মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগরে হাসাড়া ইউনিয়নের আড়িয়াল বিলের তীরবর্তী আলমপুর গড়ে উঠা আহ্ছানিয়া মিশন হেনা আহমেদ মনোযত্ন কেন্দ্রে মৌনতায় চিকিৎসাসেবা নিতে আসা মাদকাসক্ত ও মানসিক রোগীসহ যেকোনো ধরনের আসক্ত রোগীরা তাদের সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাচ্ছেন। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে চিকিৎসা শুরু করে এ প্রতিষ্ঠানটি। এ অল্প সময়ে তাদের এখানে আসা বিভিন্ন ধরনের আসক্ত রোগীরা চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হওয়ায় চতুর্দিকে তাদের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে শুরু করছে।
গত ৮ জুলাই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সরে জমিনে উপস্থিত থেকে তিনতলা ভবন বিশিষ্ট আহছ্ানিয়া হেনা আহমেদ মনোযত্ন কেন্দ্রের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। প্রতিষ্ঠানটির শুরু থেকে এ পর্যন্ত মোট ৬৪ জন মাদকাসক্ত ও বিভিন্ন মানসিক রোগী হেনা আহমেদ মনোযত্ন কেন্দ্র থেকে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে বইড় ফিরে গেছেন। পরবর্তী সময়ে ফলোআপ চিকিৎসা নিয়েছেন আরো পাঁচজন। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটিতে চিকিৎসাধীন আছেন ১৪ জন রোগী। এদের মধ্যে কেউ মাদকাসক্ত, কেউ আবার মানসিক রোগী। কেন্দ্রটিতে রয়েছে অর্ধশত বেড, কেবিন, ডিল্যাক্স শয্যা, লাইব্রেরি, শরীর চর্চার জন্য জিম, অ্যাম্বুলেন্স প্রভৃতি সুবিধা। এছাড়া ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন পরিচালিত পার্শ্ববর্তী হেনা আহমেদ হাসপাতাল থেকে এক্স-রে, অত্যাধুনিক সব ডায়াগনস্টিক, আল্ট্রাসনোগ্রাম, আধুনিক মানের অপারেশন থিয়েটার ও জরুরি চিকিৎসাসেবার সুবিধাও রাখা হয়েছে এই কেন্দ্রে।
গত বুধবার সরেজমিনে গিয়ে কথা হয় ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশনের স্বাস্থ্য বিভাগের সিনিয়র সাইকোলজিস্ট রাখী গাঙ্গুলির সঙ্গে। সিনিয়র সাইকোলজিস্ট রাখী গাঙ্গুলি জানান, ‘মাদকাসক্ত বা মানসিক সমস্যা নিয়ে যখন কোনো রোগীর স্বজনরা রোগীকে নিয়ে আমাদের এখানে আসে তখন প্রথমেই খুব গুরুত্ব সহকারে তার সমস্যা শোনা হয়। প্রয়োজনে রোগীর পাশাপাশি স্বজনদেরকেও কাউন্সিলিং করানো হয়।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের এখান থেকে অনেকে রোগী সুস্থ হয়ে বাড়ি গেছেন। তবে বাড়ি যাবার পরও এক বছর পর্যন্ত আমরা নিয়মিত ওইসব রোগীকে ফলোআপের মাধ্যমে খোঁজখবর নিয়ে থাকি।
লন্ডন থেকে পাশ করা মাসকাসক্ত একজন ব্যারিস্টারের কথা বলেন তিনি। যিনি ঢাকার একটি সুপার সপের উপদেষ্টা হিসাবে চাকরি করতেন। নবমণ্ডদশম শ্রেণিতে পড়াকালীন সময় থেকে তিনি মাদকাসক্ত ছিলেন। পরবর্তী সময়ে তার পিতামাতা তাকে ব্যারিস্টারি পড়তে লন্ডনে পাঠান। সেখানে গিয়ে তিনি আরো মাদকাসক্ত হয়ে পড়েন। লন্ডন থেকে লেখা পড়া শেষে দেশে এসে একটি সুপার শপের উপদেষ্টা হিসেবে জয়েন করেন এবং সামাজিক জীবনে তিনি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন এবং দাম্পত্য জীবনে একটি সন্তানের জন্ম হয়। তিনি দেশে এসেও মাদকাসক্ত হয়ে স্ত্রী সন্তানসহ পিতামাতার সঙ্গে অস্বাভাবিক আচরন করতে থাকেন। একপর্যায়ে তার স্ত্রী তাকে ডির্ভোস দিয়ে সন্তান নিয়ে চলে যান। এরপর তার পিতামাতা দেশের বিভিন্ন জায়গায় চিকিৎসা গ্রহণ করান। তাতেও তিনি সুস্থ জীবনে ফিরে না আসায় সর্বশেষ হেনা আহমেদ মনোযত্ন কেন্দ্রে নিয়ে এসে চিকিৎসা গ্রহণ করান। তিনি এখানে আট মাস চিকিৎসা নিয়ে বর্তমানে স্বাভাবিক ও জীবনযাপন করছেন। আরেক চাকরিজীবীর কথা বলেন। তিনি কিছু কিশোর বেলা থেকে মাদকাসক্ত, অসামাজিক কাজ ও জুয়ায় মত্ত ছিলেন। একটি ভালো চাকরি করতেন। কিন্তু, তার সব টাকাণ্ডপয়সা জুয়া খেলে ও অনৈতিক কাজে খরচ করে ফেলতেন। তার পরিবার চিকিৎসার জন্য তাকে নিয়ে নানা জায়গায় গেছে। কিন্তু, সব জায়গায় ব্যর্থ হন। পরবর্তী সময়ে শ্রীনগরের এ হেনা আহমেদ মনোযত্ন কেন্দ্রে তিন মাস চিকিৎসা নিয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন করছেন বলে জানান সিনিয়র এই সাইকোলজিস্ট। বাংলাদেশে তো আরো মাদক নিরাময় কেন্দ্র রয়েছে। তাদের সঙ্গে আহ্ছানিয়া হেনা মনোযত্ন কেন্দ্রের পার্থক্য কী জানতে চাইলে সিনিয়র এ সাইকোলজিস্ট বলেন, ‘আমাদের এখানে চিকিৎসার মৌলিক কিছু পার্থক্য অবশ্যই রয়েছে। আমরা চিকিৎসা শুরু করার পর ধূমপানের কোনো সুযোগ দেই না। আমাদের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে, একজন মাদকাসক্ত ব্যক্তির দৈহিক চিকিৎসার পাশাপাশি আচরণের পরিবর্তন, নৈতিক গুণাবলী, শিক্ষা প্রদান, ধর্মীয় মূল্যবোধ বাড়ানো এবং এমনভাবে সুস্থ করে তোলা, যাতে সে জীবনের সাধারণ সমস্যা মোকাবিলা করতে পারে।’