স্ত্রীসহ রিমান্ডে হিন্দাল শারক্বীয়ার প্রতিষ্ঠাতা
সশস্ত্র প্রতিরোধের পরিকল্পনা ছিল শামিনের
প্রকাশ : ২৫ জুন ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়াকে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব দিয়েছিল কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের প্রধান নাথান বম। নতুন জঙ্গি সংগঠনটির বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান শুরু হলে এ প্রস্তাব দেয় কুকি-চিন। কিন্তু আত্মসমর্পণের প্রস্তাবে রাজি হয়নি এ জঙ্গি সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা শামিন মাহফুজ। তখন শামিন মাহফুজ সিদ্ধান্ত নেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলার। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একেরপর এক অভিযানে সংগঠনটির সদস্যরা গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে দুর্বল হয়ে পড়ে। সর্বশেষ গত শুক্রবার দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার প্রতিষ্ঠাতা শামিন মাহফুজ ওরফে শামিন স্যার ওরফে আরিফ ওরফে আসলাম ওরফে মেন্ডিং মুরং ও তার স্ত্রী নাজনীনকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহনগর পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট।
শুক্রবার দিবাগত রাতে রাজধানীর ডেমরা এলাকা থেকে তাদের গ্রেপ্তার করার কথা জানায় সিটিটিসি। এ সময় তাদের কাছ থেকে একটি পিস্তল ও বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক উদ্ধার করার তথ্যও জানায় সংস্থাটি। গতকাল শনিবার দুপুরে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান সিটিটিসি প্রধান মো. আসাদুজ্জামান।
এদিকে আদালত সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর ডেমরা থানার সন্ত্রাসবিরোধী আইনের করা মামলায় জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার প্রতিষ্ঠাতা শামিন মাহফুজের চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। একইসঙ্গে তার স্ত্রী নাজনীন সুলতানার তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়েছে।
গতকাল আসামিদের আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করেন তদন্ত কর্মকর্তা সিটিটিসির উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. সাইফুল ইসলাম। শুনানি শেষে ঢাকার মহানগর হাকিম আহমেদ হুমায়ুন কবীর এ রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্যমতে, কয়েকটি জঙ্গি সংগঠনের সদস্য নিয়ে জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া নামে নতুন জঙ্গি সংগঠন গড়ে তোলেন শামিন মাহফুজ। ২০২২ সালে যৌথ বাহিনীর অভিযান শুরু হওয়ার পরে জঙ্গি নেতা শামিন মাহফুজ সস্ত্রীক আত্মগোপনে চলে যান। তখন তিনি বান্দরবানের গভীর পাহাড়ে আস্তানা গাড়েন। শামিন মাহফুজ জঙ্গি কর্মকাণ্ডের জন্য বান্দরবানের মানুষের কাছে বেশ পরিচিত নাম। সাম্প্রতিক সময়ে কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) সহযোগিতায় আবারো বান্দরবানের রুমা উপজেলায় জঙ্গি প্রশিক্ষণকেন্দ্র করার খবর প্রকাশ হলে আলোচনায় আসেন এ জঙ্গি নেতা। এর আগে ২০১১ সালের ২৮ মার্চ থানচির বলিপাড়ার কলাইপাড়া এলাকা থেকে শামিন মাহফুজ ও তার সহযোগী ইসমাইল হোসেনকে আটক করেছিল পুলিশ। সে সময় তিনি জামায়াতুল মুজাহেদিন বাংলাদেশের (জেএমবি) দলনেতা ছিলেন। ওইসময় অস্ত্রসহ বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক উদ্ধারের ঘটনায় বান্দরবানজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়। জঙ্গি দমনে নড়েচড়ে বসে নিরাপত্তা বাহিনী। পরে পাহাড়ে একের পর এক অভিযান চালানো হয়। এরপর জামিনে বেরিয়ে পেছন থেকে সংগঠনের কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন শামিন মাহফুজ।
এদিকে গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে গতকাল ব্রিফিংয়ে সিটিটিসি প্রধান মো. আসাদুজ্জামান বলেন, আলোচিত জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার প্রতিষ্ঠাতা ও মূল ব্যক্তি শামিন মাহফুজকে গ্রেপ্তারের মাধ্যমে দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান হয়েছে। এর মাধ্যমে একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি হবে।
ছাত্র জীবন থেকেই শামিন মাহফুজ অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, এসএসসিতে রাজশাহী বোর্ডে ৫ম স্থান অর্জন করে, এরপর রংপুর ক্যাডেট কলেজে পড়াকালীন সময়ে শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। বিষয়টি কর্তৃপক্ষের নজরে এলে তাকে ক্যাডেট কলেজ থেকে বহিষ্কার করা হয়। এরপর অন্য একটি কলেজে ভর্তি হলেও সে মেধার স্বাক্ষর রাখে। এইচএসসিতে রাজশাহী বোর্ডে ৭ম স্থান অর্জন করে।
এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) ভর্তি হওয়ার পরেই বড় ভাইয়ের ছেলের মাধ্যমে জঙ্গি সংগঠনে জড়িয়ে যায়। যে সংগঠনটি পরে আনসার আল ইনলাম হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ২০০৭ সাল থেকেই শামিন মাহফুজ সংগঠনের আধ্যাত্মিক নেতা জসীম উদ্দিন রহমানীসহ শীর্ষ নেতৃত্বের সংস্পর্শে আসে। সে সময় আরেকটি বিদেশি চরিত্র বাংলাদেশের জঙ্গিবাদে আভির্ভূত হয় বলে জানা গিয়েছিল। কিন্তু সে চরিত্রের বিষয়ে আমরা স্পষ্ট হতে পারিনি, সেই চরিত্রের বিষয়ে আমরা শামিন মাহফুজের কাছ থেকে জানার চেষ্টা করব।
তিনি বলেন, ঢাবিতে পড়াকালীন সময়েই শামিন মাহফুজ পাহাড়ে ক্যাম্পের পরিকল্পনা করেন। সে অনুযায়ী তিনি পাহাড়ে যান। ঢাবি থেকে বের হয়ে তিনি উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন। এর মধ্যেই তার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডিতে এনরোলমেন্ট হয়। তার গবেষণার বিষয় ছিল পাহাড়ে ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর উপর। ইচ্ছা করেই তিনি এ বিষয়টি নেন, যাতে তিনি পাহাড়ে যেতে পারেন এবং সেখানে নিরাপদ আস্তানা তৈরি করতে পারেন।
শামিন মাহফুজ ২০১১ সালে বিজিবি কর্তৃক গ্রেপ্তার হয়েছিলেন জানিয়ে তিনি বলেন, জেল থেকে বেরিয়ে একই কার্যক্রম অব্যাহত রাখে। ২০১৪ সালে ডিবি কর্তৃক আবারো গ্রেপ্তার হন। এরপর তিনি কাশিমপুর কারাগারে ছিলেন। সেখানে থাকাকালীন নতুন এ জঙ্গি সংগঠনের প্রথম পরিকল্পনা হয়। সেখানে থাকা অবস্থায় আটক হুজি এবং জেএমবির শীর্ষ নেতৃত্ব সাইদুর রহমান, মুফতি হান্নান, আবু সাঈদের সংস্পর্শে আসেন। তখন রক্সিও জেলখানায় ছিলেন।
সে সময় জঙ্গি নেতারা জানতেন শামিন মাহফুজ এবং রক্সি আগেই জেল থেকে বের হবে। তাই তাদের উপর দায়িত্ব দেয়া হয় নতুন প্ল্যাটফর্ম তৈরির জন্য। ২০১৭ সালে রক্সি এবং ২০১৮ সালে শামিন মাহফুজ জেল থেকে জামিনে ছাড়া পান। এরপর থেকে তারা সদস্য সংগ্রহ শুরু করে কিন্তু সংগঠনের নামকরণ হয়নি। তবে তারা একটি প্ল্যাটফর্ম নিয়ে কাজ করতে থাকে। রক্সি দাওয়াতি কার্যক্রম এবং শামিন মাহফুজ পাহাড়ে প্রশিক্ষণ ক্যাম্প স্থাপনের প্রক্রিয়া শুরু করে। তখন ২০১৯ সালে রক্সিকে সংগঠনের আমির হিসেবে নিযুক্ত করা হয়।
সিটিটিসির প্রধান আরো বলেন, ঢাবিতে থাকাকালীন সময় থেকেই শামিনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল কুকি চিন গ্রুপের প্রধান নাথান বম। শামিন উদ্দেশ্যমূলকভাবেই নাথান বমের সঙ্গে পরিকল্পনা করে ঘনিষ্ঠতা করে। তখনই নাথান বমের সঙ্গে পাহাড়ে বেড়াতে গেছেন শামিন। ২০১৯ সালে নাথান বমকে জঙ্গি সংগঠন তৈরির কথাটি জানান এবং সশস্ত্র জিহাদের প্রস্তুতের জন্য তাকে ট্রেনিং ক্যাম্পে স্থাপনের প্রস্তাব দেন।
২০২০ সালে কক্সবাজারের একটি হোটেলে বসে কুকি চিন ও নতুন জঙ্গি সংগঠন শারক্বীয়ার মধ্যে সমঝোতা স্মারক হয়। আমরা শামিনের কাছ থেকে হাতে লেখা দুই পৃষ্ঠার স্মারকটি উদ্ধার করতে পেরেছি। সেখানে কুকি চিন কর্তৃক জঙ্গি সংগঠনটিকে সহযোগিতার বিষয়ে বিস্তারিত উল্লেখ ছিল। তখন থেকেই কুকি চিনের আওতায় তাদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু হয়।
জঙ্গিবাদ দমনে নিয়োজিত এ গোয়েন্দা বলেন, ২০২১ সালে সিলেট থেকে ৬ তরুণ নিখোঁজ হয়। এপ্রিলে প্রথম ১২ জন নিয়ে পাহাড়ে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু হয়। কুকি চিনের ক্যাম্পের পাশেই কেডিসি ক্যাম্প নামে ক্যাম্পটি পরিচালিত হয়। তখনই প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে বসে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ করে সংগঠনটি। ২০২২ সালের শুরুর দিকে ৩০ এর বেশি তরুণ নিখোঁজ হয়। তখনই আমরা এ সংগঠনের তৎপরতার বিষয়ে অবগত হই। রক্সি গ্রেপ্তারের পর মূল ব্যক্তি হিসেবে তমালকে আমির হিসেবে নিয়োগ দেন শামিন। ২০২২ সালে শূরা কমিটি গঠন করে বিভিন্ন জনকে দায়িত্ব দেয়া হয়।
আমরা শামিনের মোবাইল থেকে একটি গোপন কথোপকথন উদ্ধার করেছি। সেখানে শূরা কমিটির সঙ্গে নাথান বমও কানেকটেড ছিল। অভিযানের শুরুর দিকে শামিন মাহফুজকে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব দেন নাথান বম। কিন্তু শামিন আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নাকচ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে প্রতিরোধ করার সিদ্ধান্ত নেন। শামিন নির্দেশনা দেন, ‘যুদ্ধ হবে আক্রমণাত্মক, রক্ষণাত্মক নয়।’ নতুন এই জঙ্গি সংগঠনের উদ্দেশ্য সশস্ত্র জিহাদ করা। তাদের মতে যারা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য যারা কাজ করে তারা মুরতাদ। তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করাই মূল উদ্দেশ্য। তবে তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিশ্চিত হতে আমাদের জিজ্ঞাসাবাদ অব্যাহত থাকবে।
শামিন মাহফুজের স্ত্রী যাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তিনি ছিলেন আনসার আল ইসলামের ইজাজ কারগিলের স্ত্রী। যিনি কারগিল যুদ্ধে ড্রোন হামলায় মারা যান। ইজাজ যখন পাকিস্তান চলে যান তখন সংগঠনের সিদ্ধান্তে তার স্ত্রীকে বিয়ে করেন শামিন। তার স্ত্রীও সংগঠনের নারী সদস্য হিসেবে নারীদের দাওয়াতি কার্যক্রমে জড়িত ছিলেন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা নাথান বমের সঙ্গে শামিনের সর্বশেষ যোগাযোগটা উদ্ঘাটন করতে পারিনি। আমরা মনে করি কোনো না কোনোভাবে তার যোগাযোগ থাকতে পারে। হিজরতে যাওয়া অধিকাংশকেই আমরা গ্রেপ্তার করতে পেরেছি। তাকে জিজ্ঞাসাবাদে বিস্তারিত জানা যাবে।