বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিরাজমান বিভিন্ন অনিয়ম বন্ধের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের জন্য নানা সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি এবং বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার ক্ষেত্রে আরো স্বচ্ছতা নিশ্চিতে ২০১০ সালের বিদ্যমান আইনে ব্যাপক সংশোধনী আনছে সরকার। এতে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টিউশনফিসহ বিভিন্ন খাতে অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের সুযোগ বন্ধ, দরিদ্র ও মুক্তিযোদ্ধাসহ বিভিন্ন কোটা বাড়ানো হচ্ছে। বিদেশি ক্যাম্পাস পরিচালনায় নানা বিধিনিষেধ এবং লাভজনক পদে পর্ষদের স্বজনদের নিয়োগ বন্ধ করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) উদ্যোগে প্রণীত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় (সংশোধন) আইন-২০২২ এর খসড়া এরইমধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে বলে জানা গেছে। আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিংসহ পরবর্তী কার্যক্রম শেষে এটি জাতীয় সংসদের অনুমোদনের মাধ্যমে কার্যকর হবে।
এদিকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনের সংশোধনীতে শিক্ষার্থীদের জন্য নতুন কিছু সুযোগ বৃদ্ধির খবরে অভিভাবকদের মাঝে ইতিবাচক মনোভাব দেখা দিলেও উল্টো চিত্র মালিকদের মাঝে। এ প্রসঙ্গে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় মালিকদের সংগঠন-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির সচিব বেলাল আহমেদ আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১-এ বিভিন্ন সংশোধনীর কথা আমরা শুনেছি। এ বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রণালয় থেকে সমিতির প্রতিনিধিদের ডাকা হলে আমাদের মতামত তুলে ধরা হবে। এ বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি সংশ্লিষ্টদের আশ্বাস দিয়েছেন। তবে এখন পর্যন্ত যেসব সংশোধনীর কথা শোনা যাচ্ছে তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয় বলে মন্তব্য করেন তিনি।
বেলাল আহমেদ আরো বলেন, আইনের সংশোধনীতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাতাদের দূরে সরিয়ে দেয়ার যে উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে তা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য কোনো মঙ্গল হবে না। কারণ প্রতিষ্ঠাতাদের অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই।
এসব বিষয়ে ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক বিশ্বজিৎ চন্দ বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০ যুগোপযোগী করতে বেশ কিছু অধ্যায়ে আমূল পরিবর্তন আনা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ইচ্ছামতো টিউশন ফি নির্ধারণ, বোর্ড অব ট্রাস্টিজের নানা ধরনের অনিয়ম ও ইচ্ছামতো পরিবর্তনের অভিযোগ পাওয়া যায়। আইনে এসব বিষয় সুস্পষ্ট না থাকায় কঠিন হয়ে যায় সমাধান করা। এসব বিষয় নতুন করে যুক্ত করা হয়েছে। আরো সুস্পষ্ট করা হয়েছে দরিদ্র মেধাবী, মুক্তিযোদ্ধাসহ অন্য কোটার বিষয়টি।
তিনি বলেন, আইনের খসড়া শিক্ষামন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। সেটি মন্ত্রিপরিষদে পাঠানো হবে। এরপর আইন মন্ত্রণালয় থেকে ভেটিং বা ভাষাগত সংশোধন হয়ে পাঠানো হবে জাতীয় সংসদে। সংসদ থেকে অনুমোদন দেয়া হলে শিক্ষামন্ত্রণালয় থেকে চূড়ান্ত করে প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে কার্যকর করা হবে। জানা গেছে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় (সংশোধন) আইন-২০২২ এর খসড়া অনুযায়ী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনা পর্ষদে এক-তৃতীয়াংশ রাখা হবে শিক্ষাবিদ। পর্ষদ চাইলেই বোর্ড অব ট্রাস্টিতে কোনো ধরনের পরিবর্তন বা পরিমার্জন করতে পারবে না। কমিটির সদস্য বা তাদের পরিবারের সদস্যরা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাভজনক কোনো দায়িত্বে থাকতে পারবেন না। এতে বাড়ানো হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীসহ সুবিধাবঞ্চিতদের সুযোগ-সুবিধা ও কোটা। খসড়া আইনে প্রতি শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থী ভর্তিতে মোট আট শতাংশ আসন মুক্তিযোদ্ধা, গরিব মেধাবী, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, তৃতীয় লিঙ্গ, বিশেষ চাহিদাসম্পন্নদের জন্য বরাদ্দ রাখার কথা বলা হয়েছে। তাদের বিনা ব্যয়ে পড়ালেখার সুবিধা নিশ্চিত ও শিক্ষাব্যয়ে একটি ফি কাঠামো করে সেটি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) থেকে অনুমোদন নিতে হবে। এর বাইরে অতিরিক্ত কোনো অর্থ আদায় করা যাবে না।
সূত্রমতে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০ সংশোধনে গত ছয় মাস আগে ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক বিশ্বজিৎ চন্দকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। এতে ইউজিসির পরিচালক (বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়) ওমর ফারুককে সদস্য সচিব করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মাহামুদা আলমকে সদস্য করা হয়। তারা এ আইনের বিভিন্ন স্থানে পরিবর্তন ও সংযোজন করে একটি খসড়া শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছেন।
খসড়া আইনে আরো বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার ক্ষেত্রে বোর্ড অব ট্রাস্টিজে এক-তৃতীয়াংশ শিক্ষাবিদ রাখতে হবে। কমিশনের সুপারিশ ও সরকারের অনুমোদনক্রমে এ বোর্ডের কোনো পরিবর্তন, পরিবর্ধন বা পরিমার্জন করা যাবে। প্রয়োজনে ট্রাস্টি বোর্ডে কমিশন বা সরকারের মাধ্যমে সাময়িকভাবে একজন পর্যবেক্ষক মনোনয়ন করা হবে। খসড়ায় বলা হয়েছে, প্রস্তাবিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে সংরক্ষিত হতবিল হিসেবে ঢাকা ও চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন এলাকার জন্য ন্যূনতম আট কোটি, অন্য মেট্রোপলিটন এলাকার জন্য পাঁচ কোটি এবং এর বাইরে হলে তিন কোটি টাকা কমিশন নির্ধারিত তফসিলি ব্যাংকে সম্পূর্ণভাবে দায়মুক্ত অবস্থায় জমা রাখতে হবে। এ তহবিলের অর্থ ও লভ্যাংশ কমিশনের সুপারিশক্রমে অনুমোদন নিয়ে তোলা যাবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে কমপক্ষে পাঁচ একর নিষ্কণ্টক, অখণ্ড ও দায়মুক্ত জমি থাকতে হবে। তবে এ আইন কার্যকর হওয়ার আগে যারা সাময়িক অনুমতি বা সনদপ্রাপ্ত হয়েছে তাদের ক্ষেত্রে সেটি কার্যকর হবে না।
শিক্ষার্থী কোটার বিষয়ে বলা হয়েছে, প্রত্যেক শিক্ষাবর্ষে ভর্তিতে শতকরা তিন শতাংশ আসন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান বা তার সন্তানের সন্তান, ছয় শতাংশ মেধাবী অথচ দরিদ্র, প্রত্যন্ত অনুন্নত অঞ্চলের দরিদ্র শিক্ষার্থী, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন দরিদ্র বা তৃতীয় লিঙ্গের শিক্ষার্থী বা দরিদ্র বিধবা মায়ের সন্তান বা স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ হওয়া দরিদ্র মায়ের সন্তানদের ভর্তির জন্য সংরক্ষিত থাকবে। এসব শিক্ষার্থীকে কোনো ধরনের ফি ছাড়া সম্পূর্ণ বিনা খরচে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের সুযোগ দিতে হবে। প্রতিবছর এ তালিকা পাঠাতে হবে ইউজিসিতে।
বিভিন্ন কমিটির বিষয়ে সংশোধনী আইনে বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে বোর্ড অব ট্রাস্টিজ, সিন্ডিকেট, একাডেমিক কাউন্সিল, অর্থ কমিটি, শিক্ষক নিয়োগ কমিটি, শৃঙ্খলা কমিটি, একাডেমিক কমিটি, পরীক্ষা কমিটি এবং যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি গঠন করতে হবে। বোর্ড অব ট্রাস্টিজের কোনো সদস্য বিশ্ববিদ্যালয়ের লাভজনক পদে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো সভা বা কার্যক্রমে অংশ নেয়ার জন্য আর্থিক সুবিধা নেবেন না। এমনকি তাদের পরিবারের কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো লাভজনক পদে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি সার্টিফিকেট, ডিপ্লোমা ও ডিগ্রির মূল সনদে উপাচার্য এবং পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক যৌথভাবে স্বাক্ষরিত হতে হবে। থাকতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলমোহর। সাময়িক সনদে রেজিস্ট্রার ও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের যৌথভাবে এবং নম্বরপত্র/ট্রান্সক্রিপ্ট পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক স্বাক্ষরিত হতে হবে। দেশের আর্থ-সামজিক অবস্থার মানদ- সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি শিক্ষার্থী ফি কাঠামো প্রস্তুত করতে নিতে হবে কমিশনের অনুমোদন। সেটি পরিবর্তনের ক্ষেত্রেও কমিশনের অনুমোদন নিতে হবে। শিক্ষার্থী কোনো প্রোগ্রামে ভর্তির সময় যে ফি কাঠামোয় ভর্তি হবে তা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তা বাড়ানো যাবে না।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে কমিশনের গাইডলাইন অনুযায়ী বেতন কাঠামো ও চাকরি প্রবিধানমালা প্রস্তুত করে তা কমিশনের অনুমোদন নিতে হবে। নারীদের মাতৃত্বকালীন ছুটির বিষয়ে প্রযোজ্য হবে সরকারের জারি করা সবশেষ প্রজ্ঞাপন। শিক্ষাছুটিসহ অন্য ছুটি কমিশনের নীতিমালায় নির্ধারিত হবে। আইনের কোনো বিধান বা নির্দেশনা লঙ্ঘন করলে সেই প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির অপরাধের জন্য অনধিক ১০ লাখ টাকা জরিমানা করা যাবে। এটি সরকারি কোষাগারে জমা দেয়ার বিষয়টি যুক্ত করা হয়েছে। ইউজিসি সূত্রমতে, দেশে এ পর্যন্ত ১১২টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এরমধ্যে ১০২টিতে শিক্ষাকার্যক্রম চলছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা তিন লাখের বেশি।