কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে সময় যত গড়াচ্ছে, খুনোখুনিও তত বাড়ছে। এতে আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন সাধারণ রোহিঙ্গারা। তারা বলছেন, ক্যাম্পগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখতে সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর মধ্যে এখন প্রকাশ্যেই চলছে দ্বন্দ্ব। বর্তমানে বেশি তৎপর মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান স্যালভেশন আর্মি বা আরসা, রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও) ও নবী হোসেন গ্রুপ। ক্যাম্পকেন্দ্রিক মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, অপহরণ ও চোরাচালান নিয়ন্ত্রণই তাদের মূল টার্গেট বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে।
সর্বশেষ গত শুক্রবার ভোরে উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আরসা ও আরএসওর মধ্যে পাল্টাপাল্টি গুলিতে পাঁচ রোহিঙ্গা নিহত হন। তারা সবাই আরসা সদস্য বলে জানিয়েছে পুলিশ। উখিয়া থানার ওসি শেখ মোহাম্মদ আলী বলেন, ওই দুই গ্রুপের দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। পাঁচ রোহিঙ্গার মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য কক্সবাজার পাঠানো হয়েছে।
কক্সবাজারের ৩৩টি ক্যাম্পে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় সাড়ে ১২ লাখ। তাদের মধ্যে আট লাখের বেশি রোহিঙ্গা ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর কয়েক মাসে রাখাইনে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর দমন-পীড়নের মুখে পালিয়ে এসেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, খুনোখুনি, অপহরণ ও মাদক কারবারের অভিযোগে বিভিন্ন সময় কারাগারে গেলেও অনেক রোহিঙ্গা জামিনে বেরিয়ে নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। মাদক কারবারে জড়িত অনেকেই এখন অপহরণ সিন্ডিকেটের সদস্য। তারা অপহৃত ব্যক্তিকে পাহাড়-জঙ্গলের পরিবর্তে এখন ক্যাম্পে নিয়ে আটকে রাখছে। আর্থিক সুবিধা পেতে এ চক্রে স্থানীয়দের মধ্যেও কেউ কেউ যুক্ত হচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের একজন বাসিন্দা বলেন, শুক্রবার খুব ভোরে গোলাগুলির আওয়াজে ঘুম ভাঙে। এরপর দেখি ক্যাম্পের চারপাশে হইচই শুরু হয়েছে। বেরিয়ে দেখি কয়েকজন রক্তাক্ত পড়ে আছে। কিছুক্ষণ পর পুলিশ এসে তাদের উদ্ধার করে নিয়ে যায়। ক্যাম্পে তিনটি সন্ত্রাসী গ্রুপের কারণে প্রতিনিয়ত খুনোখুনি বাড়ছে। তারা ক্যাম্প নিয়ন্ত্রণে রাখতে খুন-খারাবি করছে। তাদের কারণে আমরা যারা সাধারণ রোহিঙ্গা আছি তারা খুব বিপদের মধ্য আছি।
উখিয়া বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নেতা আজিম উল্লাহ জানান, ক্যাম্পে হত্যাকাণ্ড দিন দিন বাড়ছে। সম্প্রতি ক্যাম্পের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আরসা ও আরএসওর মধ্যে দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে রূপ নিয়েছে। যার ফলে সাধারণ রোহিঙ্গারা খুব ভয়ভীতির মধ্য রয়েছে।
জেলা পুলিশ ও এপিবিএনের তথ্য অনুসারে, কক্সবাজারের ৩৩টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গত সাড়ে পাঁচ বছরে ১৭৩টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। নিহতদের মধ্যে রয়েছেন কমিউনিটি নেতা, স্বেচ্ছাসেবক ও সাধারণ রোহিঙ্গা। এর মধ্য চলতি বছরের সাত মাসে (৭ জুলাই পর্যন্ত) রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরে একাধিক সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনায় অন্তত ৫৯ জনের মৃত্যু হয়েছে।
সূত্রের দাবি, ক্যাম্পে আরসা-আরএসও সদস্যদের মধ্যেও বর্তমানে বিভেদ চরমে। উদ্দেশ্য নিয়ে মতবিরোধ দেখা দেয়ায় আরসার প্রধান আতাউল্লাহ আবু আম্মার ওরফে জুনুনির গ্রুপ থেকে সরে আসার চেষ্টা করছে অন্য একটি অংশ। আর এ অংশকে নিজেদের দলে ভেড়াতে চাইছে আরএসও। এতেই দেখা দিয়েছে বিপত্তি। এছাড়া রয়েছে ক্যাম্পের ত্রাস নবী হোসেন গ্রুপ। আবার ক্যাম্পের অনেক সাধারণ রোহিঙ্গাও আরসা সন্ত্রাসী দলের ওপর অতিষ্ঠ হয়ে গোপনে আরএসওকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। এদের যুক্তি আরএসও ক্যাম্পে শান্তি বজায় রাখতে চায়।
৮-এপিবিএনের সহকারী পুলিশ সুপার (অপারেশন অ্যান্ড মিডিয়া) ফারুক আহমেদ জানান, ক্যাম্পে একাধিক সশস্ত্র গ্রুপের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে বাড়ছে খুনোখুনি। কে আরসা, কে আরএসও সেটি বিষয় নয়। ক্যাম্পে কোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চলবে না। ক্যাম্প আমাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। যারাই অপরাধে জড়াবে, তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। কক্সবাজার নাগরিক আন্দোলনের সদস্য সচিব এইচএম নজরুল ইসলাম বলেন, রোহিঙ্গারা এখন স্থানীয়দের কাছে আতঙ্ক। তারা মাদক ও মানবপাচার, অবৈধ অস্ত্র ব্যবসা, অপহরণ ও খুনসহ নানা অপকর্ম করছে ক্যাম্পে। বর্তমানে ক্যাম্পগুলো অস্ত্র-মাদক মজুতেরও নিরাপদ জায়গা হিসেবে গড়ে উঠেছে। এমনকি ভাড়াটে খুনি ও অপহরণকারী হিসেবেও কাজ করছে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা। তিনি আরো বলেন, রোহিঙ্গারা যেভাবে অপরাধে জড়িত হচ্ছে, তা উদ্বেগের বিষয়। যেভাবেই হোক এদের দ্রুত মিয়ানমার ফেরত পাঠানো দরকার।
এদিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্যমতে, গত এক বছরে উখিয়া-টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্পে অভিযান চালিয়ে ৩৮০টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার ও ১৬৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। একই সময়ে ২৬ লাখের বেশি ইয়াবা ও ২৯ কেজি আইসসহ ৭৭৯ রোহিঙ্গাকে ধরা হয়। এছাড়া ১৩৬ রোহিঙ্গা অপহরণের ঘটনায় ১৮ মামলায় ২৯ জনকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।