পঞ্চগড়ে বিনা খরচে সুপারি আবাদ

বছরে ৩০ কোটি টাকার বাণিজ্য

জেলার সুপারির জাত, স্বাদ, রং আকারে বড় হওয়ায় বাজারে এর চাহিদা অনেক বেশি

প্রকাশ : ২৬ মে ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  পঞ্চগড় প্রতিনিধি

চা শিল্প খ্যাত জেলা পঞ্চগড়ে কৃষিতে লাভজনক পণ্য হয়ে উঠেছে সুপারি। কয়েক বছর ধরে ব্যাপক হারে সুপারির আবাদ হচ্ছে। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভাগীয় শহরসহ বিভিন্ন জেলায় রপ্তানি হচ্ছে এ জেলার সুপারি। কৃষি সম্প্রসারণ বলছে, বছরে এ জেলায় ৩০ কোটি টাকার সুপারি বেচাকেনা হবে। আর সে কারণে দিন দিন সুপারি চাষে আগ্রহী হয়ে পড়ছে চাষিরা।

স্থানীয়দের মতে, আবহমান কাল ধরেই বাঙালির খাবারের অনুষঙ্গ পান-সুপারি। পানের সাথে সুপারি লাগেই। বাড়িতে মেহমান আসলে পান-সুপারি না দিলে মর্যাদা ঠিক থাকে না। এ প্রথা যুগ যুগ ধরে লালিত হয়ে আসছে বাঙালিদের ঘরে ঘরে। এক সময় নিজেদের জন্য বাড়ির আঙিনায় সুপারি গাছ লাগালেও এখন বাণিজ্যিকভাবে আবাদ হচ্ছে সুপারি। জেলার বিভিন্ন জায়গা ঘুরে দেখা যায়, কেউ পতিত জমিতে, কেউ বাড়ির আঙিনায় আবার কেউ জমির সীমানা নির্ধারণ ঠিক রাখতে সারি সারি করে লাগিয়েছেন সুপারি গাছ। কয়েক বছর ধরে এ অঞ্চলে চা শিল্প বিপ্লবে মিশ্র চাষ হিসেবে চা বাগানে সুপারি গাছ লাগিয়েছেন চাষিরা।

জেলার তেঁতুলিয়া সদর বাজার, রনচন্ডী বাজার, শালবাহান হাট, ভজনপুরসহ বেশ কয়েকটি বাজারে গিয়ে দেখা যায়, প্রচুর পরিমাণে সুপারি বেচাকেনা হচ্ছে। ব্যবসায়ীদের অনেকে গ্রামে গ্রামে বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে চাষিদের কাছ থেকে সুপারি কিনছেন। চলতি মৌসুমে সুপারি প্রতি পণ ২৫০ থেকে ২৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর কয়েকদিন পর প্রতি পণ সুপারি বিক্রি হবে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত। এ জেলার সুপারির জাত, স্বাদ, রং আকারে বড় হওয়ায় বাজারে এর চাহিদা অনেক বেশি। তাই কৃষক দামও পাচ্ছে আশানুরূপ। ব্যবসায়ীরা বলছেন, পঞ্চগড়ের সুপারি অন্য এলাকার চেয়ে আকার, স্বাদ ও রঙে তুলনামূলকভাবে ভালো। এ কারণে দেশজুড়ে এখানকার সুপারির চাহিদা ব্যাপক। স্থানীয় বাজারের চাহিদা মিটিয়ে রাজধানীসহ বিভিন্ন জেলায় যাচ্ছে। চলতি মৌসুমে বিভিন্ন জেলা থেকে এসে ব্যবসায়ীরা এখানকার হাট-বাজার থেকে সুপারি কিনে নিয়ে যান। সুপারি ঘিরে আয় বেড়েছে বেকার তরুণ ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদেরও। তারা গ্রামে গ্রামে ঘুরে চাষিদের কাছ থেকে সংগ্রহ করছেন সুপারি। পরে তা বাজারে এনে বিক্রি করছেন বেশি দামে। অর্থকড়ি আসছে গৃহিনীদের হাতে। গৃহিনীরা সুপারি বেচা টাকায় ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচ ও তাদের কাপড়চোপড় কিনে দিচ্ছেন।

কালান্দিগঞ্জ এলাকার সোলেমান আলী জানান, তার বাড়িতে ৩শ সুপারি গাছ রয়েছে। বছরে সুপারি বিক্রি করেন দেড় থেকে দুই লাখ টাকা। একবার সুপারি গাছ রোপণ করলে বিশ থেকে পঁচিশ বছর পর্যন্ত সুপারি পাওয়া যায়। খরচ তেমন নেই বললেই চলে। সামান্য পরিচর্যা করলে এ থেকে বেশ টাকা আয় করা সম্ভব হচ্ছে।

গৃহিণী ফিরোজা আক্তার ও সেলিনা আক্তার জানান, আমাদের বাড়িতে ২০-২৫টি সুপারি গাছ আছে। তাতে করে প্রতি বছর বেশ ভালো টাকা পাই। এসব সুপারি বিক্রি করে ছেলেমেয়েদের পোশাক পরিচ্ছদ কিনে দিতে পারি, পড়ালেখার খরচও দিতে পারি। আরো চারা করেছি, সামনের বর্ষায় লাগাব।

সুপারি ব্যবসায়ী আসমত ও রবিউল ইসলাম জানান, এ এলাকার সুপারির সারা দেশেই চাহিদা রয়েছে। যশোর, ঢাকা, কুমিল্লা, সৈয়দপুর, বগুড়া, গাইবান্ধা, ও রাজশাহীসহ বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ হয়ে থাকে। সুপারি বিভিন্ন সাইজ হিসেবে বিভিন্ন দাম হয়ে থাকে। বর্তমানে বড় আকারের সুপারির পণ বিক্রি হচ্ছে ৩০০ থেকে ৩৮০ টাকা এবং মাঝারি আকারের সুপারি ২০০ থেকে ২৭০ টাকা পর্যন্ত পণ বিক্রি হচ্ছে। বিশেষ করে অন্যান্য ফসলের মতো সুপারি গাছের তেমন পরিচর্চা প্রয়োজন হয় না বা কিংবা কীটনাশক ও সেচের ব্যবহার হয় না। এ কারণে সুপারি চাষে লাভ বেশি।

কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, সুপারি চাষ বেশ লাভজনক। এ গাছ রোপণে তেমন কোনো পরিচর্যারও প্রয়োজন পড়ে না। নেই কোন ঝুট ঝামেলা। নেই তেমন খরচও। চৈত্র, বৈশাখ ও জ্যেষ্ঠ এই তিন মাস সুপারির মৌসুম। এ সময়ে একদিকে গাছে সুপারি পাকতে শুরু করে। অপরদিকে সুপারি গাছে নতুন করে ফুল ও ফল আসা শুরু হয়। প্রতি বছর সুপারি থেকে আয় হচ্ছে অর্থকড়ি। এক একটি গাছে সুপারির ফলন আসে ৪ থেকে ৫ পণ অর্থাৎ ৮০ থেকে ১০০ হালি। ৮০টি সুপারি ১ পণ। এপ্রিল থেকে শুরু হয় সুপারি আহরণ। জুন মাস পর্যন্ত চলে সুপারি বেচাকেনা। ফসলটি লাভজনক হওয়ায় দিন দিন জনপ্রিয় উঠছে সুপারি চাষ। এক খরচে ৩০ বছরের আয়ের উৎস হয়ে উঠেছে এ সুপারি চাষে। ফলে বিনা পুঁজিতে সুপারি বিক্রি করে প্রতি বছর লাভবান হচ্ছেন স্থানীয়রা।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক শাহ আলম মিয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, গড়ে ৬৫০ হেক্টর জমিতে সুপারি আবাদ হচ্ছে। এসব আবাদ থেকে বছরে এ জেলায় প্রায় ৩০ কোটি টাকা সুপারি বেচাকেনা হচ্ছে। সুপারি আবাদে এ জেলায় অর্থনীতি নতুনমাত্রা যুক্ত হয়েছে। সুপারি চাষে যেহেতু বাড়তি ঝামেলা ও খরচ নেই, একবার চাষ করতে পারলে কয়েক বছর এক আবাদেই অনেক টাকা আয় করা সম্ভব। আমরা কৃষি সম্প্রসারণ কার্যালয় হতে সুপারি চাষে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করছি।