প্রভাবশালীদের দখলে কুষ্টিয়ার হাওর-বাঁওড়

আয়ের উৎস হারাচ্ছে মৎস্যজীবীরা

প্রকাশ : ০৯ জুলাই ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  এএইচএম আরিফ, কুষ্টিয়া

দখলে-দূষণে জেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া আটটি নদ-নদী হারিয়ে যেতে বসেছে। হাওর-বাঁওড় বলতে গেলে এখন আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। একসময় কুষ্টিয়ায় বেশ কয়েকটি হাওর-বাঁওড় ছিল। আর এসব জলাশয় মৎস্যজীবীদের মৎস্য আহরণ ও আয়ের অন্যতম উৎস ছিল। বর্তমানে দখলদারের পেটে চলে গেছে হাওর-বাঁওড়। সেখানে গড়ে উঠেছে ঘরবসতি। বর্তমানে জেলায় যে দুটি হাওর ও বাঁওড় রয়েছে সে দুটিও এখন অস্তিত্ব সংকটে। সেখানে প্রকৃত মৎস্যজীবীদের মাছ চাষের সুযোগ নেই। দখলদারিত্ব চলে গেছে প্রভাবশালীদের হাতে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রশস্ততা কমিয়ে ভুল পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে কুষ্টিয়ার খোকসার সিরাজপুর হাওরটি এখন মৃত খালে পরিণত হয়েছে। বর্ষায়ও পানি নেই। নদীর দুই তীরের কয়েক লাখ বিঘা কৃষি জমির সেচ সুবিধা বন্ধ হয়ে গেছে। মৎস্য চাষের প্রকল্পটি বন্ধ হওয়ার উপক্রম। সবশেষ খননের পর এক ইউপি চেয়ারম্যান নিজে মাছ চাষ করার জন্য বাঁধ দিয়ে হাওর দখল করে নিয়েছেন বলে জানা গেছে। কুমারখালী উপজেলার লাহিনী এলাকায় কালীগঙ্গা-বাদলবাসা বাঁওড়টিও প্রভাবশালীরা দখলে নিয়ে মৎস্য চাষ করছেন। যে কারণে প্রকৃত মৎস্যজীবীরা এখানে মাছ চাষের সুযোগ থেকে বঞ্চিত।

কুমারখালী উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মাহামুদুল হাসান জানান, ২০২১ সালে বাঁওড়ের ইজারার মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। এরপর থেকে বাঁওড়টি আর ইজারা দেয়া সম্ভব হয়নি। প্রভাবশালী মহল উচ্চ আদালতে রিট করে নিজেদের দখলে রেখে সেখানে প্রায় দুই বছর ধরে মাছ চাষ করে আসছে। জেলার নদীর সঙ্গে সংযুক্ত একমাত্র প্রাকৃতিক হাওর নদী খোকসার সিরাজপুর মৌজায় গড়াই নদী থেকে উৎপত্তি। হাওরটি ২১ কিলোমিটার ভাটিতে মাগুড়ার শ্রীপুর উপজেলার আলমসা ইউনিয়নে গিয়ে আবার গড়াই নদীতে মিশেছে। চার দশক আগে বর্ষা মৌসুমে হাওর নদীতে ইলিশ ধরার প্রতিযোগিতা শুরু হতো। বাইরে থেকে জেলেরা নৌকা নিয়ে আসতেন। ’৯১ সালের পরবর্তী সময়ে নদীর দুই তীরের লক্ষাধিক বিঘা আবাদি জমি সেচের আওতায় নেয়া হয়। হাওরে মৎস্য সমিতির মাধ্যমে আধুনিক পদ্ধতির মাছ চাষের প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। ওই সময়ের কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ১৫০ মিটার প্রশস্ত নদী ৩৫ মিটার করা হয়।

নদীর স্বভাবিক প্রবাহ ঠেকাতে নদীর উৎসমুখ ও ভাটির মিলনস্থলে একাধিক সøুইস গেট তৈরি করা হয়। ফলে উৎসমুখ গড়াই থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে হাওরটি শুকিয়ে মৃত খালে পরিণত হয়েছে।

গতকাল শনিবার সরেজমিন দেখা গেছে, নদীর দুই তীরে জেগে ওঠা চরের জমি প্রভাবশালীরা দখল করে ঘরবাড়ি তৈরি করে বসবাস করছেন। অনেকেই ফসল আবাদ করে দখল পোক্ত করেছেন। কুষ্টিয়া, রাজবাড়ী ও মাগুড়া জেলার প্রায় ৩০টি গ্রাম স্পর্শ করে গেছে হাওরটি। এসব গ্রাম ও মাঠের পানি নিষ্কাশনের ৩০টি খাল এসে মিশেছে হাওরে। দুই পাড়ের হাজার হাজার একর জমি নানাভাবে দখলে করে নিয়েছেন প্রভাবশালীরা।

খোকসা অংশে জানিপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মজিবর রহমান মজিদ নিজে মাছ চাষের জন্য একতারপুর ব্রিজের পশ্চিম পাশ দিয়ে মাটি ফেলে চওড়া বাঁধ দিয়ে নদী ও হাওরটিকে দুই ভাগে বিভক্ত করেছেন। ফলে বর্ষা মৌসুমে পানিপ্রবাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন স্থানীয় কৃষকরা। বাঁধ দিয়ে পানির প্রবাহ বন্ধ করে দেয়ায় বিস্তীর্ণ এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

জানিপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যাান হবিবর রহমান হবি বলেন, নদীটির প্রশস্ততা কমিয়ে খাল বানানো হয়েছে। নদীর প্রবাহ ঠিক রেখে পরিকল্পিতভাবে খনন করা হলে নদীটি মারা যেত না। গতবছর ইজারা নিয়ে মাছ চাষ করেছিলেন জানিয়ে হাওর নদীর জলকর ইজারাদার আব্দুল মান্নান বলেন, বেতবাড়িয়া মোড় থেকে চর দশকাহুনিয়া পর্যন্ত কিছু জায়গায় সাতমাস পানি থাকে। কিন্তু এবার নদী খননের নামে খাল তৈরি করা হয়েছে। এতে এবার এ হাওরে মাছ চাষ করা যাবে না।

হাওর নদীর পানি ব্যবস্থাপনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক অনিতা বিশ্বাস বলেন, শুনেছেন নদী কাটা হচ্ছে। এখন দেখি নদী কেটে খাল বানানো হচ্ছে। জানিপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মজিবর রহমান মজিদ তার বিরুদ্ধে নদী-হাওর দখলের অভিযোগ সঠিক নয় বলে দাবি করেন। তিনি বলেন, খননের প্রয়োজনে সেখানে বাঁধ দেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে খোকসা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রিপন কুমার বিশ্বাস বলেন, নদী বা হাওর দখলের কোনো সুযোগ নেই। এ বিষয়ে কেউ অভিযোগ করেননি। অভিযোগ পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।