১০ বছরে মাছের উৎপাদন বেড়েছে ৫৫ শতাংশ
জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ উপলক্ষ্যে সংবাদ সম্মেলনে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম
প্রকাশ : ২৫ জুলাই ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
নিজস্ব প্রতিবেদক
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বলেছেন, মৎস্য খাতে সরকার সময়োপযোগী নীতি ও পরিকল্পনা গ্রহণের কারণে অনেক অগ্রগতি হয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে মোট মাছ উৎপাদন হয়েছে ৪৭ দশমিক ৫৯ লাখ টন; যা ২০১০-১১ অর্থবছরের মোট উৎপাদনের (৩০ দশমিক ৬২ লাখ টন) চেয়ে প্রায় ৫৫ শতাংশ বেশি।
গতকাল জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ উপলক্ষ্যে এক সংবাদ সম্মেলনে শ ম রেজাউল করিম এসব কথা বলেন। এর আগে গতকাল সকাল ৮টায় রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে জাতীয় মৎস্য সপ্তাহের কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে র্যালি অনুষ্ঠিত হয়। র্যালির পর সকাল সাড়ে ১০টায় মৎস্য ভবনে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রী জানান, বর্তমানে মৎস্য উৎপাদন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পাওয়ায় মাথাপিছু দৈনিক মাছ গ্রহণ ৬০ গ্রাম চাহিদার বিপরীতে বৃদ্ধি পেয়ে ৬৭ দশমিক ৮০ গ্রামে উন্নীত হয়েছে।
মাছ রপ্তানির ক্ষেত্রে কোনো ভেজাল না মেশানোর আহ্বান জানিয়ে শ ম রেজাউল করিম বলেন, কোনোরূপ অনিয়মের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়া যাবে না। মাছ রপ্তানির ক্ষেত্রে কোনো ভেজাল মেশানো যাবে না। দেশ গঠনে সবাইকে ভূমিকা রাখতে হবে।
মাছের খাবারের মান নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী বলেন, কিছু কিছু ক্ষেত্রে অসাধু ব্যবসায়ীরা মাছের খাবারে খারাপ জিনিস মেশায়। তাদের ব্যাপারে অনেক জায়গায় মোবাইল কোর্টের ব্যবস্থা করেছি, খামারিদের সচেতন করেছি। স্থানীয় পর্যায়ে ফিসারিজ অফিসাররা হঠাৎ ভিজিট করছেন। যেখানে এ রকম অবস্থা দেখা যাচ্ছে, সেখানেই পদক্ষেপ নিচ্ছি। এক্ষেত্রে আইনের কঠোর বাস্তবায়ন করতে হবে। যারা মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করেন, তাদের আরো তৎপর হওয়া দরকার।
বাংলাদেশে যখন সমুদ্রে ইলিশ মাছ ধরা বন্ধ থাকে তখন ভারতসহ পার্শ্ববর্তী দেশগুলো আমাদের সীমানায় প্রবেশ করে মাছ ধরে নিয়ে যাচ্ছে সে বিষয়ে কী উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে- জানতে চাইলে শ ম রেজাউল করিম বলেন, বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ আছে। এই গ্রুপের কার্যক্রম চলমান। আমরা আশা করছি শিগগির বৈঠকে বসব। বাংলাদেশ প্রান্তে যেসব নদী আছে, সেখানে আমরা যখন ইলিশ ধরা বন্ধ রাখি, ভারতের জলবায়ু ও নদীর প্রবাহ দীর্ঘ হওয়ার কারণে কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিন্তু একই অবস্থা না। আমাদের প্রান্তসীমায় তাদের নদী ও আমাদের নদীতে সমন্বিতভাবে যাতে একই কর্মসূচি নেওয়া যায়; সেটা আমরা ওয়াকিং গ্রুপে আলোচনা করব।
ইলিশ মাছ ছাড়া অন্য মাছ কতটুকু রপ্তানি হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, মাছের পুষ্টি পৌঁছে দেওয়া আমাদের লক্ষ্য। এরপর যতটুকু উদ্বৃত্ত থাকে তা রপ্তানি করতে চাই। এ বিষয়ে সঠিক তথ্যের জন্য মৎস্য অধিদপ্তরে যোগাযোগ করার জন্য বলেন তিনি। এছাড়া নিরাপদ মাছের বিষয়টি আমরা নিশ্চিত করতে চাই। বছর শেষে আমরা প্রতিবেদন প্রকাশ করি, কোন অঞ্চলের মাছে নিরাপদ উপাদানের ঘাটতি আছে তা নিয়ে।
সাকার মাছ নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, সাকার মাছ আমরা কেউ আমদানি করিনি। আমাদের দেশ নদীমাতৃক। নদীর সংযোগ কিন্তু সমুদ্র থেকে, অন্যান্য সমুদ্র ও নদীর মোহনায়। বিভিন্নভাবে অনাকাঙ্খিত মাছও চলে আসে। সাকার মাছের বৃদ্ধি খুব দ্রুত গতিতে হয়। এটাকে আমরা নিষিদ্ধ করার মধ্যদিয়ে একটি মেসেজ দিচ্ছি, এটি ক্ষতিকর, খাবারের জন্য, মানুষের জন্য, জলাশয়ের জন্য। বিভিন্ন জায়গায় কিন্তু আমরা ইতোমধ্যে পদক্ষেপ নিয়েছি, যাতে এই মাছগুলোকে বিনাশ করা যায়।
তিনি বলেন, আমাদের ওই রকম সক্ষমতা নেই প্রতিটি নদীতে জাল দিয়ে অথবা মেশিন দিয়ে সাকার মাছকে পৃথক করে ফেলতে পারব। মানুষকে যত উৎসাহিত করতে পারব, মানুষ যত সচেতন হবে তত এক্ষেত্রে আমরা সফল হব। আমরা আশা করছি এ বিষয়ে আরো ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করে সাকার মাছকে কীভাবে বিনাশ করা যায়, সেই পদক্ষেপে যাব।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার দেশে মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি মৎস্যজীবীদের উন্নয়নে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। প্রকৃত জেলেদের শনাক্ত করে তাদের নিবন্ধন ও পরিচয়পত্র বিতরণ করা হয়েছে। এ প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। জাটকা সংরক্ষণে ৪ মাস পরিবারপ্রতি মাসিক ৪০ কেজি এবং ইলিশের প্রধান প্রজনন মৌসুমে ২২ দিনের জন্য পরিবারপ্রতি ২৫ কেজি হারে চাল প্রদান করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, ২০২২-২৩ অর্থবছরে জাটকা ও মা ইলিশ আহরণ নিষিদ্ধ সময়ে ৯ লাখ ১৫ হাজার ৭৫৬টি জেলে পরিবারকে মোট ৭১ হাজার ৬১১ মেট্রিক টন চাল বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়া প্রতি বছর ৬৫ দিন সমুদ্রে মাছ ধরা নিষিদ্ধকালে উপকূলীয় জেলার নিবন্ধিত জেলেদের মাসিক ৪০ কেজি করে ভিজিএফ (চাল) বিতরণ করা হচ্ছে। তাছাড়া ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য ইলিশ আহরণকারী ৩০ হাজার জেলে পরিবারের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও ১০ হাজার ইলিশ-জাল বিতরণসহ বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। দরিদ্র জেলেদের সঞ্চয়ী করে তোলা ও আপৎকালীন জীবিকা পরিচালনা এবং বিকল্প কর্মসংস্থানের সহায়ক তহবিল গঠনের জন্য ৩ কোটি ৫০ লাখ টাকার ‘ইলিশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন তহবিল’ গঠন করা হয়েছে।
এছাড়া সাসটেইনেবল কোস্টাল অ্যান্ড মেরিন ফিশারিজ প্রকল্পের আওতায় আইডি কার্ড প্রদানের জন্য ১ লাখ ৫০ হাজার মৎস্যজীবীর ডাটাবেজ হালনাগাদ করা হয়েছে। উপকূলীয় মৎস্য আহরণের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে ৫২ হাজার ৪৯৩টি মৎস্যজীবী পরিবার সমন্বয়ে ৪৫০টি মৎস্যজীবী গ্রাম সংগঠিত করা হয়েছে। সমুদ্রগামী মৎস্য নৌযানগুলো যথাযথভাবে তদারকি, নিয়ন্ত্রণ এবং সার্ভিল্যান্স করার জন্য ডিজিটালাইজ করা হচ্ছে।
এ সময় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. নাহিদ রশীদ, অতিরিক্ত সচিব মো. আব্দুল কাইয়ূম ও এটিএম মোস্তফা কামাল, বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশনের চেয়ারম্যান সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দর, মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক খ. মাহবুবুল হক, বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় ও মৎস্য অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
জাতীয় মৎস্য সপ্তাহের অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. নাহিদ রশীদ, বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশনের চেয়ারম্যান সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দর, মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক খ. মাহবুবুল হক, বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ প্রমুখ।
এর আগে গতকাল সকালে রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে জাতীয় মৎস্য সপ্তাহের কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে র্যালি হয়। জাতীয় সংসদ ভবনের সামনে থেকে শুরু হয়ে বঙ্গবন্ধু চত্বর ঘুরে পুনরায় সংসদ ভবনের সামনে এসে র্যালিটি শেষ হয়। বেলুন ও পায়রা উড়িয়ে অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন শ ম রেজাউল করিম।
গতকাল থেকে জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ শুরু হয়েছে। সপ্তাহের দ্বিতীয় দিন আজ সকাল ১০টায় রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। তিনি জাতীয় মৎস্য সপ্তাহের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন।
এ অনুষ্ঠানে দেশের মৎস্য খাতে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ আটটি ক্ষেত্রে ২১ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে জাতীয় মৎস্য পদক, ২০২৩ প্রদান করা হবে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে দুপুরে জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী জাতীয় সংসদ ভবন লেকে মাছের পোনা অবমুক্ত করবেন। এদিন সংবাদপত্রে দেশের মৎস্য খাতের সাফল্য ও অর্জন নিয়ে নিবন্ধ প্রকাশ করা হবে। তৃতীয় দিন ২৬ জুলাই বিকাল ৪টায় রাজধানীর হাতিরঝিলে বর্ণাঢ্য নৌ র্যালি অনুষ্ঠিত হবে। সপ্তাহের চতুর্থ দিন ২৭ জুলাই সকালে ঢাকায় বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল মিলনায়তনে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট সেমিনার আয়োজন করবে। এদিন বিকাল ৫টায় রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন বঙ্গভবন পুকুরে মাছের পোনা অবমুক্ত করবেন।