ঢাকা ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

দেশের প্রথম মহাকাশচারী হতে নিজেকে প্রস্তুত করছে জোনাক

দেশের প্রথম মহাকাশচারী হতে নিজেকে প্রস্তুত করছে জোনাক

বাংলাদেশের প্রথম মহাকাশচারী হতে কঠোর পরিশ্রমে নিজেকে প্রস্তুত করছেন শাহজালাল জোনাক। ‘রকেট কমপ্লেক্স অ্যান্ড স্পেস সায়েন্স’ বিষয় নিয়ে পড়ছেন রাশিয়ার বাউমান মস্কো স্টেট টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটিতে। জোনাকই হতে যাচ্ছেন দেশের প্রথম মহাকাশচারী।

শাহ জালাল জোনাক পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ার ভজনপুরের অবসরপ্রাপ্ত প্রাথমিক শিক্ষক আবু বক্কর সিদ্দিক ও গৃহিণী সানজিদা শারমিন দম্পতির ছেলে। স্থানীয় ভজনপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা শেষ করে ভর্তি হন রাজধানীর রাজউক উত্তরা মডেল কলেজে। সেখান থেকে এসএসসি ও এইচএসসি শেষ করেন জোনাক। ২০১৮ সালের ২০ সেপ্টেম্বর সরকারি স্কলারশিপে উচ্চ শিক্ষার জন্য চলে যান রাশিয়ায়। ভর্তি হন রাশিয়ার বাওমান মস্কো স্টেট টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটিতে। এখন এ ইউনিভার্সিটিতে ‘রকেট কমপ্লেক্স অ্যান্ড স্পেস সায়েন্স’ বিষয়ে পড়াশোনা করছেন তিনি।

পড়ালেখার পাশাপাশি লিখেছেন বেশ কিছু বই। প্রকাশিত হয়েছে সাতটি বই। বইগুলোর মধ্যে বাংলা ভাষায় রচিত ‘মহাবিশ্বের মহাকাশ পাড়ি’ আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত হয়ে আলোচিত হয়েছে বইটি। অন্যান্য বইগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘ম্যাজিক অফ রুবিক’স কিউব, পদার্থ বিজ্ঞানের মজার প্রশ্ন ও উত্তর, জাতির পিতাকে নিয়ে লেখা তরুণ প্রজন্মের চিঠির সংকলন ‘প্রিয় বাবা’, শব্দ দিয়ে বুদ্ধির খেলা, শব্দের গল্প, পরিবেশ ও জলবায়ুর গল্প।

বই লেখা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্কুল-কলেজে বিজ্ঞান নিয়ে করেছেন সেমিনার। এসব সেমিনারে প্রায় লাখো শিক্ষার্থীর সামনে ক্যারিয়ার গঠন, সুনাগরিক, আত্মনির্ভরশীলতাসহ দেশ গঠনে অবদান রাখতে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য দিয়ে অনুপ্রাণিত করেছেন হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে।

জোনাক জানায়, ‘রকেট সায়েন্সে পড়াশোনাটা বেশ কঠিন এবং চ্যালেঞ্জিং। একটি রকেট ইঞ্জিনের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয় নিয়েই শুধু পড়তে হয় না। অতি কম সময়ে তা ইঞ্জিনের পরিবর্তনের বিষয়গুলো মাথায় রাখতে হয়। রকেটের ইঞ্জিন এমনভাবে প্রস্তুত করা হয় যে অতিদ্রুত পৃথিবী থেকে মহাকাশে পাড়ি জমাবে। তা না হলে পৃথিবীর অভিকর্ষজ বলের কারণে উপরে উঠতে পারবে না। তাই এখানে এক সেকেন্ডও অনেক বড় সময়। প্রথম স্টেজে রাশিয়ার তৈরি একটি সয়ুজ রকেট এক সেকেন্ডে প্রায় ২ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে ফেলে। যা চোখের পলকে যায় প্রায় ২ কিলোমিটার। যার কারণে রকেট নিয়ে পড়াশোনাটা খুব জটিল এবং চ্যালেঞ্জিং।

পৃথিবীর সবচেয়ে স্মার্ট মানুষ মহাকাশচারীরা। কারণ মহাকাশ খুব জটিল জায়গা। অনুমান করে সব কিছু করা যায় না। তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিতে হয়। এ সিদ্ধান্তের জন্য কারও উপর নির্ভর করলেও চলে না। এ জন্য খুব বিচক্ষণ এবং স্মার্ট মানুষকগুলোকেই মহাকাশচারী হিসেবে সিলেক্ট করা হয়। এমন মানুষকে নির্বাচন করা হয়, যারা যে কোনো পরিস্থিতিতে যে কোনো কিছু করতে পারে। ছোট্ট একটি সিদ্ধান্ত মহাকাশচারীদের জীবন বাঁচিয়ে দিতে পারে কিংবা কেড়ে নিতে পারে।

তাই মহাকাশচারী হিসেবে নিজেকে প্রস্তুত করতে আমি নিজে থেকেই ফ্লাইট ট্রেনিং করেছি। বেসিক ইমারজেন্সি মেডিক্যাল ম্যানেজমেন্টের ওপর কোর্স করেছি। আত্মরক্ষার জন্য গান শুটিং শিখেছি। সামনের দিকে আমার স্কাই ডাইভিং এবং স্কুবা ডাইভিংয়ের লাইসেন্স নেওয়ার পরিকল্পনা করেছি। প্রতিটি দেশের অ্যাস্পায়ারিং অ্যাস্ট্রোনটরা নিজেদের একজন ভালো, যোগ্য মহাকাশচারী প্রার্থী হিসেবে গড়ে তোলে। আমি সেভাবেই নিজেকে তৈরি করছি।

২০২২ সালের মার্চ মাসে রাশিয়ার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ‘রসকসমস’ এর নিমন্ত্রণে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে কাজাখস্থানে অবস্থিত রাশিয়ার বাইকোনুর কসমোড্রোম পরিদর্শন করার সুযোগ পান জোনাক। সেখানে থেকে রাশিয়ার মহাকাশচারীদের মহাকাশে পাঠানোর সকল কার্যক্রম নিয়ে জ্ঞান লাভ করেন। সরাসরি মহাকাশে রকেটের উৎক্ষেপণ পর্যবেক্ষণ করেন। ১৮ মার্চ জোনাকের বাংলা ভাষায় লেখা বই প্রথম মহাকাশে নিয়ে যান উৎক্ষেপিত মহাকাশ মিশনের কমান্ডার রাশিয়ান মহাকাশচারী ওলেগ আর্তেমইয়েভ। বইটি আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের লাইব্রেরিতে সংরক্ষণ করা হয়।

জোনাক জানান, ‘মহাকাশে বই পাঠানোর বিষয়টি মোটেও সহজ কোনো কাজ ছিল না। কারণ মহাকাশে কোনো কিছু প্রেরণ করা অনেক বেশি ব্যয়বহুল। রাশিয়ান মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ‘রসকসমস’ বিষয়টি বিবেচনা করে অনুমতি দেয়। ফলে বাংলা ভাষায় লেখা প্রথম কোনো বই আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের লাইব্রেরিতে সংরক্ষণ করা হয়।

রাশিয়াতে মহাকাশ বা রকেট নিয়ে পড়াশোনার মান খুবই ভালো। তবে একটু কঠিন, সেটা হলো- এখানে বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে রাশিয়ান ভাষায় পড়াশোনা করতে হয়। রাশিয়ান সরকার প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে প্রায় ১০০ জন শিক্ষার্থীকে শিক্ষাবৃত্তি দিয়ে রাশিয়াতে বিভিন্ন বিষয়ে পড়ার সুযোগ দেন। আমিও এই বৃত্তি নিয়েই রাশিয়াতে পড়তে এসেছি। ঢাকার ধানমন্ডিস্থ রাশিয়ান হাউস ইন ঢাকা প্রতিবছর এই শিক্ষাবৃত্তির সার্কুলার দিয়ে থাকে। তাই যারা রাশিয়াতে শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে পড়াশোনা করতে আসতে চায়, তারা সেখানে আবেদন করে নির্বাচিত হলে পড়তে আসতে পারবে।’

জোনাক আরও বলেন, ‘রকেট নিয়ে পড়াশোনা শেষ করে সবাই সচরাচর রকেট ইঞ্জিনিয়ার বা রকেট সায়েন্টিস্ট হিসেবে বিভিন্ন অ্যারোস্পেস বা স্পেস এজেন্সিতে কাজ করতে পারে, আমিও হয়তো সেটাই করতে পারব। তবে আমি চাই একজন মহাকাশচারী হতে। বাংলাদেশ থেকে এখনও কেউ মহাকাশচারী হয়নি। সেজন্য পড়ালেখার পাশাপাশি মহাকাশচারী হওয়ার জন্যও নিজেকে বিভিন্নভাবে প্রস্তুত করছি। মহাকাশচারী হওয়ার বিষয়টি যেহেতু একটি দেশের সরকারের ওপর অনেকটা নির্ভর করে, তাই এই মুহূর্তে বাংলাদেশ থেকে মহাকাশচারী হওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু আমি নিজেকে প্রস্তুত করছি।

বাংলাদেশ সরকার যখন চাইবেন, প্রথম বাংলাদেশি কাউকে মহাকাশচারী হিসেবে মহাকাশে পাঠাতে, তখন যেন আমাকে পাঠাতে পারে। দিন দিন অনেক নিয়ম পরিবর্তিত হচ্ছে। কোনো মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান যদি চায়, আমাকে বাংলাদেশি হিসেবে মহাকাশে পাঠাতে, সেজন্যও আমি নিজেকে প্রস্তুত করছি। এক্ষেত্রে সর্বদাই বিভিন্ন মহাকাশচারী আমাকে বিভিন্নভাবে পরামর্শ ও উপদেশ দিয়ে সাহায্য করছে। আমি সবার প্রতি অনেক বেশি কৃতজ্ঞ।’

‘বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের প্রতি আমার একটাই বলার আছে, সেটি হলো- কেউ যেন তার স্বপ্ন ছেড়ে না দেয়। স্বপ্নের পথে দাঁত কামড়ে লেগে থাকলে, সফলতা আসবেই। হয়তো কিছুটা সময় লাগবে, তবে কাজ করে গেলে, নিশ্চিত সফলতা আসবে। আর প্রতিটি মানুষের স্বপ্ন ভিন্ন, তাই যে যেই স্বপ্ন দেখতে পারে, সে সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেয়ার মতো সক্ষমতাও রাখে বলে আমি বিশ্বাস করি।’

জোনাকের রাশিয়ার সহপাঠি বন্ধু চার্লস ই জানান, ‘জোনাকের আমার প্রিয় বন্ধুগুলোর মধ্যে একজন। জোনাকের লেখা একটি বই এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে গিয়েছে, যা আমাদের সবার জন্যই খুব খুশির একটি খবর। এটি মহাকাশে যাওয়া বাংলা ভাষার প্রথম বই এবং আমি বিশ্বাস করি জোনাক একদিন বাংলাদেশের মহাকাশচারীও হবে।’

জোনাকের বাবা আবু বক্কর সিদ্দিক ও মা সানজিদা শারমিন জানান, ‘নিজের সন্তানের কথা বলতে কিছুটা অস্বস্তিই লাগে; কিন্তু ছোটবেলা থেকেই জোনাক সব সময় আউট অব দ্য বক্স চিন্তা করে। আমরা তার স্বপ্নকে সাপোর্ট দিতে চেষ্টা করেছি।

তারপরেও অনেক প্রতিবন্ধকতা তো ছিলই। সে ওর মতো করেই চেষ্টা করে এতোদূর এগিয়ে গেছে। এখানে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েই ঢাকায় চলে যায়। সেখানে রাজউক উত্তরা মডেল কলেজ থেকে পড়ালেখা করে এসএসসি ও এইচএসসিতে ভালো রেজাল্ট করে। পরে সেখান থেকে সরকারি স্কলারশিপ পেয়ে এখন রাশিয়ার বাওমান মস্কো স্টেট টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটিতে ‘রকেট কমপ্লেক্স অ্যান্ড স্পেস সায়েন্স’ বিষয়ে পড়াশোনা করছে। সে এর মধ্যে বেশ কয়েকটি বই লিখেছে। তার একটি বই আন্তর্জাতিক মহাকাশের লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত হয়েছে। সবাই আমার ছেলের জন্য দোয়া করবেন। ও যেন তার স্বপ্ন জয় করে মহাকাশচারী হতে পারে। দেশের মুখ উজ্জ্বল করতে পারে।’

স্কুল শিক্ষক রেবেকা সুলতানা বলেন, ‘শাহ জালাল জোনাক আমাদের ভজনপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র ছিল। স্কুলের পড়ালেখা থেকে শুরু করে সবকিছুতেই সে অনেক বেশি অনুসন্ধিৎসু ও তার জানার আগ্রহ ছিল। সে বিজ্ঞান নিয়ে পড়ালেখা করতে চেয়েছিল। আজ তার সে স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। রাশিয়ার মতো একটি দেশে ‘রকেট কমপ্লেক্স অ্যান্ড স্পেস সায়েন্স’ নিয়ে পড়ালেখা করছে। এটা আমাদের জন্য অত্যন্ত গর্বের। আমরা দোয়া করি সে যেন তার স্বপ্নজয় করতে পারে। দেশ ও আন্তর্জাতিকভাবে কাজ করতে পারে।’

পঞ্চগড় মকবুলার রহমান সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ দেলোয়ার হোসেন প্রধান আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, শাহ জালাল জোনাক আমার এলাকার কৃতিসন্তান। সে ভবিষ্যতে মহাকাশচারি হতে রাশিয়ার বাওমান মস্কো স্টেট টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটিতে ‘রকেট কমপ্লেক্স অ্যান্ড স্পেস সায়েন্স’ নিয়ে পড়ালেখা করছে। সে লেখাপড়ার পাশাপাশি বেশ কয়েকটি বইও লিখেছে। সেসব বইয়ের মধ্যে ‘মহাবিশ্বের মহাকাশ পাড়ি’ আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত হয়ে আলোচিত করেছে। যা অত্যন্ত গর্বের বিষয়। তার জন্য দোয়া করছি, সে আরও এগিয়ে যাক। তার স্বপ্নপূরণ হয়ে দেশের জন্য ভালো কিছু করুক।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত