চট্টগ্রাম নগরী যেন এডিস মশার ভাগাড়!
প্রশাসনের নেই কোনো তৎপরতা
প্রকাশ : ২৬ জুলাই ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
সাইফুদ্দিন তুহিন, চট্টগ্রাম
চট্টগ্রাম নগরী ও আশপাশের এলাকা এডিস মশার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে বহু ভবনে মিলছে এডিসসহ নানা ধরনের মশার লার্ভা। গত রোববার নগরীর কাতালগঞ্জে গণপূর্ত অধিদপ্তরের নির্মাণাধীন ভবনে মশার লার্ভা পাওয়ায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের এক প্রকৌশলীকে ৫ ঘণ্টা আটকে রাখে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ভ্রাম্যমাণ আদালত। পরে তাকে ৪০ হাজার টাকা জরিমানা করে ছেড়ে দেয়া হয়।
নগরীর বিভিন্ন স্থানে মিলছে এডিস সহ নানা জাতের মশার লার্ভা। চলতি বছরের ৯ জুলাই চট্টগ্রামে নগরীর বহদ্দারহাট ও চান্দগাঁও আবাসিক এলাকায় এডিস মশার লার্ভা খুঁজে পান স্বাস্থ্য বিভাগের কীটতত্ত্ববিদরা। ওই দিন সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত বহদ্দারহাট ও চান্দগাঁও আবাসিক এলাকায় সরেজমিন গিয়ে বিভিন্ন স্থান থেকে এডিসের লার্ভা শনাক্ত করেন তারা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মশার লার্ভা পাওয়া যায় বহদ্দারহাটের বাস টার্মিনালে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকা গাড়ির টায়ারের মধ্যে। পরীক্ষায় প্রায় প্রতিটি টায়ারেই লার্ভার অস্তিত্ব পাওয়া যায়।
পরীক্ষার সাথে যুক্ত কর্মকর্তারা জানান, নগরীর উল্লেখিত এলাকাগুলোয় যে পরিমাণ লার্ভা পাওয়া গেছে, তা আশপাশের এলাকাজুড়ে মারাত্মক বংশ বিস্তার ঘটাচ্ছে। এতে ডেঙ্গুর জীবানুবাহী এডিস মশাবাহীত রোগীর সংখ্যাও বাড়তে পারে। ৯ জুলাই দিনভর নগরীর বহদ্দারহাট টার্মিনাল, চান্দগাঁও আবাসিক এলাকার এ, বি, ডি ব্লকের কয়েকটি সড়কের বেশ কয়েকটি বাড়ির ছাদে, বাগানে সরেজমিন গিয়ে পরিদর্শন করে স্বাস্থ্য বিভাগের একটি টিম। চট্টগ্রাম বিভাগীয় কীটতত্ত্ববিদ মফিজুল হক শাহের নেতৃত্বে টিমে চট্টগ্রাম জেলা কীটতত্ত্ববিদ এনতেজার ফেরদৌস, কীটতত্ত্বীয় কর্মী সৈয়দ মো. মইনউদ্দিন ও মাকসুদুর রহমান এ কার্যক্রম পরিচালনা করেন। এ সময় তারা বহদ্দারহাট থেকে শুরু করে চান্দগাঁও, শমসেরপাড়া পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে গিয়ে সরেজমিন গিয়ে এডিস মশার জীবাণু সংগ্রহ করেন।
এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানান, এডিস মশার বিচরণ ক্ষেত্র দেখতেই চালানো হয় পরীক্ষা। সংগ্রহ করা হয় লার্ভা। তাতে সন্দেহজনক প্রায় সব জায়গায় এডিস মশার বংশবৃদ্ধির তথ্য পাওয়া যায়। ইতিমধ্যে ডেঙ্গুতে অনেকে মৃত্যু বরণ করেছে। মৃত ব্যক্তিদের ঠিকানা অনুসারে কিটতত্ত্ববিদরা অনুসন্ধান চালাচ্ছেন। এর মধ্যে বহদ্দারহাট এলাকায় প্রথম দিনেই প্রচুর লার্ভার উপস্থিতি পেয়েছে টিম। নমুনাও সংগ্রহ করেছেন তারা, পরবর্তীতে তা পরীক্ষা করে প্রতিবেদন পেলে আইইডিসিআরের সঙ্গে আলোচনা করা হবে।
এদিকে ২০২১ সালের জুলাই মাসেও একটি গবেষক দল চট্টগ্রাম নগরীর বিভিন্ন স্থানে এডিস মশার লার্ভার সন্ধান পায়। ওই বছর গবেষক দলের আহ্বায়ক চবি প্রক্টর ড. রবিউল হাসান ভূঁইয়া বলেন, নগরে মশার উপদ্রব বাড়ায় সিটি করপোরেশনকে কার্যকর ওষুধ নিশ্চিতকরণে সহযোগিতার উদ্দেশে একটি কমিটি গঠন করেন চবি উপাচার্য। জুলাই মাসে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় জরিপ চালিয়ে গবেষক দল মশার লার্ভা সংগ্রহ করে। লার্ভাগুলো লালন-পালনের পর জন্ম নেওয়া মশাগুলোর ওপর ওষুধ প্রয়োগ করে ১৫টি স্পটে শতভাগ এডিসের লার্ভা পাওয়া গেছে। তিনি আরো বলেন, গবেষণার চূড়ান্ত প্রতিবেদন সিটি করপোরেশনের হাতে হস্তান্তর করা হয়। এর আগে নগরের মশক নিধনে ব্যবহৃত ওষুধের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠার পর ২০২১ সালের ১৪ মার্চ চসিক মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীর আমন্ত্রণে চসিক কার্যালয়ে মেয়রের সাথে আলোচনা করতে যান চবি শিক্ষকদের একটি প্রতিনিধিদল। এরপর চসিকের অনুরোধে মশক নিধনে ব্যবহৃত ওষুধ পরীক্ষা করতে দেন চবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতার। ওই বছরের ২৪ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর, প্রাণ রসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. রবিউল হাসান ভূঁইয়াকে আহ্বায়ক করে ছয় সদস্যের কমিটি গঠন করেন। কমিটির সদস্য সচিব ড. মোহাম্মদ ওমর ফারুক, সদস্য অধ্যাপক ড. তাপসী ঘোষ রায়, ড. শহিদুল ইসলাম, ড. এইচএম আব্দুল্লাহ আল মাসুদ এবং মোহাম্মদ আব্দুল ওয়াহেদ চৌধুরী। এছাড়া বায়োকেমিস্ট্রি, মাইক্রোবায়োলজি ও বোটানি ডিপার্টমেন্টের ২০ শিক্ষার্থী এ গবেষণায় কাজ করেন। ওই বছরের ৫ জুলাই থেকে গবেষণার কাজ শুরু করে ছয় সদস্যের এই গবেষক দল। এরপর ৯৯টি এলাকা পরিদর্শন করে নগরীর ৫১টি ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছয়টি স্থান থেকে মশার লার্ভা সংগ্রহ করেন গবেষকরা।
এদিকে গত রোববার নগরীর কাতালগঞ্জে এক ভবনে মশার লার্ভা পাওয়ার পর তুলকালাম কাণ্ড ঘটেছে। ওই ভবনে লার্ভা নেই বলে চ্যালেঞ্জ করেন গণপূর্ত বিভাগের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের এক প্রকৌশলী। পরে তাকে আটক করে নিয়ে যান চসিকের ভ্রাম্যমাণ আদালত। এরপর ৪০ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। আটক মো. আরাফাত ইসলাম ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘দেশ উন্নয়ন লিমিটেড’র সাইট ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কর্মরত। রোববার দুপুর ১২টার দিকে অভিযানে মশার লার্ভা পাওয়ার পরও আদালতকে চ্যালেঞ্জ করেন তিনি। দ্বিতীয়বার পরীক্ষা করার পরও লার্ভা পাওয়া যায়। তখন ওই ভবনটি সিলগালা করে আরাফাতকে আটক করে চসিকের প্রধান কার্যালয়ে নিয়ে আসা হয়। পরে বিকাল ৫টার দিকে গণপূর্ত অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এসে দুঃখ প্রকাশ করেন। অভিযানে অংশ নেয়া চসিকের প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা মুহম্মদ আবুল হাশেম বলেন, নিয়মিত কাজের অংশ হিসেবে আমরা লার্ভা পরীক্ষা করতে সেখানে যাই। গণপূর্ত অধিদপ্তরের নির্মাণাধীন ভবনে জমে থাকা পানিতে আমরা আগেও মশার লার্ভা পেয়েছিলাম। ওই সময় সতর্ক করা হয়। রোববার অভিযানেও লার্ভা পাওয়া যায়। তাই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সাইট ইঞ্জিনিয়ারকে ১২টা থেকে ৫টা পর্যন্ত আটক করে রাখা হয়। বিকালে গণপূর্তের ঊর্ধ্বতন প্রকৌশলী আসার পর ৪০ হাজার টাকা জরিমানা করে ছেড়ে দেয়া হয়।
নগরীর চান্দগাঁও বহদ্দারহাট এলাকার বাসিন্দা এয়াকুব চৌধুরী বলেন, চলতি বছরের শুরু থেকে এডিস মশা ও ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ার কথা শুনে আসছি। আর চলতি জুলাই মাসে ভয়াবহ রুপ নিয়েছে। বাস্তবতা হচ্ছে এখনো এডিস মশা তাড়াতে চসিকের কোন টিমকে আসতে দেখিনি। এমনকি ফগার মেশিন নিয়েও কাউকে তৎপরতা চালাতে দেখিনি। এই এলাকায় এডিস মশার প্রকোপ বাড়লেও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কোনো ধরনের তৎপরতা নেই। তাই ডেঙ্গু রোগী ও মৃত্যুহারও বাড়ছে।