জাতিসংঘের স্বাস্থ্য সতর্কতা জারি

বিশ্বজুড়ে আবহাওয়ার বিরূপ আচরণ

প্রকাশ : ২০ জুলাই ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  আলোকিত ডেস্ক

বিশ্বকে ক্রমবর্ধমান দাবদাহের মুখোমুখি হওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেছে জাতিসংঘ। কারণ, দিন দিনই উত্তপ্ত হচ্ছে বিশ্ব। দাবানল ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায়। এ পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বজুড়ে দাবদাহ আরো বাড়বে বলেই পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে। এশিয়া, ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় জারি করা হয়েছে স্বাস্থ্য সতর্কতা।

ক্যালিফোর্নিয়া থেকে চীন কর্তৃপক্ষ তীব্র দাবদাহের কারণে স্বাস্থ্য সতর্কতা জারি এবং জনগণকে বেশি করে পানি পান ও সূর্যের আলো থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দিয়েছে। বিশ্বজুড়েই রেকর্ড তাপমাত্রা বিরাজ করছে। চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্সে রেকর্ড তাপমাত্রা চলছে।

বেইজিংয়ে ২৩ বছরের ইতিহাস ভেঙে গত সাত দিন ধরে তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি রেকর্ড করা হয়েছে। এদিকে গ্রিস ও কেনারি দ্বীপে অগ্নিনির্বাপক সদস্যরা দাবানল নিয়ন্ত্রণে প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। স্পেন উচ্চ তাপমাত্রার কারণে রেড এলার্ট জারি করেছে। ইতালির সারদিনিয়া ও সিসিলি দ্বীপে তাপমাত্রা ৪৮.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়াতে পারে বলে পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে। এদিকে ইরানে ৬৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসেরও বেশি তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। গত সোমবার দেশটির দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রদেশ বুশেহেরের আসালুয়েহ জেলার পার্সিয়ান গালফ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এলাকায় দুপুর ১২টায় এই তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক জলবায়ু পর্যবেক্ষণ সংস্থা ইউএস স্টর্মওয়াচের কর্মকর্তা কলিন ম্যাকার্থি এক টুইট বার্তায় এই তথ্য নিশ্চিত করেন।

যুক্তরাষ্ট্রের লাখ লাখ লোককে মঙ্গলবার তীব্র তাপমাত্রা মোকাবিলা করতে হয়েছে। টেক্সাসের সান এঞ্জেলো শহরে তাপমাত্রা ৪০ থেকে ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছাবে বলে আবহাওয়া অফিস থেকে জানানো হয়েছে। জাতিসংঘের বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা বা ডব্লিওএমও বলেছে, তাপমাত্রা কমার কোনো লক্ষণ নেই। ডব্লিওএমও’র তীব্র তাপবিষযক উপদেষ্টা জন নায়ারণ জেনেভায় সাংবাদিকদের বলেছেন, তাপমাত্রা আরো বাড়বে। বিশ্বকে আরো দাবদাহের জন্য প্রস্তুত হতে হবে। ফ্রান্সের জলবায়ুবিষয়ক ইনস্টিটিউট পিয়েরে সিমন লাপেলেসের পরিচালক রবার্ট ভটার্ড বলেছেন, ইউরোপ ও বিশ্বজুড়ে চলা এই দাবদাহ কেবল একটি কারণে নয়, একাধিক বিষয় এতে রয়েছে। তবে তাপ তীব্র রূপ নেয়ার একটিই কারণ। আর সেটা হলো জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব।

এশিয়া, ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রের বড় অংশ যখন দাবদাহে পুড়ছে, একই সময়ে প্রবল বর্ষণ আর বন্যায় বিপর্যস্ত এশিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকা। যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম এবং দক্ষিণাঞ্চল গত সোমবার রেকর্ড তাপমাত্রা দেখেছে, উত্তর-পূর্বের প্রবল বৃষ্টি তৈরি করছে বন্যা পরিস্থিতি; আর মধ্য-পশ্চিমের দমবন্ধ দশা হয়েছে দাবানলের ধোঁয়ায়। যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিমাংশে যে দাবদাহ বইছে, তার জেরে গত রোববার ক্যালিফোর্নিয়ার ডেথ ভ্যালি মরুভূমিতে তাপমাত্রা পৌঁছায় ৫৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসে, যা গত ৯০ বছরে পৃথিবীতে রেকর্ড করা সর্বোচ্চ তাপমাত্রাগুলোর একটি। ফিনিক্সে গত সোমবার ৪৫.৫ ডিগ্রিতে পৌঁছেছে পারদ, রেকর্ড টানা ১৮ দিন ধরে সেখানে তাপমাত্রা রয়েছে ৪৩ ডিগ্রির ওপরে। আবহাওয়ার পূর্বাভাস বলেছে, আরো অন্তত এক সপ্তাহ এ পরিস্থিতি চলবে। কেবল যুক্তরাষ্ট্র নয়, তীব্র তাপে পুড়ছে উত্তর গোলার্ধের আরো অনেক এলাকা। চীনের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের প্রত্যন্ত শহর সানবাওয়ে তাপমাত্রা পৌঁছেছে ৫২.২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে, যা দেশটির রেকর্ড। ইউরোপ জ্বলছে দাবানলে, দুই সপ্তাহের মধ্যে দ্বিতীয় দফা তাপপ্রবাহের পূর্বাভাস এসেছে সেখানে, যাতে তাপমাত্রা উঠতে পারে ৪৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। এ পরিস্থিতিতে ইতালি ও ফ্রান্স স্বাস্থ্য সতর্কতা জারি করেছে।

জাপান, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া এবং ভারতের কিছু অংশ এই মাসে প্রবল বর্ষণ দেখেছে। এর জেরে আকস্মিক বন্যা আর ভূমিধস ডেকে এনেছে মৃত্যু, লাখো মানুষের জীবন হয়েছে বিপর্যস্ত। দক্ষিণ কোরিয়ার শহর চেওংজুতে তুমুল বৃষ্টির মধ্যে গত শনিবার একটি বাঁধ উপচে টানেল প্লাবিত হয়ে বহু যানবাহন আটকা পড়ে, মৃত্যু হয় ১৩ জনের। বৃষ্টি, বন্যা আর ভূমিধসের কারণে গত এক সপ্তাহে দক্ষিণ কোরিয়ায় অন্তত ৪১ জনের মৃত্যু হয়েছে, কয়েক হাজার মানুষ তাদের বাড়িঘর ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে বাধ্য হয়েছে। প্রাণঘাতী এই দুর্যোগের প্রেক্ষাপটে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট ইউন সুক ইওল দেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কাঠামো ঢেলে সাজানোর আহ্বান জানিয়েছেন।

তিনি সতর্ক করে বলেছেন, ‘এই ধরনের চরম আবহাওয়ার ঘটনা আগামীতে সাধারণ হয়ে উঠবে, আমাদের অবশ্যই জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টা মেনে নিতে হবে এবং মোকাবেলা করতে হবে।’ দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিবেশী জাপানের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে রেকর্ড বৃষ্টিপাতের ফলে প্রবল বন্যায় কমপক্ষে ছয়জন মারা গেছেন, আরও অনেকে নিখোঁজ রয়েছেন। জাপানের আবহাওয়া দপ্তরের একজন মুখপাত্র বলেছেন, ‘এমন বৃষ্টি আগে কখনো হয়নি।’ ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার বাসিন্দাদের সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।

অতি বৃষ্টি আর বন্যার এমন চিত্র দেখা যাচ্ছে দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার পুরো অঞ্চলজুড়ে। দক্ষিণে ফিলিপিন্স এবং কম্বোডিয়ার কিছু অংশে বন্যার কারণে ম্যানিলা ও নম পেনের মানুষকে ভুগতে হয়েছে। রেকর্ড বৃষ্টিপাতে ভারতের কয়েকটি রাজ্যে ঢল আর বন্যায় মারা গেছে কয়েক ডজন মানুষ, জনজীবন হয়ে পড়েছে স্থবির। জীবাশ্ম জ্বালানী পোড়ানোর জেরে পরিবেশে বাড়তে থাকা কার্বন গ্যাস যে জলবায়ু বদলে দিচ্ছে, আর তাতে আরো ঘন ঘন, আরো তীব্র মাত্রার তাপপ্রবাহ হওয়ার ঝুঁকি যে কেবলই বাড়ছে, বিজ্ঞানীরা সে কথা বলে আসছেন দীর্ঘদিন ধরে। এই জলবায়ু বিপর্যয় এড়াতে দ্রুত কার্বন গ্যাস নির্গমণ কমানোর উদ্যোগ নিতে বিশ্বনেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে আসছেন তারা। আর ৪৪০ কোটি মানুষের মহাদেশ এশিয়া জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আরো বেশি ঝুঁকিতে আছে, কারণ বন্যা, তাপদাহ, খরার মতো আবহাওয়াজনিত দুর্যোগগুলার পর খাবার পানির সংকট এবং ফসলহানীর মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়, আর তাতে গতি হারায় অর্থনীতি। গত বছর বিপর্যয় ডেকে আনা বন্যায় পাকিস্তানে ১ হাজার ৭০০ মানুষ মারা যান। গৃহহীন হন লাখ লাখ মানুষ। ফসল নষ্ট হওয়ায় একদিকে মুদ্রাস্ফীতি বেড়েছে। অর্থনীতির যে ক্ষতি হয়েছে, তাতে দক্ষিণ এশিয়ার দেশটি স্বাধীনতার পর সবচেয়ে বাজে সময়ের মধ্যে যাচ্ছে।

দেশটির প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ গত বছর সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে বিশ্ব নেতাদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘একটি বিষয় খুব স্পষ্ট, পাকিস্তানে যা ঘটেছে তা কেবল পাকিস্তানে থাকবে না। জলবায়ু পরিবর্তন কোনো দেশকে রেহাই দেবে না। জাতীয় নিরাপত্তার পুরো সংজ্ঞাই আজ বদলে গেছে। বিশ্ব নেতারা একজোট হয়ে এখনই এ বিষয়ে উদ্যোগী না হলে একদিন যুদ্ধ করার জন্য পায়ের নিচে কোনো পৃথিবী থাকবে না।