ঢাকা ৩০ অক্টোবর ২০২৪, ১৫ কার্তিক ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

কাঙ্গাল হরিনাথের ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’

অবশেষে জাদুঘরে যাচ্ছে পত্রিকার ছাপাখানা

অবশেষে জাদুঘরে যাচ্ছে পত্রিকার ছাপাখানা

জাতীয় জাদুঘর কর্তৃপক্ষের কাছে গ্রামীণ সাংবাদিকতার পথিকৃৎ কুষ্টিয়ার কুমারখালির কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদারের ব্যবহৃত ঐতিহাসিক ছাপাখানা ‘এম এন প্রেস’ হস্তান্তর করতে চুক্তি সই সম্পন্ন হয়েছে। চুক্তিপত্রে সই করেন কাঙ্গাল হরিনাথের চতুর্থ বংশধরের স্ত্রী শ্রীমতি গীতা মজুমদার। জাতীয় জাদুঘরের পক্ষে সই করেন মহাপরিচালক মো. কামরুজ্জামান।

জাতীয় জাদুঘর কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা যায়, চুক্তিপত্র হস্তান্তরের আনুষ্ঠানিকতার ১ নম্বর সাক্ষী হিসেবে সই করেন কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদারের পঞ্চম বংশধর দীপঙ্কর মজুমদার এবং দ্বিতীয় সাক্ষীর সই করেন সাংবাদিক কে এম আর শাহীন। ছাপাখানাটি আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে বাস্তুভিটা থেকে কুষ্টিয়ার কুমারখালীর কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার স্মৃতি জাদুঘরে নিয়ে আসা হবে। গত রোববার এসব তথ্য জানিয়েছেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মো. কামরুজ্জামান। তিনি জানান, গত শনিবার বেলা ১১টায় ঢাকা শাহবাগের জাতীয় জাদুঘরের নবনির্মিত বোর্ড সভাকক্ষে আনুষ্ঠানিকভাবে চুক্তিনামা সই করা হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন জাতীয় জাদুঘর পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক আ আ স ম আরেফিন সিদ্দিক। জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক আরো জানান, আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে ছাপাখানাটি জাদুঘরে হস্তান্তর করা হবে। কিন্তু বিনিময়ের বিষয়টি তিনি পরিবার থেকে জেনে নেওয়ার কথা জানিয়েছেন। এ বিষয়ে কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদারের পঞ্চম বংশধর দীপঙ্কর মজুমদার বলেন, ২০ লাখ টাকার চেক ও পরিবারের দুই সদস্যের চাকরি দেওয়ার শর্তে তার মা ছাপাখানাটি হস্তান্তরের চুক্তিনামায় সই করেছেন। চেকটি তারা হাতে পেয়েছেন। এই বিনিময়ে তিনি খুব খুশি। জানতে চাইলে চুক্তিনামার দ্বিতীয় সাক্ষী সাংবাদিক কেএমআর শাহীন বলেন, দুপক্ষের সমন্বয়হীনতার অভাবে দীর্ঘদিন ঝুলে থাকা কাজটি সম্পন্ন হয়েছে। ২০ লাখ টাকা ও বংশধরদের দুজনের চাকরির বিনিময়ে চুক্তিটি হয়েছে। ঐতিহাসিক এ চুক্তিপত্রে সই করতে পেরে তিনি গর্বিত। কুমারখালী কাঙ্গাল হরিনাথ স্মৃতি জাদুঘরের অনুসন্ধান কর্মকর্তা ওবাইদুল্লাহ বলেন, ২০১৭ সালে স্মৃতি জাদুঘরটি চালু হলেও ছাপাখানাটি এখনো কাঙ্গাল হরিনাথের বাস্তভিটায়। দর্শনার্থীরা এসেই আগে ছাপাখানাটি দেখতে চান। নানা জটিলতার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে কয়েকটি শর্তে ঐতিহাসিক স্বত্বটি হস্তান্তর করছেন বংশধররা। অচিরেই জাদুঘরে দর্শনার্থীরা ছাপাখানাটি দেখতে পাবেন। ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, কুষ্টিয়া জেলায় সর্বপ্রথম ট্রেডল মেশিন বা লেটারপ্রেসের প্রবর্তন করেন উপমহাদেশের সংবাদপত্রের পথিকৃৎ হরিনাথ মজুমদার ওরফে কাঙ্গাল হরিনাথ। কুষ্টিয়ার গড়াই নদীর তীরবর্তী কুমারখালী শহরের কুন্ডুপাড়ায় অভাব-অনটন সত্ত্বেও অবহেলিত সমাজের বৈষম্য এবং জমিদারদের অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে জনসাধারণকে সচেতন করতে ১৮৬৩ সালের এপ্রিল মাসে কাঙাল হরিনাথ প্রথম মাসিক সংবাদপত্র ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’ প্রকাশ করেন। প্রথম দিকে হাতে লিখে পত্রিকাটি প্রকাশিত হতো। পরে কলকাতার গিরিশচন্দ্র বিদ্যারত্নের যন্ত্রে ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’ মুদ্রিত ও কুমারখালী থেকে প্রকাশিত হতো। চার ফর্মার এই মাসিক পত্রিকার মূল্য ছিল পাঁচ আনা। শেষ দিকে এক পয়সার সাপ্তাহিক পত্রিকায় রূপান্তরিত হয় এটি। নিঃস্ব কাঙ্গাল হরিনাথ সারাজীবনে সচ্ছলতার মুখ না দেখলেও ১৮৭৩ সালে নিজ গ্রাম কুন্ডুপাড়ায় ’গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’ পত্রিকার নিজস্ব ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন। কলকাতা থেকে লেটারপ্রেস কিনে আনেন। দীর্ঘ ১৮ বছর রাজশাহীর রানি স্বর্ণকুমারী দেবীর অর্থ আনুকূল্যে পত্রিকা চালানোর পর আর্থিক অনটন ও সরকারের মুদ্রণ শাসন ব্যবস্থার কারণে পত্রিকাটি বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন। কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার আজ বেঁচে নেই। কিন্তু কুমারখালী শহরের কুন্ডুপাড়ায় তার ঐতিহাসিক সেই ছাপার যন্ত্র, এম এন প্রেস, হাত মেশিন, বাংলা টাইপ ও হরিনাথের কিছু পান্ডুলিপি আজও কালের স্মৃতি হয়ে আছে। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর বোমা হামলায় কাঙ্গাল হরিনাথের ছাপাখানা ঘরের ছাদ ধ্বংস হয়ে গেলেও ছাপাখানাটি কোনো রকমে রক্ষা পায়। বাড়ির এক কোণে আজও পড়ে আছে সেই প্রেসটি, যাতে রয়েছে কাঙ্গাল হরিনাথ, লালন শাহ, মীর মশাররফ হোসেন ও জলধর সেনের হাতের স্পর্শ।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত