ঢাকা ১২ অক্টোবর ২০২৪, ২৮ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

চালকের অবহেলা ও ঝিমুনিভাব

সিলেটে সড়কে প্রাণ গেল ১৪ নির্মাণ শ্রমিকের

* স্বজনদের আহাজারি * হাসপাতালে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী
সিলেটে সড়কে প্রাণ গেল ১৪ নির্মাণ শ্রমিকের

চালকের অবহেলা ও ঝিমুনিভাবের কারণে সিলেট-ঢাকা মহাসড়কের দক্ষিণ সুরমার নাজিরবাজারের কুতুবপুরে সড়কে গতকাল ভোরে ১৪ নির্মাণ শ্রমিকের প্রাণহানি হয়েছে বলে ধারণা করছে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস। পিকআপ ভ্যানের যাত্রী, সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার ভাটপাড়া গ্রামের বাসিন্দা পল্লব আহমদ জানান, চালক ঘুমিয়ে যাওয়ার কারণে মূলত মর্মান্তিক এ দুর্ঘটনা ঘটেছে। তিনি জানান, ট্রাকটি যখন ডান পাশ থেকে পিকআপ ভ্যানটিকে ধাক্কা দেয়, তখন খুব জোরে শব্দ হয়। ধাক্কা খেয়ে পিকআপটি উল্টে গিয়ে যাত্রীরা এর নিচে পিষ্ট হন। চালক ঘুমিয়ে যাওয়ার ফলেই এমনটি হয়েছে বলে জানান ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসাধীন পল্লব। দক্ষিণ সুরমা থানার ওসি শামসুদ্দোহা পিপিএমের মতে, চালকের অবহেলার ফলেই এমন দুর্ঘটনা ঘটেছে। দুর্ঘটনার পর দুই চালকই পলাতক। সিলেট ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক মনিরুজ্জামানের মতে, চালকের শারীরিক দুর্বলতা ও ঝিমুনিভাবের কারণে এমন ঘটনা ঘটেছে বলে তারা ধারণা করছেন। এ ঘটনায় এ পর্যন্ত ১৪ জনের মৃত্যুর পাশাপাশি ১৪ জন ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন বলে ওসমানী মেডিকেল কলেজ পুলিশ তদন্ত কেন্দ্র সূত্রে জানা গেছে।

নিহতরা হলো: সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার মো. সিজিল মিয়া (৫৫), একলিম মিয়া (৫৫), হারিছ মিয়া (৬৫), সৌরভ মিয়া (২৭), সাজেদুর (৬০), বাদশা মিয়া (৩০), সাধু মিয়া (৫০), রশিদ মিয়া (৫০) ও মেহের (২৫); সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জ উপজেলার শাহীন মিয়া (৪০), দুলাল মিয়া (২৬) ও আওলাদ হোসেন (৫০); হবিগঞ্জের চুনারুঘাটের আমিনা বেগম (৪৫) এবং নেত্রকোনা বারহাট্টার আওলাদ মিয়া (৪০)। সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের (এসএমপি) অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (মিডিয়া) সুদীপ দাস জানান, স্বজনদের মাধ্যমে নিহত ব্যক্তিদের নামণ্ডপরিচয় জানা গেছে। মরদেহগুলো সিলেটের এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে রাখা হয়েছে। আইনি প্রক্রিয়া শেষে মরদেহগুলো পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে বলে জানান এই পুলিশ কর্মকর্তা। নিহত ও আহত শ্রমিকরা বর্তমানে সিলেট নগরীর বিভিন্ন স্থানে ভাড়া বাসায় বসবাস করতেন বলে তিনি জানান। তারা সবাই ঢালাই কাজের শ্রমিক। প্রতিদিন সকালে তারা নগরীর আম্বরখানা ও উপশহর এলাকায় এসে জড়ো হন। সেখান থেকে তাদের ঢালাই কাজের জন্য চুক্তি করে বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যান ঠিকাদাররা। নিহত শ্রমিকরাও সিলেটের ওসমানীনগর উপজেলার গোয়ালাবাজার এলাকার একটি নির্মাণাধীন বাসার ঢালাই কাজের জন্য পিকআপযোগে যাচ্ছিলেন। পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও স্থানী সূত্রে জানা যায়, সিলেট থেকে ছেড়ে যাওয়া পিকআপে প্রায় ৩০ জন নির্মাণ শ্রমিক গোয়ালাবাজার যাচ্ছিলেন। ভোর সাড়ে ৫টার দিকে দক্ষিণ সুরমার নাজিরবাজার এলাকার কুতুবপুর নামক স্থানে পৌঁছলে মুন্সীগঞ্জ থেকে ছেড়ে আসা সিলেটগামী মালবোঝাই ট্রাকের সঙ্গে শ্রমিক বহনকারী পিকআপের সংঘর্ষ হয়। খবর পেয়ে দক্ষিণ সুরমা থানা পুলিশ এবং সিলেট ও ওসমানীনগরের ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের ৬টি ইউনিট ঘটনাস্থলে এসে স্থানীয়দের সহযোগিতায় হতাহতদের উদ্ধার করে ওসমানী হাসপাতালে পাঠায়। দুর্ঘটনায় হতাহতদের স্বজনদের আহাজারিতে ভারি হয়ে ওঠে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিবেশ।

আহত-নিহতদের স্বজনদের কান্নার রোল পড়ে হাসপাতালজুড়ে। নিহতদের মধ্যে আছে কারো বাবা, কারো ভাই কিংবা কারো স্বামী ও নিকটাত্মীয়। হাসপাতালের বারান্দায় দাঁড়িয়ে কাঁদছিলেন নিহত দুলাল মিয়া (২৬) এর ছোটভাই আব্বাস মিয়া (১৯)। তাকে সান্ত¡না দেয়ার চেষ্টা করছিলেন পাশে থাকা তার দাদাসহ স্বজনরা। তার দাদা নুর মোহাম্মদ জানান, দুলালের বড় ভাই হেলাল আহমদ প্রায় ৭ মাস আগে দুর্ঘটনায় মারা যান। তিনি স্ত্রী ও আড়াই বছরের এক সন্তান রেখে যান। মাসখানেক আগে বিয়ে করেন দুলাল মিয়া। বিয়ের দুই সপ্তাহ পর কাজের জন্য সিলেটে আসেন দুলাল। থাকতেন আম্বরখানা ইলেকট্রিক সাপ্লাই এলাকার ভাড়া বাসায়। দুর্ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও নিহত সাজেদুরের ভাই শের ইসলাম (৫৫) জানান, হঠাৎ করে বিপরীতমুখী একটি ট্রাক আমাদের দিকে ছুটে এসে ধাক্কা দেয়। মুহূর্তেই লন্ডভন্ড হয়ে যায় আমাদের সবকিছু। সকাল ৭টার পর থেকেই ওসমানী হাসপাতালের প্রাঙ্গণে হতাহতদের স্বজনরা ভিড় করেন। তাদের অনেকের কান্নায় হাসপাতালের বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। নিহতদের মরদেহ ওসমানী হাসপাতালে রাখা হয়েছে। আইনি প্রক্রিয়া শেষে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে। সেজন্য অপেক্ষা করছেন স্বজনরা। হাসপাতালে প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী সিলেটে সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতদের দেখতে হাসপাতালে ছুটে যান সিলেট সফররত নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী।

গতকাল একাধিক অনুষ্ঠানে অংশ নিতে সিলেট এসেছেন নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী। সকালে সিলেট ওসমানী বিমানবন্দরে নেমেই তিনি সরাসরি চলে যান এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। প্রতিমন্ত্রী আহতদের চিকিৎসার খোঁজখবর নেন। এ সময় সাংবাদিকদের তিনি বলেন, আমাদের প্রথম কাজ নিহতদের চিহ্নিত করে তাদের মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা। তাদের দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করা। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের পাশে সরকার থাকবে। সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দেন তিনি। প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী সরকারের পক্ষ থেকে নিহতদের প্রত্যেক পরিবারকে ২০ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তার ঘোষণা দেন। এছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে আহতদের চিকিৎসার খরচ বহন করা হবে বলে জানান তিনি। এ সময় প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মেয়রপ্রার্থী আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী, হাসপাতাল পরিচালক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল মাহবুবুর রহমান ভূঁইয়া।

হতাহতদের পরিবারকে আর্থিক অনুদান : সিলেটের জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে হতাহতদের পরিবারকে আর্থিক অনুদান দেয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান জানান, সিলেট জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিহতদের পরিবারকে ২০ হাজার টাকা ও আহতদের প্রত্যেককে ১০ হাজার করে টাকা দেয়া হয়েছে। আর প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে হতাহতদের পরিবারকে ২৫ হাজার টাকা করে অনুদান দেন সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত