পার্বত্য চট্টগ্রামের গহীন পাহাড়ে জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার আল ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া সদস্যদের আশ্রয় এবং প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছিল পাহাড়ি সশস্ত্র সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ)। এবার জানা গেল কেএনএফ প্রধান নাথান বমকে রাজধানী ঢাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে দিয়ে আত্মগোপনে রাখার ব্যবস্থা করেছিল হিন্দাল শারক্বীয়ার আমির। গত অক্টোবর থেকে পাহাড়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান শুরু হয়। তখন আত্মগোপনে চলে যায় নাথান বম। কিন্তু তার আগে ২০২২ সালের শুরু থেকে আট মাস ধরে রাজধানীর বাসাবোতে একটি বাসাতেই ভাড়া থেকেছেন তিনি। র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন এ তথ্য জানিয়েছেন। গতকাল সোমবার দুপুরে কারওয়ান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান তিনি।
খন্দকার আল মঈন বলেন, জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার আল ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার আমির মো. আনিসুর রহমান মাহমুদ কেএনএফ প্রধানকে বাসাটি ২০ হাজার টাকায় ভাড়া করে দেন। আর নাথান বমের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ ছিল হিন্দাল শারক্বীয়ার আমিরের। আনিসুর রহমান মাহমুদ জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার আল ফিল হিন্দাল শারক্বীয়াকে দক্ষিণ এশিয়ায় একটি শক্তিশালী জঙ্গি সংগঠন বানাতে চেয়েছিলেন। সে লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছিল। সংগঠনকে সংগঠিত করে টার্গেট কিলিংয়ের পরিকল্পনা ছিল তার। অবশেষে গত রোববার ভোর রাতে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে মুন্সীগঞ্জের লৌহজং এলাকায় একটি বাড়িতে অভিযান পরিচালনা করে মো. আনিসুর রহমান ওরফে মাহমুদকে দুই দেহরক্ষীসহ গ্রেপ্তার করে র্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র্যাব-১০ এর একটি দল। তারা হলেন কাজী সরাজ উদ্দিন ওরফে সিরাজ (৩৪) ও মাহফুজুর রহমান বিজয় ওরফে বাবুল ওরফে জাম্বুলি (২৮)। গ্রেপ্তারের সময় তাদের কাছ থেকে দেশি-বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র, বোমা তৈরির সরঞ্জাম, উগ্রবাদী বই জব্দ করা হয় বলেও জানায় র্যাব কমান্ডার।
কমান্ডার খন্দকার মঈন আরো বলেন, গ্রেপ্তারের পর র্যাব জানতে পেরেছে। জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার আমির আনিসুর রহমান মাহমুদ দাওরায়ে হাদিস সম্পন্ন করেছেন। এক সময় কুমিল্লা দক্ষিণের একটি সিএনজি রিফুয়েলিং পাম্পে ম্যানেজার হিসেবে চাকরি করতেন। মাহমুদ হুজির সদস্য ছিলেন। পরবর্তীতে কুমিল্লার একটি রেস্টুরেন্টে আনসার আল ইসলামের রক্সি ও ফেলানীর সঙ্গে পরিচয় হয়।
পরবর্তীতে তারা যাত্রাবাড়ীতে একটি বৈঠক করে নতুন একটি সংগঠন তৈরি ও বিস্তারের পরিকল্পনা করে ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র কার্যক্রম শুরু করেন। মাহমুদ কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় সংগঠনের দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনা করেন। ২০১৬ সাল পরবর্তী বিভিন্ন সময় বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির বিভিন্ন মসজিদে গিয়ে সংগঠনের দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনা করতেন। এরপর মাহমুদ বান্দরবনে এক মাস সামরিক বিভিন্ন কৌশল, অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। প্রশিক্ষণ শেষে কুমিল্লার প্রতাপপুরে মাহমুদ তার বাড়িসহ জমি এক ব্যক্তির নিকট ৫০ লাখ টাকায় বিক্রি করে দেন এবং তিনি জমি বিক্রির কিছু টাকা সংগঠনে দেন। বাকি টাকা দিয়ে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়িতে সাড়ে তিন বিঘা জমি কিনে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন এবং পোল্ট্রি ফার্ম, চাষাবাদ ও গবাদি পশুর খামার পরিচালনা করতেন।
র্যাব জানায়, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী জঙ্গি সংগঠন বানাতে চেয়েছিলেন শারক্বীয়ার আমির মো. আনিসুর রহমান ওরফে মাহমুদ। দেশের বাইরে হামলার কোনো পরিকল্পনা না থাকলেও দেশের মধ্যে হামলার পরিকল্পনা ছিল তাদের। তারা টার্গেট কিলিং মিশনের পরিকল্পনা করেছিল। মুক্তমনা মানুষ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের টার্গেট করে কিলিং মিশন করার পরিকল্পনা ছিল। আর তাদের আইনের আওতায় আনতে গেলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর সশস্ত্র হামলার পরিকল্পনা করছিলেন আমির মাহমুদ।
তিনি আরো বলেন, আনিসুর রহমানের আগে নতুন জঙ্গি সংগঠনটির আমির ছিলেন মাইনুল ইসলাম ওরফে রক্সি। ২০২১ সালে রক্সি গ্রেপ্তার হলে আনিসুর রহমানকে আমির করা হয়। এদিকে পার্বত্য অঞ্চলে অবস্থানের সময় মাহমুদের সঙ্গে ‘কেএনএফ’ সদস্যদের পরিচয় হয়। কেএনএফ প্রধান নাথান বম ও সেকেন্ড ইন কমান্ড বাংচুংয়ের সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি হয় আনিসুরের। পরে তাদের মধ্যে পাহাড়ে জামাতুল আনসারের সদস্যদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দেওয়ার বিষয়ে তাদের মধ্যে চুক্তি হয়।
র্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, চুক্তি অনুযায়ী কেএনএফ ২০২৩ সাল পর্যন্ত নতুন জঙ্গি সংগঠনের সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেবে। এর বিনিময়ে কেএনএফকে ৩-৪ লাখ টাকা দিত তারা। এই টাকা দিতে জঙ্গি সংগঠন দেশ-বিদেশে অর্থ সংগ্রহ শুরু করে। আমিরের নির্দেশে কেএনএফ থেকে ১৭ লাখ টাকার বিভিন্ন ধরনের ভারি অস্ত্র ও বিদেশি অগ্নেয়াস্ত্র কিনে সংগঠনটি। এই অস্ত্র ব্যবহার করে প্রশিক্ষণ নিত। এছাড়া মাহমুদের নির্দেশে দেশের বিভিন্ন স্থানে আনসার হাউজ তৈরি এবং পরিচালিত হতো।
পলাতক জঙ্গি নেতা চাকরিচ্যুত মেজর জিয়ার সঙ্গে মাহমুদের একাধিকবার দেখা হয়েছে জানিয়ে র্যাবের মুখপাত্র বলেন, আমির মাহমুদের সঙ্গে আনসার আল ইসলামের নেতাদের সুসম্পর্ক ছিল। শীর্ষ জঙ্গি চাকরিচ্যুত মেজর জিয়ার সঙ্গে তার বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছিল। ২০২২ সালে কিশোরগঞ্জে আনসার আল ইসলামের সঙ্গে একটি মিটিংয়ে মাহমুদের সঙ্গে আনসার আল ইসলামের একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। আনসার আল ইসলাম মাহমুদকে ১৫ লাখ টাকা দেয়।
তিনি আরো বলেন, পার্বত্য অঞ্চলে র্যাবসহ অন্যান্য বাহিনীর অভিযান শুরু হলে গ্রেপ্তার আনিসুর রহমান ওরফে মাহমুদ পাহাড় থেকে পালিয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় আত্মগোপনে থাকেন। সংগঠনকে পুনরায় সংগঠিত করার জন্য তিনি পলায়নকৃত শূরা সদস্য ও অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে; ক্লোজ গ্রুপের মাধ্যমে যোগাযোগ রক্ষা করছিল। এ সময় কেএনএফের শীর্ষ স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল। কেএনএফ প্রধান নাথান বম পার্শ্ববর্তী দেশের মিজোরামে অবস্থান করছে। বিভিন্ন সময়ে কেএনএফের হামলা ও আক্রমণের বিষয়ে তার ইন্ধন থাকতে পারে। টাঙ্গাইল, নোয়াখালী, ময়মনসিংহ, বরিশাল ও ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপনের পর ৭-১০ দিন আগে তিনি মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ের একটি বাসা ভাড়া নেয় ও সংগঠনের বেশকিছু সদস্য নিয়মিত বাসায় আসা-যাওয়া করত। নিরাপত্তার জন্য তিনি সবসময় তার সঙ্গে দুজন সশস্ত্র দেহরক্ষী রাখতেন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মুন্সীগঞ্জের যে বাসা থেকে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে সেখানে বোমা তৈরির জন্য বিভিন্ন ধরনের সরঞ্জামাদি পাওয়া গেছে। এছাড়া তার কাছে যে অস্ত্র ছিল সেটি তার আত্মরক্ষার জন্য ব্যবহার করতেন। তাদের প্রশিক্ষণের বিভিন্ন কৌশল দেখে মনে হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের নাশকতার মাধ্যমে সংগঠনের জানান দিতে চেয়েছেন।
তিনি আরো বলেন, এই সংগঠনটি এখন পর্যন্ত কেএনএফ ছাড়া বাইরের কারো সঙ্গে কোনো যোগাযোগ ছিল না। এছাড়া দেশের বাইরে এই সংগঠনের কোনো কাজ নেই।
এদিকে গণঅধিকার পরিষদের একাংশের সভাপতি সাবেক ডাকসু ভিপি নুরুল হক নূরের সঙ্গে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) যোগাযোগ খতিয়ে দেখছে বলেও জানানো হয়। নূরের বিষয়ে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, কেএনএফের ভেরিফায়েড পেজে নূরকে নিয়ে বক্তব্য উপস্থাপন করা হয়েছে। কেএনএফের সঙ্গে যোগাযোগের বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত সামনে এসেছে। যোগাযোগ রয়েছে কি না বা সংশ্লিষ্টতা রয়েছে কি না খতিয়ে দেখতে গোয়েন্দারা কাজ করছে।
কমান্ডার মঈন আরো বলেন, সূক্ষ্মভাবে যাচাই-বাছাইয়ের কাজ গোয়েন্দারা করছে। কেএনএফের সঙ্গে নূরের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে এ বিষয়ে পরে
বলা যাবে। বাহ্যিকভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও কেএনফের ভেরিফায়েড পেজে যেহেতু এ বিষয়ে মন্তব্য করা হয়েছে, সেক্ষেত্রে যোগাযোগ থাকতেই পারে।