ঢাকা ১১ অক্টোবর ২০২৪, ২৭ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

কক্সবাজার পৌর নির্বাচন

মাহাবুবুরের গলার কাঁটা আওয়ামী লীগ

মাহাবুবুরের গলার কাঁটা আওয়ামী লীগ

কক্সবাজার পৌরসভার নির্বাচনে মেয়র পদে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহী প্রার্থী ও সমর্থিত নেতাকর্মীদের লাগামহীন প্রচার-প্রচারণায় পরিস্থিতি ক্রমেই উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। এ নিয়ে নির্বাচনের স্বাভাবিক পরিস্থিতি অবনতি হওয়ার আশংকা করছেন সচেতন মহল।

মেয়র পদে ৫ জন প্রার্থী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলেও মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা প্রতীকের প্রার্থী মো. মাহাবুবুর রহমান চৌধুরী এবং অপরজন নাগরিক কমিটির ব্যানারে নারিকেল গাছ প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী মাসেদুল হক রাশেদের মধ্যে।

মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী অপর তিনজন প্রার্থী হলেন- স্বতন্ত্র প্রার্থী মাসেদুল হক রাশেদের স্ত্রী জোছনা হক (মোবাইল প্রতীক), স্বতন্ত্র প্রার্থী নির্বাচন পাগল খ্যাত জগদীশ বড়ুয়া (হেলমেট প্রতীক) এবং বাংলাদেশ ইসলামী আন্দোলন প্রার্থী মো. জাহেদুর রহমান (হাত পাখা)।

এবারের নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াতের কোনো প্রার্থী না থাকায় মূল লড়াই হবে আওয়ামী লীগের জেলা কমিটির সদ্য সাবেক দুই নেতাকে ঘিরে। কিন্তু নির্বাচনের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে ওই দুই প্রার্থীকে ঘিরে দলীয় নেতাকর্মীরা বিভক্ত হয়ে ততই লাগামহীন হয়ে উঠেছেন। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী মাসেদুল হক রাশেদকে একাধিকবার নির্বাচন কর্মকর্তা সতর্ক করে নোটিশ প্রদানের পরও আচরণবিধি লংঘন অব্যাহত রেখেছে। এছাড়া আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচনি প্রচারণায় অংশগ্রহণকারী নেতাকর্মীদের প্রকাশ্যে এবং মোবাইল ফোনে একের পর এক হুমকি প্রদান অব্যাহত রেখেছে বলে অভিযোগ ঊঠেছে। এ ব্যাপারে ১ জুন জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা ও রিটার্নিং অফিসার বরাবর লিখিত অভিযোগও করেছেন আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী।

জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা বরাবর দায়েরকৃত অভিযোগে বলা হয়েছে, ‘আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী ও স্বতন্ত্র প্রার্থী মাসেদুল হক রাশেদের আপন ছোট ভাই শাহীনুল হক মার্শাল জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এবং কায়সারুল হক জুয়েল সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান। তারা স্বতন্ত্র প্রার্থী মাসেদুল হক রাশেদের পক্ষে আটঘাট বেঁধে নির্বাচনি প্রচারণায় মাঠে নেমেছে।

জনপ্রতিনিধিত্বকারী দুই ভাই সরকারি গাড়ি ব্যবহার, সরকারি বরাদ্দ প্রকাশ্যে নির্বাচনীয় সভায় বিতরণ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের প্রবীণ এবং বিদগ্ধ রাজনৈতিক ব্যক্তিদের নিয়ে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য ও আচরণের অভিযোগ আনা হয়েছে। এতে সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহারের পাশাপাশি নির্বাচনি পরিবেশ ক্রমাগত সংঘাতময় হয়ে উঠার আশংকার সৃষ্টি হয়েছে।

কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, আগামী ১২ জুন কক্সবাজার পৌরসভার নির্বাচনে মেয়র পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়া মো. মাহাবুবুর রহমান মাবু জেলা কমিটির সাবেক সদ্য সাংগঠনিক সম্পাদক। সম্মেলনের পর জেলা কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের ২টি পদ ঘোষণা করা হলেও এখনো পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা হয়নি।

আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী মাহাবুবুর রহমার মাবু চট্টগ্রাম সরকারি সিটি কলেজ ছাত্র সংসদের এজিএস, কক্সবাজার শহর ছাত্রলীগের আহ্বায়ক, জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক, জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক ও জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে দীর্ঘ ৩৭ বছর ধরে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি কক্সবাজার পৌরসভার টানা তিনবারের কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র। পৌরসভার ভারপ্রাপ্ত মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন টানা ৩ বছর। শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত পছন্দে তাকে মনোনয়ন প্রদান করা হলেও ক্ষুব্ধ হন মাসেদুল হক রাশেদ। জেলা কমিটির সদ্য সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মাসেদুল হক রাশেদ বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে স্বতন্ত্র মেয়র পদে প্রার্থী হন।

এদিকে মেয়র পদপ্রার্থী মাহাবুবুর রহমানের মনোনয়নের সূত্র ধরে বদলে গেছে কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক হালচাল। মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা মরহুম একেএম মোজাম্মেল হক ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ট সহচর এবং দলের আস্থাভাজন নেতা। আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা উনাকে চাচা বলে ডাকতেন। গত ২০০৫ সালে মোজাম্মেল হকের মৃত্যুর পরও উনার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে একান্ত যোগাযোগ ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। সেই পরিবারের সন্তান দলীয় মনোনয়ন চেয়ে বঞ্চিত হওয়ায় ক্ষুব্ধ হন স্বতন্ত্র প্রার্থী মাসেদুল হক রাশেদ।

নির্বাচনকালিন পরিস্থিতিতে এরই মধ্যে মাসেদুল হক রাশেদকে দলকে বহিষ্কার করেছে জেলা আওয়ামী লীগ। তাদের ছোট্ট ভাই কক্সবাজার সদর উপজেলায় আওয়ামী লীগ মনোনীত চেয়ারম্যান প্রার্থী চেয়ারম্যান কায়সারুল হক জুয়েলকে জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগ থেকে বহিষ্কার করেছে কেন্দ্রিয় কমিটি। এছাড়া জেলা যুব মহিলা লীগের সভানেত্রীর পদ থেকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করে ভাইয়ের পক্ষে নির্বাচনি প্রচারণায় নেমেছেন তাহমিনা চৌধুরী লুনা। সাথে রয়েছেন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে জেলা পরিষদের নির্বাচিত চেয়ারম্যান শাহিনুল হক মার্শাল। কিন্তু তাদের মেঝ ভাই শাহিদুল ইসলাম সোহেল জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নৌকা প্রতীকের পক্ষে প্রকাশ্যে প্রচারণায় অংশ নিতে দেখা গেছে। এছাড়া জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান পৌর মেয়র মুজিবুর রহমান তাদের চাচাত ভাই। দীর্ঘদিন ধরে রাশেদদের সাথে মুজিবের রাজনৈতিক বিরোধ রয়েছে। ফলে নৌকা প্রতীকের পক্ষে জোর তৎপরতায় নিয়ে মাঠে রয়েছেন মুজিব।

এ পরিস্থিতি বিদ্রোহী প্রার্থী হলেও মাসেদুল হক রাশেদ ও তার পরিবারের সদস্যসহ সমর্থিত লোকজন অনেকটা লাগামহীন হয়ে প্রচারণা চালাচ্ছে। কক্সবাজার জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা ও রিটানিং কর্মকর্তা বরাবরে বৃহস্পতিবার আচরণবিধি লংঘনের অভিযোগে একটি আবেদন করেছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী মো. মাহাবুবুর রহমান মাবু।

এতে বলা হয়েছে, স্বতন্ত্র প্রার্থী রাশেদের ভাই শাহিদুল হক মার্শাল নির্বাচনি প্রচারণার কৌশল হিসেবে সরকারি গাড়ি ব্যবহার, জেলা পরিষদের বরাদ্দের চেক প্রদান করছেন। একই সঙ্গে ছোট ভাই কায়সারুল হক জুয়েল সরকারি গাড়ি ব্যবহার এবং গাড়িতে লাইসেন্সকৃত অস্ত্র নিয়ে প্রচারণা চালাচ্ছেন। এই দুই ভাই নির্বাচনি সভায় প্রধানমন্ত্রীর শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কটূক্তি এবং বরেণ্য রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও সরকারি দলের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে মানহানিমূলক বক্তব্য প্রদান করে নির্বাচনি পরিবেশ অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে।

এ নিয়ে একাধিকবার সতর্ক করে নোটিশ প্রদানের পরও মাসেদুল হক রাশেদ আচরণবিধি লংঘন করে প্রচারণা চালাচ্ছেন। পাশাপাশি স্বতন্ত্র প্রার্থী রাশেদ ও তার ভাইয়েরাসহ বিদ্রোহী প্রার্থীর কর্মি-সমর্থকরা আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীর পক্ষের নেতাকর্মীদের প্রকাশ্যে হুমকি প্রদান অব্যাহত রেখেছেন। আবেদনে এসব বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান মেয়র প্রার্থী মাহাবুব।

কক্সবাজার পৌরসভা নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা ও জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা এসএম শাহাদাত হোসেন জানান, প্রার্থী মাহাবুবের এ সংক্রান্ত একটি লিখিত অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য কক্সবাজার পুলিশ সুপারের নিকট পাঠানো হয়েছে।

জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা এসএম শাহাদাত হোসেন জানান, একাধিক প্রার্থী ধারাবাহিক আচরণবিধি লংঘন করছেন বলে অভিযোগ আসছে। এসব অভিযোগ সত্যতা পাওয়ার পর আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। এর মধ্যে স্বতন্ত্র প্রার্থী মাসেদুল হক রাশেদের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগের সত্যতাও পাওয়া গেছে। এসব অভিযোগের ব্যাপারে তাকে সতর্ক করে নোটিশও প্রদান করা হয়েছে। গত বুধবার (৩১ মে) রাতে আচরণবিধি লংঘন করে পরিচালিত এই প্রার্থীর কয়েকটি নির্বাচনী কার্যালয় বন্ধ করা হয়েছে। সতর্ক করার পর আচরণবিধি না মানলে কমিশনের সিদ্ধান্ত মতে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

কক্সবাজার জেলা তাঁতী লীগের সভাপতি আরিফ উল মওলা জানান, নির্বাচনে শেখ হাসিনার প্রতীক নৌকার পক্ষে কাজ করা নেতাকর্মীদের দায়িত্ব। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে বিদ্রোহী প্রার্থীর ভাইসহ অন্যান্যরা চরম সংঘাতময় আচরণ শুরু করেছেন। এরই মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার হওয়া বক্তব্যে শোনা গেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে বিরূপ বক্তব্য, সংবিধান প্রণেতা বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার কাছে সম্মান পাওয়া বিদগ্ধ রাজনৈতিক মরহুম অ্যাডভোকেট জহিরুল ইসলামকে নিয়ে মিথ্যা এবং অপমানজনক কথা বলা, অন্যান্য সিনিয়রদের নিয়ে একই ধরনের আচরণ এবং প্রকাশ্যে হুমকি প্রদান করা হচ্ছে। এতে মনে হচ্ছে বিদ্রোহী প্রার্থী ইচ্ছে করেই নির্বাচনি পরিবেশ সংঘাতের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন।

কক্সবাজার পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহাম্মদ নজিবুল ইসলাম জানান, বিদ্রোহী স্বতন্ত্র প্রার্থী নিজের জনপ্রিয়তা বাড়াতে গিয়ে একের পর এক কুরুচিপূর্ণ কথা বলে যাচ্ছেন। প্রার্থীর মরহুম পিতাও একজন বিদগ্ধ রাজনৈতিক ব্যক্তি। তাদের পক্ষেও কিছু সমর্থক রয়েছেন। তাদের আচরণটা কিছুটা লাগামহীন মনে হচ্ছে। বিশেষ করে এরই মধ্যে পৌর যুবলীগের আহ্বায়ক শোয়েব ইফতেখার, পৌর আওয়ামী লীগের কয়েকটি ওয়ার্ডের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদককে ফোন করে হুমকি প্রদান করেছেন। বিষয়টি একটি জটিলতার দিকে যাচ্ছে। যা স্বাভাবিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে প্রতিবন্ধকতা তৈরির চেষ্টা করছেন বিদ্রোহী প্রার্থী।

কক্সবাজার জেলা পুলিশ সুপার মো. মাহাফুজুল ইসলাম জানিয়েছেন, জেলা নির্বাচন কার্যালয়ের চিঠিটি এখনও হাতে পৌঁছেনি। পৌঁছার পর আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

এসব অভিযোগ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে প্রার্থী মাসেদুল হক রাশেদ বলেন, জনগণই আমাকে ভোটে নামিয়েছে। জনগণ ভোট দিতে পারলে আমার বিজয় কেউ ঠেকাতে পারবে না। বাবা মোজাম্মেল হকের দেখানো পথে পৌরবাসীর সেবায় থাকতে চাই। কিন্তু আমার বিজয় দেখে আওয়ামী লীগের প্রার্থী নানা অভিযোগ ও অপপ্রচার চালাচ্ছে। আমি কাউকে হুমকি দিয়েছি বা আচরণবিধি লংঘন করেছি এটা তারাই প্রমাণ করুন। এটা নিয়ে আমার কোনো মন্তব্য নেই।

তিনি নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনকে নিরপেক্ষা অবস্থানে দাঁড়িয়ে নির্বাচনের পরিবেশ রক্ষার দাবি জানিয়ে বলেন, আমি গাজীপুরের মতো নির্বাচন চাই। তা হলে আমি মেয়র নির্বাচিত হব।

কক্সবাজার জেলা নির্বাচন কার্যালয়ের তথ্য মতে, কক্সবাজার পৌরসভার ১২টি ওয়ার্ডে ভোটার সংখ্যা ৯৪ হাজার ৮০২ জন। পুরুষ ভোটার ৪৯ হাজার ৮৭৯ ও নারী ভোটার ৪৪ হাজার ৯২৩ জন। ১২টি ওয়ার্ডের ৪৩টি কেন্দ্রে ইভিএমে ভোটগ্রহণ হবে আগামী ১২ জুন।

আলোকিত বাংলাদেশ
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত