খুরুশকুল বিশেষ আশ্রায়ণ প্রকল্প
জীবন-জীবিকার নিশ্চয়তা পাচ্ছে জলবায়ু উদ্বাস্তুরা
প্রকাশ : ২৩ জুলাই ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
রাহাত হুসাইন, কক্সবাজার থেকে
জীবন-জীবিকার নিশ্চয়তা পাচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত উদ্বাস্তুরা। কক্সবাজার জেলার জলবায়ু উদ্বাস্তু ও ভূমিহীনরা শঙ্কা ও অনিশ্চয়তার কালো মেঘ কাটিয়ে ফিরেছে স্বস্তির জীবনে। জলবায়ু উদ্বাস্তু ও ভূমিহীনদের জন্য কক্সবাজার সদরের খুরুশকুলে নির্মাণ করা হয়েছে বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্প। প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকারভিত্তিক আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় এ প্রকল্পে এরই মধ্যে ২০টি বহুতল ভবনের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে।
প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বিভিন্ন সময়ে ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত ৬০০ টি পরিবার বসবাস করছেন খুরুশকুলে নির্মিত বহুতল ভবনে। চেষ্টা করছেন ঘুরে দাঁড়াতে। ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের মতো ভয়াবহ স্মৃতি ভুলতে চায় তারা। আশ্রয়ণের ঘর সবার চোখে-মুখে ফুটিয়েছে আনন্দ। তাদের সন্তানদের দিয়েছে নিরাপদ জীবনের নিশ্চয়তা।
খুরুশকুল বিশেষ আশ্রায়ণ প্রকল্পে বাস করেন সাজেদা বেগম। তিনি জলবায়ু উদ্বাস্তু। জানতে চাইলে সাজেদা বেগম আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, আমরা একেবারেই গরির মানুষ। কুতুবদিয়ার উত্তর কৈয়ারবিলের ১ নম্বর ওয়ার্ডে আমার জন্ম, সেখানে থাকতাম। কোনো রকম খেয়ে পড়ে বাঁচতাম। ঝড়-তুফান হলেই লণ্ডভণ্ড হয়ে যেত আমাদের ঘরবাড়ি। জীবন বাঁচাতে আমরা সাইক্লোন সেন্টারে গিয়ে উঠতাম। সাইক্লোন সেন্টার আমাদের বাড়ি থেকে অনেক দূরে ছিল। বড় ধরনের ঝড়-বৃষ্টি হলে সাইক্লোন সেন্টারের নিচেও পানি জমে যেত।
কুতুবদিয়ায় আতঙ্কে বসবাস করতাম। আতঙ্ক আর ভয়ের জীবন থেকে মুক্তি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এখন আমরা বিল্ডিংয়ে বাস করি। ঝড়-তুফানের ভয় নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের বিল্ডিংয়ে ঘর দিয়েছেন। আমি তার জন্য দোয়া করি।
আশ্রয়ণ প্রকল্পে আসার আগে মহেশখালী চরপাড়ায় থাকতেন আবুল কালাম। তিনি খুরুশকুল বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্পে একটি ঘর পেয়েছেন। ঘরে একটি বেড রুম, ড্রয়িং, ডাইনিং ও রান্না ঘরসহ এটাস ওয়াশ রুম পেয়েছেন। জানতে চাইলে তিনি বলেন, আগে ঝড়-বৃষ্টির আর জলোচ্ছ্বাসের মধ্যে জীবনযাপন করতাম। বাঁশ আর টিনের ঘরে থাকতাম। এখন আমি একটা ফ্ল্যাট বাসা পেয়েছি। ঝড়-বৃষ্টির কোনো ভয় নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাকে ভালোভাবে থাকার সুযোগ করে দিয়েছেন। আগে ঘূর্ণিঝড়ের সময় পরিবার-পরিজনদের নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকতাম, এখন সেই চিন্তা দূর হয়েছে। এখনে আমি নাইটগার্ড হিসেবে কাজ করি। যে টাকা বেতন পাই তা দিয়ে আমার সংসার চলে যায়।
খুরুশকুল আশ্রায়ণ প্রকল্পের মনুপাড়ায় ৫০১ নাম্বার ইউনিটের দুইটি কক্ষে পরিবার নিয়ে থাকেন ৬৫ বছরের আলী হোসেন। তিনি বলেন, বিল্ডিংঘরে থাকবো স্বপ্নেও ভাব নাই। আল্লাহ আমার মুখের দিকে তাকাইছে। প্রধানমন্ত্রী বিল্ডিং ঘর দিয়েছেন। কোনো টাকাণ্ডপয়সা লাগেনি। ঝড়-তুফান আর ভয় পাই না। জানা গেছে, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ। দেশের মানুষ প্রতি বছর এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে উপকূলীয় এলাকার মানুষের জীবন ও জীবিকার ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয়। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, নদীভাঙন ও জলোচ্ছ্বাসে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জীবন ও জীবিকার রক্ষার্থে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ‘খুরুশকুল বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্প’ গ্রহণ করে সরকার। ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস আক্রান্ত উপকূলীয় অঞ্চল কক্সবাজারের মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) এর সাথে সামঞ্জস্য রেখে প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়। এ প্রকল্পের আওতায় ৫-তলা বিশিষ্ট ১৩৯ টি বহুতল ভবন নির্মাণ করে ৪৪০৯ টি জলবায়ু উদ্বাস্তু পরিবার পুনর্বাসন করা হবে। পুনর্বাসিত পরিবারগুলোর অর্থনৈতিক সচ্ছলতা নিশ্চিত করা হবে। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রকল্পটি বিশ্বের বৃহত্তম জলবায়ু উদ্বাস্তু পুনর্বাসন প্রকল্প হিসেবে দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে। খুরুশকুল বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্পে পুনর্বাসিতব্য মোট পরিবার ৪ হাজার ৪০৯টি। প্রকল্পের মোট জমি ২৫৩ দশমিক ৫৯ একর। এতে ব্যয় হবে ১ হাজার ৪৬৭ কোটি। ২০২০ সালের জুনে শুরু হওয়া প্রকল্পর কাজ শেষ হবে চলতি বছরের ডিসেম্বরে। ৫ তলাবিশিষ্ট মোট ভবন রয়েছে ১৩৯টি। প্রকল্প এলাকায় মোট জোন চারটি, প্রতিটি ভবনে ফ্ল্যাটের সংখ্যা ৩২টি, প্রতিটি ফ্ল্যাটের আয়তন (নিট ব্যবহারযোগ্য) ৪০৬.৭ বর্গফুট, প্রতিটি তলায় কমন সার্ভিস সুবিধা রয়েছে। প্রকল্পে যাতায়াতের সুবিধার্থে বাঁকখালী নদীর উপর কক্সবাজার শহর থেকে খুরুশকুলের ৫৯৫ মিটার দীর্ঘ ব্রিজ। প্রকল্পের প্রবেশ পথ দুটি, অভ্যন্তরীণ পাকা রাস্তা ২০ কিলোমিটার।
উপকারভোগীদের সন্তানদের লেখাপড়ার জন্য একটি প্রাথমিক ও একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, খেলার মাঠ ১৪টি, পুকুর তিনটি, মসজিদ একটি ও মন্দির রয়েছে একটি। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক লে. কর্নেল আফজাল হোসেন বলেন, প্রকল্পর আওতায় এরই মধ্যে ২০টি ভবন নির্মিত হয়েছে। ৬০০টি পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ তথা ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস রোধে পানি উন্নয়ন বোর্ডের টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। পুনর্বাসিত পরিবারের জীবিকার সুবিধার্থে আধুনিক শুঁটকি মহাল, জীবন-মান উন্নয়নের জন্য ৯৫.০০ একর জায়গার ওপর শেখ হাসিনা টাওয়ার স্থাপন ও তাদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে কর্মক্ষম করে গড়ে তোলার পাশাপাশি সরকারি বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হচ্ছে। তিনি আরো জানান, প্রদত্ত ফ্ল্যাট হস্তান্তর ও রক্ষণাবেক্ষণের সুবিধার্থে আলাদা নীতিমালাও প্রণয়ণ করা হয়েছে। এছাড়া উপকারভোগীদের নিরাপত্তার জন্য পুলিশ ফাঁড়ি, ফায়ার সার্ভিস স্টেশন ও বাফার জোন স্থাপন করা হবে।