ঢাবির আইন বিভাগে ‘নাইট কোর্স’
শিক্ষার পরিবেশ ও উদ্দেশ্য ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা
প্রকাশ : ২৪ মে ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
ঢাবি প্রতিনিধি
সম্প্রতি ‘প্রফেশনাল এলএলএম’ নামে একটি সান্ধ্যকালীন কোর্সের ভর্তি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ, যেটি নিয়ে ঘরে-বাইরে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। এটিকে ‘বাণিজ্যিক কোর্স’ আখ্যা দিয়ে তা বন্ধের দাবি জানিয়েছেন বিভাগটির শিক্ষার্থীরা। এ কোর্স চালু হলে তা বিভাগের উন্নয়নের থেকে ক্ষতি বেশি হবে বলে মনে করছেন তারা।
শিক্ষার্থীরা জানান, ২০১৭ সালের আগস্টে সান্ধ্যকালীন কোর্স চালুর উদ্যোগ নিয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে সিদ্ধান্ত বাতিল করতে বাধ্য হয় আইন বিভাগ। কিন্তু গত ১৭ মে আবারও এ কোর্স চালুর উদ্যোগ নিয়ে ভর্তি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে বিভাগটি। শিক্ষার্থীরা মনে করেন, বিভাগের শিক্ষকরা ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হওয়ার জন্য বাণিজ্যিক দৃষ্টিকোন থেকে এ কোর্স চালুর উদ্যোগ নিয়েছেন। বিপরীতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিক্ষার পরিবেশ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য। আবেদনের ন্যূনতম যোগ্যতা হিসেবে সিজিপিএ ২ দশমিক ৫০ নির্ধারণের বিষয়টি নিয়ে কেউ কেউ সমালোচনা করে বলেছেন, বেশিসংখ্যক শিক্ষার্থী পেতেই এত কম শর্ত দেয়া হয়েছে।
বিভাগের এমন সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়ে বিক্ষোভ মিছিল করেছে বিভাগটির সাধারণ শিক্ষার্থীরা। তাদের দাবি, বিভাগের উন্নয়নের নামে এ কোর্স চালু হলে আইন বিভাগের মর্যাদা ক্ষুণ্ন হওয়ার পাশাপাশি শিক্ষকদের বাণিজ্য করার একটি পথ উন্মুক্ত হবে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই বিভাগের এক শিক্ষার্থী আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, চলতি বছরের জানুয়ারিতে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) রাষ্ট্রপতির কাছে তাদের ৪৮তম বার্ষিক প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। সেই প্রতিবেদনে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য যে ১৭টি সুপারিশ আছে, তার একটি হচ্ছে সব ধরনের সান্ধ্য কোর্স বন্ধ করতে হবে। এর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলরও (রাষ্ট্রপতি) সান্ধ্য কোর্স বন্ধ করতে বলেছেন। কিন্তু এনারা এটা বুঝতে চাচ্ছেন না। এই কোর্সে এক বছরে একজন শিক্ষার্থীকে ২ লাখ ৪৮ হাজার টাকা কোর্স ফি দিতে হবে। একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্র কি এটা হতে পারে? তাদের উদ্দেশ্য মূলত বাণিজ্য করা।
শুধু আইন বিভাগের এমন সিদ্ধান্তে নাখোশ বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষার্থীরাও। প্রতিবাদের ভাষা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়িয়ে দেশের সর্বোচ্চ আদালতে ছড়িয়ে পড়ে। গত বুধবার সুপ্রিমকোর্ট প্রাঙ্গণে আইনজীবীরা এক প্রতিবাদ সভা করেন। তাদের দাবি, এই সিদ্ধান্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সাধারণ মাস্টার্সের মর্যাদাকে ক্ষুণ্ন করবে এবং এটা শুধু বাণিজ্যকরণের উদ্দেশ্য নিয়ে চালু করা হচ্ছে।
বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী ৪৩ ব্যাচের হাবিবুর রহমান আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, চ্যান্সেলর এবং ইউজিসি বারবার এই সান্ধ্য কোর্সগুলো বন্ধ করতে বলেছে। এই কোর্সগুলোতে ভর্তির ক্ষেত্রেও মেধার বদলে আর্থিক সামর্থ্য মূল যোগ্যতা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। শুরুতে ছোট পরিসরে, ব্যবসায়িক স্বার্থহীন একটি উদ্যোগ হিসেবে দেখালেও আমরা আশঙ্কা করছি, এটি অল্প দিনের মধ্যে একটি সার্টিফিকেট ফ্যাক্টরিতে পরিণত হবে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিও শুরুতে লাইসেন্স নেয়ার সময়ে শুধু মশলার ব্যবসার কথা বলেছিল। পরে দেখা গেল পুরো দেশটাই তাদের দখলে।
সাবেক এই শিক্ষার্থী আরো বলেন, যেসব ডিপার্টমেন্টে সান্ধ্য কোর্স আছে, সেখানে অনেক শিক্ষকের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ শোনা যায়। এ ধরনের অনিয়মিত কোর্স কিছু শিক্ষককে বিপথগামী করতে পারে। আবার, এখানে দুই সেমিস্টারের মাস্টার্স কোর্স শেষ করার জন্য সময়সীমা ধরা হয়েছে ৫ বছর। এর মানে কী? একবার টাকা দিয়ে ভর্তি হও, তারপর যা ইচ্ছে করো। কিছুদিন পরে আবার পড়তে ইচ্ছে করলে জরিমানা দিয়ে আবার শুরু করো। এখানে বাণিজ্যই মুখ্য বিষয়। আমরা এটা মেনে নিতে পারি না। আমরা মনেকরি, এ ধরনের কোর্স চালু করা অনৈতিক।
শুধু সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীই নয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনও আইন বিভাগের এমন সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে বিবৃতি দিয়েছে। সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের ঢাবি শাখা ‘বাণিজ্যিক’ কোর্স অ্যাখ্যা দিয়ে কোর্স বাতিলের তিন দফা দাবি জানায়। শুধু তাই নয় গণতান্ত্রিক ছাত্র জোটের ঢাবি শাখার সমন্বয়ক ও সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট, ঢাবি শাখা সভাপতি রাজীব কান্তি রায়, ছাত্র ইউনিয়ন ঢাবি সংসদের সভাপতি শিমুল কুম্ভকার, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট ঢাবি শাখার সভাপতি সাদিকুল ইসলাম সাদিক, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী ঢাবি শাখার আহ্বায়ক জাবির আহমেদ জুবেল, গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিল ঢাবির সংগঠক সাজিদ উল ইসলাম, বিপ্লবী ছাত্র যুব আন্দোলন ঢাবির সংগঠক আবরার ইফাজ এবং বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন ঢাবির সংগঠক মাহফুজ আহম্মেদ প্রশাসনের এমন সিদ্ধান্তের তীব্র নিন্দা জানিয়ে যৌথ বিবৃতি দিয়েছেন।
বিবৃতিতে তারা বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণার সাথে যেকোনো ধরনের বাণিজ্যিক কোর্স সাংঘর্ষিক। জনগণের করের টাকায় পরিচালিত অবকাঠামো ব্যবহার করে শিক্ষা ব্যবসার বিরোধিতা করছি আমরা। এসব বাণিজ্যিক কোর্সের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে প্রশাসন ও কোর্সের সাথে যুক্ত শিক্ষকরা। বিপরীতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিক্ষার পরিবেশ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য।
এর আগে, ২০২০ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিলের এক সভায় বিশ্ববিদ্যালয়ে চলমান সান্ধ্য কোর্সসহ অনিয়মিত সব কোর্সে নতুন শিক্ষার্থী ভর্তির সব ধরনের কার্যক্রম স্থগিত করা হয়। একই সঙ্গে এদিন সান্ধ্য কোর্স পরিচালনার সময়োপযোগী বিধিমালা প্রণয়ন করতে একটি কমিটিও করা হয়। করোনা পরিস্থিতির কারণে দীর্ঘদিন ওই কমিটির কার্যক্রম বন্ধ ছিল।
এর প্রায় ২ বছর পর ২০২২ সালের ২১ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিলে কমিটির করা বিধিমালা অনুমোদনের পরে নতুন নীতিমালার আলোকে ‘প্রফেশনাল ও এক্সিকিউটিভ মাস্টার্স প্রোগ্রাম’ ফের চালুর অনুমোদন দেয় সিন্ডিকেট। সে সময় বলা হয়েছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেক বিভাগ এ ধরনের সর্বোচ্চ একটি কোর্স চালু করতে পারবে। এসব কোর্সে শিক্ষার্থী ভর্তির কার্যক্রম শুরু করার আগে অনুমোদন নিতে হবে।
এদিকে আইন বিভাগ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষার্থীদের মানোন্নয়নে ও সিন্ডিকেটের নিয়ম মেনেই এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এই কোর্সের কো-অর্ডিনেটর অধ্যাপক নাঈমা হক আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটের দেয়া নিয়ম মেনেই এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। বাণিজ্যিকীকরণের যে কথা বলা হয়েছে এটা ঠিক না। আমাদের মূল চিন্তা হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন, শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন আর্থিক সহায়তা, আইন বিভাগের সম্প্রসারণ, ই-লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠাসহ বিভিন্ন ব্যাপারে আর্থিক স্ব-নির্ভরতা তৈরির জন্য কোর্স চালু করা হয়েছে। বেশ কিছু প্রাক্তন শিক্ষার্থী এ বিষয়ে আপত্তি তুলেছেন। বর্তমান শিক্ষার্থীদের মধ্যে কয়েকজন এটা চান না।
নিয়মিত কোর্সে শিক্ষকরা নিয়মিত ক্লাস নেন না কিন্তু সান্ধ্য কোর্সে নিয়মিত ক্লাস নেন শিক্ষার্থীদের এমন অভিযোগের জবাবে অধ্যাপক নাঈমা হক বলেন, আর এখানে যারা ক্লাস নেবেন, তারা তো নিয়মিত কোর্সেরও ক্লাস নেন। তারা তো এখানেই থাকতেছেন। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সব বিভাগেই এরকম অনিয়মিত কোর্স চালু আছে। আমাদের এখান থেকে যা আয় হবে, তা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাগার, অনুষদ মিলে প্রায় ৫৫ শতাংশ চলে যাবে। বাকি যে ৪৫ শতাংশ লভ্যাংশ তা বিভাগের উন্নয়নের জন্য ব্যয় হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান এটিকে বিভাগের এখতিয়ার উল্লেখ করে আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, এটা বিভাগের এখতিয়ার। তবে আমি বিভিন্ন মাধ্যমে এর প্রতিক্রিয়া শুনেছি। ওনারা তথ্য দিক। এটাতো বহু আগের সিদ্ধান্ত ছিল। নীতিমালার আলোকে ওনারা বললেন এটা শুধু পেশাজীবীদের জন্য। বিভাগের যদি সক্ষমতা থাকে, তাহলে পেশাজীবীদের জন্য এটা হতেই পারে।