চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র থেকে এবার আসলে কত ডিম সংগ্রহ হয়েছে তা নিয়ে নানা তথ্য মিলছে। মা মাছ আসলে কত ডিম ছেড়েছে তা নিয়েও তৈরি হয়েছে ধোঁয়াশা। কেউ বলছেন এবার গেল পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পরিমাণ ডিম ছেড়েছে মা মাছ। আর কারো মতে, গেল তিন বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পরিমাণ নমুনা ডিমে ছেড়েছে মা মাছ। স্থানীয় মাছ চাষি জেলেদের বক্তব্য থেকে সংগৃহীত মাছের ডিম নিয়ে বিভ্রান্তির তথ্য মিলছে। কারো হিসাবে পাঁচ হাজার কেজি। আবার কারো হিসাবে ২০ হাজার কেজি। তবে স্থানীয় জেলেদের বিভিন্ন সূত্র থেকে দাবি করা হয়েছে, গত রবি ও সোমবার ব্যাপক হারে নমুনা ডিম ছাড়ে মা মাছ। এই কয়দিনে মোট ২০ হাজার কেজি ডিম সংগ্রহ হওয়ার দাবি করা হয়েছে।
স্থানীয় সূত্র জানায়, রোববার রাতে হালদা পাড়ের দুই উপজেলা রাউজান ও হাটহাজারীর পাঁচ শতাধিক ডিম সংগ্রহকারী ২৮৫টি নৌকা নিয়ে রাতভর ডিম সংগ্রহ করেছেন। আর প্রত্যাশিত ডিম সংগ্রহ করতে পেরে জেলেরা খুশি। ব্যাপক হারে সংগ্রহ করা ডিম সোজা নিয়ে যাওয়া হয়েছে হ্যাচারিতে। সেই ডিম থেকে মিলবে পোনা। পোনা বিক্রি করেই অর্থ আয়ের স্বপ্ন দেখছেন হ্যাচারি মালিকরা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, হালদা থেকে সংগ্রহ করা ডিম সরকারি হ্যাচারি মাছুয়াঘোনায় ৫০টি কুয়ায় চল্লিশ কেজি করে ২ হাজার, শাহমাদারীতে ৪৫টি কুয়ায় ১ হাজার ৮০০ কেজি, মদুনাঘাটে ৩০টি কুয়ায় ১ হাজার ২০০ কেজি ডিম সংরক্ষণ করা যায়। পাশাপাশি রাউজান উপজেলার মোবারকখীল হ্যাচারির ১৬ কুয়ায় সংরক্ষণ করা যায় ১ হাজার ১৭০ কেজি ডিম। এর বাইরে বেরসকারি একটি সংস্থার ইট-সিমেন্ট নির্মিত কুয়া রয়েছে ৩০টি। মৎস্য বিভাগ ও গবেষকদের প্রাথমিক হিসাবে এই মৌসুমে ডিম সংগ্রহের পরিমাণ প্রায় ২০ হাজার কেজি।
ডিম সংগ্রহকারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অনেক প্রতিকূল পরিস্থিতি সামলে তারা ডিম সংগ্রহ করেন। রাতে জালভর্তি ডিম এসেছে। কিন্তু এত ডিম সংরক্ষণের কুয়া না থাকায় কুয়ার সমপরিমাণ ডিম নিয়ে নদী থেকে উঠে এসেছেন সংগ্রহকারীরা। প্রচুর ডিমের কারণে পুরো নদীতে ফেনা সৃষ্টি হয়েছে। সকালেও নদীতে জালে ডিম ধরা পড়ে। এমনকি নৌকাণ্ডবাঁশের ভেলায় ডিমের অস্তিত্ব লক্ষ্য করা গেছে।
স্থানীয় একজন ডিম সংগ্রহকারী বলেন, অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে এবার বেশি ডিম সংগ্রহ করা হয়েছে। এত বেশি ডিম পাওয়া যাবে, তা চিন্তা করা যায়নি। বাড়তি ডিম সংগ্রহ হওয়ার পর তা সংরক্ষণ নিয়েও এবার নানা সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। সংরক্ষণের পর্যাপ্ত কুয়া না থাকায় সব নেওয়া হয়নি। কুয়া সংকট দূর করার জন্য প্রশাসন দ্রুত ব্যবস্থা নিতে পারে। তাতে এবার সুফল না মিললেও হয়তো আগামীবার সুফল মিলবে। অর্থাৎ বাড়তি ডিম সংরক্ষণে কোনো সমস্যা হবে না।
জেলা মৎস্য অফিসের কর্মকর্তারা জানান, গত কয়েক বছরের মধ্যে এবার রেকর্ডসংখ্যক ডিম ছেড়েছে মা মাছ। এসব ডিম সংরক্ষণের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। আগামীতে হয়তো এই সমস্যা থাকবে না।
হালদা গবেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মঞ্জুরুল কিবরিয়া জানান, ডিম আসলে এবার বেশিই সংগ্রহ করা হয়েছে। তা পরিমাণ হিসাব করে বললে ২০ হাজার ডিম সংগ্রহ করা হয়েছে বলা যায়। নিঃসন্দেহে তা অনেক বেশি। এবার জেলেরা নদীর নাপিতের ঘাট, আজিম্যারঘাট, মাছুয়াঘোনা, পুরালি সøুইসগেট, নোয়াহাট, গড়দুয়াড়া এলাকার বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে ডিম সংগ্রহ করেছেন। এই ধারা অব্যাহত থাকলে আগামীতে আরো বেশি ডিম সংগ্রহ হতে পারে। সেই সঙ্গে তা সংরক্ষণের ব্যবস্থাও বাড়াতে হবে।
কুয়া সংকটে নষ্ট হচ্ছে ডিম : হালদা থেকে সংগ্রহ করা ডিম কুয়ায় সংরক্ষণ করা হয়। এটা দীর্ঘদিন ধরে নিয়ম হিসেবে পালন হয়ে আসছে। এবার রেকর্ড সংখ্যক ডিম সংগ্রহ হয়েছে। কিন্তু কুয়া সংকট প্রকট হওয়ায় অনেক ডিম নষ্ট হয়েছে। কারণ যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা যায়নি। হালদাকেন্দ্রিক সরকারি-বেসরকারি ছোট-বড় মোট ১৬টি হ্যাচারি রয়েছে। এছাড়া কৃত্রিম পদ্ধতির মাটির তৈরি কুয়াসহ মোট ২৬৭টি কুয়ায় ডিম থেকে রেণু ফোটানো যায়। সেখানে এখন ব্যস্ততা বেড়েছে।
মৎস্য অফিস সূত্র জানায়, মদুনাঘাট হ্যাচারিতে ৩৬টি কুয়ায় ১৬৯ বালতি, শাহমাদারি হ্যাচারিতে ৪২ কুয়ায় ১৯০ বালতি ও মাছুয়াঘোনা হ্যাচারিতে ৪৭টি কুয়ায় ২৪৯ বালতি ডিম ছাড়া হয়। এ ছাড়া রাউজান উপজেলার মোবারক খিল হ্যাচারিতে ১৫টি কুয়ায় ১১৩ বালতি এবং বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ইন্টিগ্রেটেড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের (আইডিএফ) পশ্চিম বিনাজুরি হ্যাচারিতে ১৩০ বালতি ডিম রাখা হয়েছে। এর মধ্যে মদুনাঘাট হ্যাচারিতে ৪টি কুয়া, শাহমাদারি হ্যাচারিতে দুটি কুয়ার ডিম নষ্ট হয়েছে। সাধারণত প্রতি কুয়ায় ৪ থেকে ৫ বালতি ডিম রাখা হয় রেণু ফোটানোর জন্য। কিন্তু ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত ডিম পাওয়ায় নষ্ট হচ্ছে। কারণ একটাই, সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেই।