সবুজ পৃথিবী গড়ার স্বপ্ন দেখেন তেঁতুলিয়ার পরিবেশকর্মী মামুন
মনের আনন্দে বিনা পয়সায় গাছ বিলান তিনি
প্রকাশ : ১৫ জুন ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
এসকে দোয়েল, পঞ্চগড়
প্রকৃতি দূষণমুক্ত করে এক সবুজ বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেন পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ার মাহমুদুল ইসলাম মামুন। তাইতো সাইকেলে বই, প্ল্যাকার্ড, গাছ নিয়ে বেড়িয়ে পড়েন ভোরের আলো ফুটতেই। ঘুরে বেড়ান গ্রাম থেকে গ্রামে। মনের আনন্দে ঘুরে ঘুরে গ্রামে-শহরের বিভিন্ন বাড়িতে বিনে পয়সা বিলি করেন গাছের চারা, বীজ ও সবজির চারা। নিরাপদ খাদ্য ও নির্ভেজাল প্রকৃতির সবুজ সতেজতার পরিবেশ গড়তে প্রায় দুই দশক ধরে চলছে তার এ লড়াই। এ দীর্ঘ সময়ে তিনি লক্ষাধিকেরও বেশি গাছ বিলি করেছেন বিনে পয়সায়। ২০ থেকে ২৫টি গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে বেড়ে উঠেছে তার দেয়া উপহারের গাছ। এসব গাছ রোপণ করে স্বচ্ছলতা মিলেছে অনেক পরিবারের। মহামারি করোনাকালেও বাড়িতে বাড়িতে ঔষুধি গাছ ও ফল উপহার দিয়ে স্বাস্থ্য সচেতনতা বার্তা দিয়েছেন। এসব করতে কারো কাছ থেকে নেননি কোনো আর্থিক সহযোগিতা। বাড়িতে হাঁস-মুরগি পালন ও সবজি চাষ করে যা আয় হয়, সেটা দিয়েই কিনেন বই, গাছ, সবজির বীজ। শিশু-কিশোরদের মধ্যে জ্ঞানের আলো ছড়াতে বসান উঠোন পাঠশালা। সব বয়সি মানুষের কাছে হয়ে উঠেছেন ভ্রাম্যমাণ পাঠাগার। পাঠকদের দ্বারে দ্বারে গিয়ে বই বদলে বই দিচ্ছেন। বই পাঠ শেষ হলে দিচ্ছেন গাছের চারা উপহার। শিশু-কিশোরদের নিয়ে পাড়া-মহল্লায় বসাচ্ছেন পাঠের আসর। এসব আসরে থাকেন বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিরাও। তারা শুনেন মামুনের বই পড়ার গল্প। মুক্তিযুদ্ধ, ধর্ম, বিজ্ঞান ও বর্তমান প্রযুক্তিসহ নানান জ্ঞান সমৃদ্ধ বই। পাঠের আসরেও দিচ্ছেন গাছ উপহার। বিনে পয়সায় পড়ান দরিদ্র শিক্ষার্থীদের। এতে করে গ্রাম ও শহরের নানান বয়সি মানুষের কাছে হয়ে উঠেছেন প্রিয় মামুন। শিশুদের কাছে হয়ে উঠেছেন যেন হ্যামিলিয়নের বাঁশিওয়ালা। ফলদ গাছ দেয়ার পাশাপাশি গ্রামীণ গৃহিণীদের দিচ্ছেন সবজির চারা ও বীজ। বাড়ির আঙিনায় পরিত্যক্ত জমিতে বিষমুক্ত সবজি আবাদ করতে দিচ্ছেন লাউ, সিম, মরিচ, বেগুনসহ নানান বীজও। বিষমুক্ত সবজি আবাদ করতে দিচ্ছেন নানান পরামর্শ। চলমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সময়ে আশার আলো দেখাচ্ছেন তিনি। পরিবেশের দূষণ রোধে কাজ করছেন পরিবেশ নিয়ে। বিনে পয়সা গাছ দেয়ার ফাঁকেই বিভিন্ন হাটবাজারসহ চোখের সামনে পড়ে থাকা ময়লা সংগ্রহ করে রাখছেন নির্দিষ্ট জায়গায়। এসব ময়লা থেকে মিঠেন গ্যাস হয়ে তা যেন না ছড়িয়ে পড়ে, সে বিষয়েও সচেতনতা তৈরি করছেন। রাস্তার কোথাও কোনো গর্ত হতে দেখলে সেটাও ঠিক করছেন। রাস্তার ঝোপঝাড়ও পরিষ্কার করছেন, যাতে কেউ দুর্ঘটনায় শিকার না হন। এসব কাজ মামুনের পরিচিতি ছড়িয়ে পড়েছে জেলা থেকে সারাদেশে। মামুনের বাড়ি পঞ্চগড় জেলার তেঁতুলিয়া উপজেলার আজিজনগর গ্রামে। এ গ্রামের আজহারুল ইসলাম ও মাহমুদা বেগমের দ্বিতীয় পুত্র। রংপুর কারমাইকেল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর পাস করেও চাকরির পেছনে ছুটেননি। চাকরি না করে ব্যস্ত থাকেন প্রকৃতি ও মানবসেবায়। পরিবেশবন্ধু মাহমুদুল ইসলাম মামুন বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই প্রকৃতি আমাকে টানত। তখন থেকেই টুকটাক গাছ লাগাতাম। বুঝতে পারি মানুষের দ্বারাই আমাদের পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। তখন থেকেই পরিবেশ নিয়ে কিছু করার ইচ্ছা জাগে তার। সাহিত্যের দিকে জোক থাকায় বই পড়া নেশা ছিল। বই জ্ঞানের আলো ছড়ায় এটা চিন্তা করেই গ্রামে গ্রামে ঘুরে বইয়ের পাঠক তৈরি করি। এখন অনেক পাঠক তৈরি হয়েছে। নিজেই ভ্রাম্যমাণ পাঠাগারের মতো পৌঁছে দিচ্ছি বই। সুন্দর এক দূষণমুক্ত পৃথিবীর স্বপ্ন দেখি। সে স্বপ্নপূরণে কাজ করে যাচ্ছি। কেউ স্বীকৃতি দিক, আর না দিক, আমি আমৃত্যু পর্যন্ত কাজ করে যেতে চাই। অনেকে আমাকে ‘পাগল’ ছেলে বলে। তবে আমাকে আমার মা, ভাইসহ অনেকে উৎসাহিত করেন। আমি যে মানুষের জন্য, পরিবেশের জন্য কিছু করতে পারছি, এটাও একটা মহৎ কাজ। মামুনের মা মাহমুদা বেগম বলেন, ছেলেকে ছেড়ে দিয়েছি মানুষ ও পরিবেশের কল্যাণের জন্য। পিতৃহারা ছেলেটা শৈশব থেকেই মানুষকে বিনে পয়সায় সবজির বীজ বিতরণ করে যাচ্ছে। ভ্রাম্যমাণ পাঠাগারও চালাচ্ছে। আমি শুরু থেকেই ওর কাজকে ভালোবেসেছি এবং উৎসাহ দিয়েছি।
আমার দেখতে ইচ্ছে করে রাষ্ট্র ওর জন্য কী করল। শিক্ষার্থী শিলা আক্তার জানান, মামুন ভাই আমার পাশের গ্রামেই থাকেন। সে আমাদেরকে বই ও গাছ দিয়ে থাকেন। আমাকেও পাঁচণ্ডছয়টি গাছ দিয়েছেন। সে গাছগুলো বড় হয়েছে। অনেককেই গাছ দিয়েছেন। সরকার যদি মামুন ভাইকে সহযোগিতা করে, সে অনেক বড় হতে পারবে বলে আশা করি। এ সময় একজন গৃহিণী সবজির মাচা দেখিয়ে বলেন, মামুন বীজ দিয়েছিল, এই যে খাচ্ছি বরবটি বিক্রিও করেছি, বেগুন টমেটোর চারাও দিয়েছেন। তিনি আমাদের বাড়ির আঙিনায় বিষমুক্ত সবজি লাগাতে বলেন। স্থানীয় যুবক মোখলেসুর রহমান বলেন, আমাদের তরুণদের একজন আইকন। সে যেভাবে পরিবেশ নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে তা বিরল। অনেকেই হয়তো মামুনকে ‘পাগল’ মনে করি, কিন্ত সে পাগল নয়, মামুন পরিবেশ নিয়ে ভাবেন। দূষণমুক্ত পরিবেশ গড়তে ময়লা সংগ্রহ করছে, রাস্তা পরিষ্কার করে দিচ্ছে, রাস্তার ঝোপঝাড় পরিষ্কার করে দিচ্ছেন। পাড়া-মহল্লায় ছোট ছোট বাচ্ছাদের একত্র করে বই হাতে দিয়ে বই পড়াচ্ছেন। এ যুগে এ রকম মানুষ পাওয়া খুব দুষ্কর। সরকার যদি মামুনকে নিয়ে ভাবত, তাহলে সে আরো এগিয়ে যেত। তেঁতুলিয়া সরকারি কলেজের শিক্ষক মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘মামুন সম্পর্কে বললে অনেক কথাই বলতে হয়। মামুন এমন এক ছেলে, যে বাল্যকাল থেকেই তার বাড়ি থেকেই শুরু করে আমাদের আজিজনগর, ডাঙ্গাপাড়া, পানিহাকা, বোচাগছ, বিড়ালীজোত, টাইয়াগছ, ফকিরপাড়াসহ মোটামুটি ১০ থেকে ১৫টি গ্রাম নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে নিরলসভাবে। সেই সাথে ঝরেপড়া ছেলেমেয়েদের হাতে বই দিচ্ছে, গ্রামে গ্রামে গিয়ে মুক্তপাঠশালা খুলে বিনা পয়সায় বই পড়াচ্ছে। পাশাপাশি পরিবেশ রক্ষার্থে পলিথিন ব্যবহার পরিহার করতে সে রাস্তায় রাস্তায় বস্তা বেঁধে দিয়েছে। এসব বর্জ্য নিয়ে সে আবার মাটিতে পুঁতে বা পুড়ে ফেলে। বিনে পয়সা গাছের চারা বিতরণ করছে। আমার জান মতে, সে লক্ষাধিকের বেশি গাছের চারা বিতরণ করেছে। তাই আমি বলব, সে পরিবেশবাদী।’ পঞ্চগড় জেলায় দ্বিতীয় কোনো মামুন খোঁজে পাওয়া যাবে না। তাই তাকে যদি সরকারিভাবে উৎসাহ-উদ্দীপনা দেয়া যায়, তাহলে সে এই অঞ্চলে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।