আওয়ামী লীগ অফিসে বোমা হামলা
১০ বছরেও শেষ হয়নি সাক্ষ্যগ্রহণ
১৫ বছর ধরে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় থাকলেও চাঞ্চল্যকর এই মামলার বিচারকাজে ধীরগতি হওয়ায় নিহত ও আহতদের স্বজনরা হতাশ
প্রকাশ : ১৬ জুন ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
শরীফ সুমন, নারায়ণগঞ্জ
নারায়ণগঞ্জ শহরের প্রাণকেন্দ্র চাষাঢ়া আওয়ামী লীগ অফিসে বর্বরোচিত বোমা হামলার বিচারকাজ ২২ বছরেও শেষ হয়নি। নৃশংস এ বোমা হামলার ঘটনায় দায়ের করা দুটি মামলায় আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয় এক যুগ পর ২০১৩ সালে। তবে ১০ বছরেও শেষ হয়নি সাক্ষ্যগ্রহণের কাজ। দুটি মামলায় ১৩৮ জন সাক্ষীর মধ্যে মাত্র ২২ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ হয়েছে। গত ১৫ বছর ধরে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় থাকলেও চাঞ্চল্যকর এই মামলার বিচারকাজে ধীরগতি হওয়ায় নিহত ও আহতদের স্বজনরা হতাশা প্রকাশ করেছেন। বর্তমানে মামলাটির বিচার কার্যক্রম প্রসঙ্গে আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) মো. আব্দুর রহিম বলেন, এই মামলাটির প্রায় ২২ বছরেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। হত্যা মামলায় ৫৬ জন এবং বিস্ফোরক মামলায় ৮২ জন সাক্ষী রয়েছেন। অনেক সময় সাক্ষীরা নিয়মিত সাক্ষী দিতে আসেন না। ফলে বিচার কার্যক্রমে সময়ক্ষেপণ হচ্ছে। তারপরও ২২ জন সাক্ষী দিয়েছেন। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও ডাক্তার সাক্ষ্য দিলে মামলাটির বিচার কার্যক্রম শেষ পর্যায়ে চলে আসবে।
তাছাড়া মামলার ভুক্তভোগী নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের সাক্ষী বাকি রয়েছে। উনাকে অনেকবার সমন দেয়া হয়েছে। হয়তো উনার ব্যস্ততার কারণে স্বাক্ষ্য দিতে আসতে পারেননি। নিহতের স্বজনদের অভিযোগ ২০ জনের প্রাণহানি, কারো অঙ্গহানিসহ অর্ধশত আহতের ঘটনার পরও ২২ বছরে শুধু রাজনীতি হয়েছে। কখনো বিএনপি কখনো আওয়ামী লীগ। পাল্টাপাল্টি মামলা নিয়ে তদন্ত করেই সময় পার। ২০০১ সালের পর ২০০৬ সাল পর্যন্ত ছিল বিএনপি। পরের ২ বছর তত্ত্বাবধায়ক সরকার। ৭ বছর ছাড়া ২১ বছরের মধ্যে ১৫ বছর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। এদিকে প্রতি বছরের ন্যায় দিবসটি পালনের লক্ষ্যে নানা
কর্মসূচি হাতে নিয়েছে নিহতের পরিবার এবং আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে শোক র্যালি, দোয়া ও মিলাদ, শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলী ও আলোক প্রজ্বলন। অন্যদিকে দিবসটি উপলক্ষ্যে শহীদ বাপ্পী স্মরণে ছয় দিনব্যাপী নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে নাসিকের ১৮নং ওয়ার্ডবাসী।
জানা গেছে, ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদের শেষ দিকে ১৬ জুন চাষাঢ়া আওয়ামী লীগ অফিসে বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। রাতে পৌনে ৮টার দিকে তখনকার এমপি শামীম ওসমান যখন জনগণের কথা শোনার জন্য সাক্ষাৎ দিচ্ছিলেন ঠিক তখনি বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। সেই হামলায় আওয়ামী লীগের ২০ নেতাকর্মী প্রাণ হারান। নিহতরা হলেন- তৎকালীন শহর ছাত্রলীগের সভাপতি সাইদুল হাসান বাপ্পী, সরকারি তোলারাম কলেজ ছাত্রছাত্রী সংসদের সাবেক জিএস আকতার হোসেন ও তার ভাই সংগীতশিল্পী মোশাররফ হোসেন মশু, সংগীতশিল্পী নজরুল ইসলাম বাচ্চু, ফতুল্লা থানা আওয়ামী লীগের তৎকালীন যুগ্ম সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন ভাসানী, নারায়ণগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবিএম নজরুল ইসলাম, স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা সাইদুর রহমান সবুজ মোল্লা, মহিলা আওয়ামী লীগ নেত্রী পলি বেগম, ছাত্রলীগ কর্মী স্বপন দাস, কবি শওকত হোসেন মোক্তার, পান সিগারেট বিক্রেতা হালিমা বেগম, সিদ্ধিরগঞ্জ ওয়ার্ড মেম্বার রাজিয়া বেগম, যুবলীগ কর্মী নিধু রাম বিশ্বাস, আব্দুস সাত্তার, আবু হানিফ, এনায়েত উল্লাহ স্বপন, আব্দুল আলীম, শুক্কুর আলী, স্বপন রায় ও অজ্ঞাত এক মহিলা। গুরুতর আহত হন শামীম ওসমানসহ অর্ধশতাধিক লোক। চিরতরে পঙ্গুত্ববরণ করেন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির জেলার সভাপতি বর্তমানে নারায়ণগঞ্জ জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি চন্দন শীল, স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক রতন দাস আরো অনেকেই। ওই ঘটনায় সেদিনই নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট খোকন সাহা দুটি মামলা (একটি বিস্ফোরক ও অন্যটি হত্যা) দায়ের করেন। ২০০১ সালে চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা চূড়ান্ত রিপোর্ট দাখিল করেন। পরবর্তীতে ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে এ মামলাটি পুনরুজ্জীবিত করা হয়। দুটি মামলায় সাতবার মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তনের পর অষ্টম বার ১৩ বছর পর ২০১৩ সালের ২ মে ছয়জনকে অভিযুক্ত ও ৩১ জনকে অব্যাহতি প্রদান করে নারায়ণগঞ্জ চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে দুটি মামলার প্রতিটির ৯৪৭ পাতার চার্জশিট দাখিল করা হয়। এতে মামলা থেকে চার্জশিট থেকে জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকারসহ ৩১ জনকে অব্যাহতি দেয়া হয়। আর অভিযুক্ত ছয়জন হলেন নারায়ণগঞ্জে ক্রসফায়ারে নিহত যুবদল ক্যাডার মমিনউল্লাহ ডেভিডের ভোট ভাই শাহাদাত উল্লাহ জুয়েল, হরকাতুল জিহাদ নেতা মুফতি আব্দুল হান্নান, ওবায়দুল্লাহ রহমান, ভারতের দিল্লি কারাগারে আটক সহোদর আনিসুল মোরসালিন, মুহিবুল মুত্তাকিন এবং নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ১২নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর শওকত হাশেম শকু। আসামিদের মধ্যে ২০১৭ সালে হরকাতুল জিহাদ নেতা মুফতি আবদুল হান্নানের অপর একটি মামলায় ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়। জমজ দুই সহোদর আনিসুল মারছালিন ও মুহিবুল মোত্তাকিন ভারতের দিল্লি কারাগারে বন্দি। কাউন্সিলর শওকত হাশেম শকু জামিনে রয়েছেন। শাহাদাৎ উল্লাহ জুয়েল কারাগারে রয়েছেন। এদের মধ্যে ওবায়দুল্লা রহমান মারা গেছেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে। ২০২০ সালের ৭ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জ অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে সাক্ষ্য দিতে আসেন নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের এমপি শামীম ওসমান। সাক্ষ্য দেয়ার পর আদালত থেকে বেরিয়ে গণমাধ্যমকে শামীম ওসমান বলেছিলেন, ‘এ মামলায় অনেকের নাম আছে যারা অপরাধী না। যারা প্রকৃত অপরাধী তারা এ মামলা থেকে সেভ হয়ে গেছে। ১৬ জুনের ঘটনায় আমি ছিলাম প্রধান ভিকটিম। প্রধান ভিকটিম হিসেবে আমার যে সাক্ষ্য নেয়া হয়েছিল, আমি দেখলাম তার সাথে ঘটনার কোনো মিল নাই। ঘটনার পরে আমি সাক্ষ্যতে যে জবানবন্দি দিয়েছিলাম এখন দেখি বিচার চলাকালে সেই কথা কিছুই নাই। আমাদের বক্তব্য বিকৃত করা হয়েছে। ফলে আমি চাই এ ঘটনায় যারা প্রকৃত দোষী তাদের যেন বিচার হয়। আমি আদালতের কাছে অনুরোধ করেছি, যিনি মামলা তদন্ত করেছেন তাকে আদালতে তলব করা হোক। আমরা এ মামলার অধিকতর তদন্ত চেয়েছি। যিনি দোষী না তিনি যেন আমার প্রতিপক্ষ হলেও যেন সাজা ভোগ না করে। আমি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইজিপিকে, পার্টির সাধারণ সম্পাদককে বলেছি- আমি এ চার্জশিট মানি না। আমি যদি বেঁচে নাও থাকি এই মামলাটা যেন সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হয়। যারা সত্যিকারের দোষী লোক তাদের যেন বিচার হয় এবং যারা নিরাপরাধ সে বিএনপি, জাতীয় পার্টি যাই করুক তাদের যেন কোনো বিচার না হয়। তাহলে সাজাপ্রাপ্ত হবে সংবিধান, সাজাপ্রাপ্ত হবে আইন, সাজাপ্রাপ্ত হবে আমাদের বিবেক, আমাদের ঈমান।’ তিনি বলেন, এ মামলায় আদালতে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে দেখি ঘটনার পর কিছুটা সুস্থ হয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আমি ১৬১ ধারায় যে বক্তব্য দিয়েছিলাম তা পরিবর্তন করে ফেলা হয়েছে। এজন্য আমি আদালতে সাক্ষ্য না দিয়ে এ মামলার অধিকতর তদন্ত দাবি করেছি।