ঢাকা ০৯ অক্টোবর ২০২৪, ২৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

কিশোরগঞ্জের রহস্যাবৃত ‘দিল্লির আখড়া’ হাওরের সেরা পর্যটন আকর্ষণ

কিশোরগঞ্জের রহস্যাবৃত ‘দিল্লির আখড়া’ হাওরের সেরা পর্যটন আকর্ষণ

‘দিল্লির আখড়া’ নামটির মধ্যেই রয়েছে ঐতিহাসিক ছাপ। স্থানটি ভারতের দিল্লির কোনো অংশ নয়। তবে, ভারতের দিল্লির সঙ্গে যোগসূত্র রয়েছে এ স্থানটিতে। কিশোরগঞ্জ জেলার হাওর অধ্যুষিত মিঠামইন উপজেলার শেষ প্রান্তে এর অবস্থান। দিল্লির সম্রাট জাহাঙ্গীরের স্মৃতিবিজড়িত এই দিল্লির আখড়াকে কেন্দ্র করে রয়েছে বিশাল খোলা জায়গা। আখড়ার চারিদিকে এই বিশাল জায়গায় রয়েছে প্রায় তিন হাজার হিজল গাছ। প্রাচীন এই আখড়া আর হিজলগাছগুলো হাওরের এক অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি, যা প্রকৃতি প্রেমিদের হাতছানি দিয়ে ডাকে। দিল্লির আখড়ার প্রতিষ্ঠাকাল সম্পর্কে জানা যায়, দিল্লির সম্রাট জাহাঙ্গীরের সময়ে সাধক নারায়ণ গোস্বামী এই আখড়া প্রতিষ্ঠা করেন। আখড়ার সেবায়েত বৈষ্ণবদের মতে দিল্লি আখড়ার বর্তমান বয়স প্রায় সাড়ে ৪০০ বছর। কিশোরগঞ্জের ইতিহাস গ্রন্থে উল্লেখ আছে, বিধঙ্গলের ‘রামকৃষ্ণ গোসাই’র মতাবলম্বী বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের আখড়ার মধ্যে মিঠামইনের দিল্লির আখড়াটি বিখ্যাত। হাওর এলাকার অন্যতম সেরা আকর্ষণ এই আখড়া। নদী তীরে হিজল গাছের সারি, প্রাচীন দেয়াল ও অট্টালিকা, ভিতরে অপূর্ব সুন্দর পরিবেশে যে কোনো আগন্তুককে কাছে টানবে। আখড়ার ভেতরে রয়েছে আধ্যাত্মিক সাধক নারায়ণ গোস্বামী ও তার শিষ্য গঙ্গারাম গোস্বামীর সমাধি। আরো রয়েছে ধর্মশালা, নাটমন্দির, অতিথিশালা, পাকশালা ও বৈষ্ণবদেব থাকার ঘর। আখড়ার দুই দিকে রয়েছে দুটি পুকুর। আর আখড়ার চারপাশে বিশাল এলাকাজুড়ে মৃত্তিকা বিদীর্ণ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে আখড়ার সময়কালের প্রায় তিন হাজার হিজল গাছ। দিল্লির আখড়া ও হিজল গাছগুলোকে কেন্দ্র করে এ অঞ্চলে প্রচলিত আছে কিংবদন্তি। গা ছমছম করা সে কাহিনী শুনে কিছুক্ষণের জন্য যে কেউ হারিয়ে যাবেন অন্য ভূবণে। প্রায় সাড়ে ৪০০ বছর আগের কথা, দিল্লির আখড়ার প্রতিষ্ঠাতা আধ্যাত্মিক সাধু নারায়ণ গোস্বামী ছিলেন পার্শ্ববর্তী বিতলঙ্গের আখড়ার আধ্যাত্মিক সাধক রামকৃষ্ণ গোস্বামীর শিষ্য। সে সময় এলাকাটি ঝোপজঙ্গলে পরিপূর্ণ ছিল, কোনো হিজল গাছ ছিল না। এলাকাটির চতুর্দিকে ছিল নদীবেষ্টিত। ফলে আখড়ার এলাকাটিকে মনে হতো দ্বীপের মতো। এ নদীপথে কোনো নৌচলাচল করতে পারত না। রহস্যজনক কারণে এ নদীপথে চলাচলকারী নৌকা ডুবে যেত বা অন্য কোনো দুর্ঘটনায় পতিত হতো, একদিন এ নদীপথে দিল্লির সম্রাট প্রেরিত একটি কোষা নৌকা মালামালসহ ডুবে যায়। আরোহীরা অনেক চেষ্টার পরও কোষাটি উঠাতে গিয়ে ব্যর্থ হন এবং তাদের একজন সর্পদংশনে মারা যান। বিতলঙ্গের সাধক রামকৃষ্ণ এ খবর পেয়ে শিষ্য নারায়ণ গোস্বামীকে এখানে আসার নির্দেশ দেন। গুরুদেবের নির্দেশ মোতাবেক সাধক নারায়ণ গোস্বামী এখানে এসে নদীর তীরে বসে তপস্যারত হলেন। হঠাৎ অলৌকিক ক্ষমতা বলে কে যেন তাকে হাত-পা বেঁধে নদীতে ফেলে দেয়। ঐশী মতাবলে তিনি তীরে উঠে আসেন। এভাবে প্রায় ৭ দিন একই ঘটনা ঘটান। একদিন দৈববাণীর মতো কে যেন বলল, আপনি এখানে থাকতে পারবেন না, এখান থেকে চলে যান। উত্তরে সাধক বললেন, তোমরা কারা? উত্তর আসল আমরা এখানকার বাসিন্দা।পূর্ব-পুরুষ ধরে এখানে আছি। আপনার কারণে আমাদের সমস্যা হচ্ছে। সাধক বললেন, তোমরা স্পষ্ট হও, অর্থাৎ রূপ ধারণ কর। সঙ্গে সঙ্গে তারা একেকটা বিকট দানব মূর্তি ধারণ করল। নারায়ণ গোস্বামী দেখলেন তার চারপাশে হাজার হাজার বিশালাকার দানব মূর্তি। যা দেখলে সাধারণত গা শিউরে উঠবে। এখন তাদের সঙ্গে সাধক নারায়ণ গোস্বামীর অনেক কথাবার্তা হয়। সিদ্ধান্ত হয় তিনিও থাকবেন, তারাও থাকবে। তবে তারা কারো কোনো ক্ষতি করতে পারবে না এবং নারায়ণ গোস্বামীর নির্দেশ পালন করবে। সাধক নারায়ণ গোস্বামী তাদের আদেশ করলেন, তোমরা আমার চতুর্দিকে সবাই হিজল গাছের রূপ ধারণ কর। তখন দানবদের প্রধান সাধুকে অনুরোধ জানিয়ে বললেন, সে যে হিজল গাছের মূর্তি ধারণ করবে, সেই গাছের নিচে বসে তপস্যা করতে। সাধু সে অনুরোধ মেনে নেয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যেকটি দানব একেকটি হিজলগাছের মূর্তি ধারণ করল। প্রতি অমাবস্যা-পূর্ণিমার রাতে এখানে ভোগ দেয়া হয়। আখড়ার ৩৭২ একর জমিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অদ্ভুত আকৃতির কয়েক হাজার হিজল গাছ। যা দূর দূরান্তের পর্যটকদের হাতছানি দিয়ে কাছে ডাকে। এদিকে সাধক নারায়ণ গোস্বামী তার ঐশী ক্ষমতাবলে সেই ডুবে যাওয়া কোষাটি মালামালসহ উঠিয়ে দেয় এবং সর্প দংশনে মৃত ব্যক্তিটিকেও বাঁচিয়ে তোলেন। পরে দিল্লির সম্রাট জাহাঙ্গীরের কাছে এ খবর পৌঁছানোর পর তিনি এখানে এসে সাধক নারায়ণ গোস্বামীর নামে বিশাল এলাকা লাখেরাজ দিয়ে একটি আখড়া প্রতিষ্ঠা করে দেন। সেই থেকে আখড়াটি ‘দিল্লির আখড়া’ নামে পরিচিতি হয়ে আসছে। সম্রাট জাহাঙ্গীর ১২১২ সালে আখড়ার নামে একটি তামার পাত্রে ওই জমি লিখে দেন। কিন্তু ১৩৭০ সালে ডাকাতরা এই পাত্রটি নিয়ে যায় বলে আখড়ার সেবায়তরা জানান। দিল্লির আখড়ায় প্রতি বছর ৮ চৈত্র মেলা বসে। এই মেলাকে কেন্দ্র করে এ অঞ্চলের সবাই মেতে ওঠেন উৎসবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত