজকি, পারপল ডকমাই, নামডকমাই মিমওয়াং, কিং অব ঢাকাপাত, আরটুইউটু, ব্ল্যাকস্টোন, মেনসেশান, খ্রিটেস্ট, কন্ট, কেইট, পালমার (ফ্লোরিডা), রেইনবো, জুলিই, মহাচানক, লেমনয়েস্ট, কেষর, পুষা অরনিমা, পুষা আম্বিকা, পুষা অরনিকা, পুষা সুরিয়া, তোতাপুরি, দামেরি, নিলম, হানিডিউ, নামডকমাই, সুবর্ণরেখা, আপেল ম্যাংগো, চিলতাথাম, ক্যারিই, ওকরনটংগ (চায়নিজ), এমআর, গণেষ, বারি-৪, কাটিমন ইত্যাদি। উদ্যোক্তা হেলাল উদ্দিন বলেন, এ বাগানে আমরা অনেক ধরনের ফল চাষ করছি। তার মধ্যে এখন লঙ্গন, রামবুটান, অ্যাভোকাডা, ড্রাগন, আমসহ বিভিন্ন ধরনের বিদেশি ফল চাষ করা হচ্ছে। আমের মধ্যেই রয়েছে ৪৭ জাতের বিদেশি আম। প্রথমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের জনপ্রিয় ও উচ্চ ফলনশীন আম সংগ্রহ করি। তারপর পরীক্ষামূলকভাবে চাষ করি। পরে যেসব আম চাষ করে আমরা সফল হই তা সারা দেশে ছড়িয়ে দেই। এসব আম নিয়ে নতুন কৃষি উদ্যোক্তারা কাজ করে লাভবান হন। তিনি বলেন, এখানে ৪৭ জাতের যে আম রয়েছে তা বিভিন্ন ক্লাইমেট থেকে নেয়া। বিশেষ করে ইউরোপিয়ান, আমেরিকান, এশিয়ানসহ বিভিন্ন ওয়েদার থেকে সংগ্রহ করা। এগুলোকে দেশের আবহওয়া উপযোগী করে ফলনের চেষ্টা করি। এতে কিছু ক্ষেত্রে সফল ও ব্যর্থ হচ্ছি। যেগুলোতে সফল হচ্ছি ওইসব গাছের চারা তৈরি করে সারা দেশে আমরা ছড়িয়ে দেই। এই ৪৭ প্রজাতির আমগুলোতে সফল ফলন হয়েছে। এখন বছরে মাত্র তিন মাস আম থাকে। এই জাতগুলো যখন সারা দেশে ছড়িয়ে যাবে, তখন দেশে আমের একটা ভিন্ন চিত্র দেখা যাবে এবং সারা বছর আম পাওয়া যাবে। আমার এখানে মার্চণ্ডএপ্রিলে আম পাওয়া যাবে। এছাড়াও কিছু আম আছে নভেম্বর-ডিসেম্বর পাওয়া যাবে। আমরা বছরে ৬-৭ মাস আমের ফলন যদি ধরে রাখতে পারি তাহলে লাভবান হওয়ার সুযোগ আছে। মৌসুম ছাড়া আমের দাম বেশি থাকে। আমার এখানে ৩০০-১০০০ টাকা করে প্রতি কেজি আম বিক্রি করি। বাগান থেকেই ক্রেতারা কিনে নিয়ে যান। আমি মনে করি এগুলো দেশের জন্য সম্ভাবনার উচ্চ ফলনশীল আম। হেলাল উদ্দিন বলেন, আমরা এখানে কোনো ধরনের রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার করি না। আমরা চেষ্টা করি বিষমুক্ত ফল চাষ করতে। যার কারণে আমের মধ্যে দাগ পড়ে গেছে। যদি কড়াভাবে কীটনাশক ব্যবহার করতাম তাহলে এ দাগ পড়তো না। আমরা চাই ফলগুলোতে ন্যাচারাল যা আছে তাই থাকবে। তিনি বলেন, এখানে আমার অনেক টাকা বিনিয়োগ হয়েছে। যেহেতু আমি পরিত্যক্ত ইটভাটায় নিচু জমিতে বালু ভরাট করে বাগান তৈরি করেছি। বালুর মধ্যে বিদেশি আমের বাম্পার ফলন আনতে পেরেছি। এটা একটা বড় সাফল্য। আমার স্বপ্ন ছিল বিদেশি আমের জাতগুলো নিয়ে কাজ করার। এগুলো সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে পারলে ও চারা বিক্রি করতে পারলে লাভবান হবো। তিনি আরো বলেন, এখানে অনেক বেকার লোকের কমসংস্থান হচ্ছে। ১৫-২০ জন শ্রমিক কাজ করেন। তাদের প্রতি মাসে প্রায় দেড় লাখ টাকা বেতন দেই। জৈব সার উৎপাদন করে ফল গাছে প্রয়োগ করি। আধুনিক পদ্ধতিতে গাছগুলো পরিচর্যা করা হচ্ছে। নাজমুল খান নামে খামারের এক কর্মচারী বলেন, আমি এখানে দীর্ঘ তিন বছর ধরে কাজ করি। আমগুলো দেখে আমার কাছে খুবই ভালো লাগে। আমরা আম গাছের পরিচর্যা করি। গাছগুলোতে কোনো রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার করা হয় না। আরেক কর্মচারী বাপ্পি বলেন, আমাদের এখানে বিদেশি অনেক দামি আম গাছ আছে। প্রতিদিন বিকেল বেলা অনেক লোক নদীর পাড়ে ঘুরতে আসে। তারা আমগুলো কিনে নিয়ে যায়। স্থানীয় সাংবাদিক শরীফ আহমেদ বলেন, আমি এখানে ঘুরতে এসেছি। এখানে প্রায় ৪৭ প্রজাতির বিদেশি আম আছে। পরিত্যক্ত ইটভাটায় সাংবাদিক হেলাল ভাই খুবই সুন্দর একটা বাগান তৈরি করেছেন। তার এখানে বেশি-বিদেশি অনেক ধরনের ফল আছে। এখানে পরিবার-পরিজন নিয়ে ঘোরার পরিবেশ রয়েছে। আমি এখানকার আম খেয়েছি। খুবই সুস্বাদু। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. সাফায়েত আহম্মদ সিদ্দিকী বলেন, উদ্যোক্তা হেলাল উদ্দিনের বাগানে আম থেকে শুরু করে বিভিন্ন ফল-ফলাদি চাষ করা হয়। এটা একটা প্রশংসনীয় উদ্যোগ। আমরা এ ধরনের উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। তার এই কার্যক্রমের মাধ্যমে অন্যদের উদ্বুদ্ধ করা হবে। যাতে চাঁদপুরে আরো উদ্যোক্তা এবং ফলের বাগান সৃষ্টি হয়। সেই লক্ষ্যে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।
৪৭টি জাতের বিদেশি আম সম্পর্কে তিনি বলেন, আমের জাতগুলো ভালো এবং উৎপাদনশীল। আমের জাতগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে অন্যান্য চাষিদের মাঝে সম্প্রসারণ করা হবে।