ঢাকা ৩০ অক্টোবর ২০২৪, ১৫ কার্তিক ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

সভাপতি ও অধ্যক্ষের অনিয়ম-দুর্নীতি

ধ্বংসের পথে চিতোষী ডিগ্রি কলেজের শিক্ষাব্যবস্থা

ধ্বংসের পথে চিতোষী ডিগ্রি কলেজের শিক্ষাব্যবস্থা

চাঁদপুরের সীমান্ত উপজেলা শাহরাস্তির চিতোষী ডিগ্রি কলেজের সভাপতি ও অধ্যক্ষের ধারাবাহিক অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে কলেজটির শিক্ষাব্যবস্থায় অচলাবস্থার সৃষ্টিসহ ধ্বংসের পথে চলে যাচ্ছে এ প্রতিষ্ঠানটি। এ নিয়ে গত আট মাস ধরে কলেজের সভাপতি ও অধ্যক্ষের অপসারণ দাবি করে তাদের অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে লাগাতার আন্দোলন সংগ্রাম করে যাচ্ছেন বিক্ষুব্ধ শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। এতে করে একদিকে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ায় বিঘ্ন ঘটছে। অপরদিকে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব সংঘাতের কারণে কলেজের সুনাম ক্ষুণ্ন হচ্ছে। সরেজমিন গিয়ে এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ কলেজের ৬৩ জন শিক্ষক কর্মচারীর মধ্যে ৬১ জনই সভাপতি ও অধ্যক্ষের ধারাবাহিক অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে অপসারণ দাবি করে প্রশাসনের কাছে একাধিক অনাস্থা দিয়েছেন। এ নিয়ে শাহরাস্তি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হুমায়ুন রশিদ এসব অভিযোগ আমলে নিয়ে তদন্ত করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই দফা প্রতিবেদন প্রদান করেন। এমনকি স্থানীয় সংসদ সদস্য মেজর (অব.) রফিকুল ইসলাম বীর উত্তমের হস্তক্ষেপ চেয়ে শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনার দাবি জানান। কিন্তু সভাপতি ও অধ্যক্ষ এসব কিছুর তোয়াক্কা না করে বহাল তবিয়তে রয়েছেন।

গত ২৮ মে কলেজের বিক্ষুব্ধ ৬১ জন শিক্ষক কর্মচারী ও ৫১১ জন শিক্ষার্থী লিখিতভাবে সভাপতি ও অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ দেন তাতে উল্লেখ করা হয়, সভাপতি ও অধ্যক্ষ পরস্পর যোগসাজশে আর্থিক অনিয়ম, কলেজের তহবিল তছরুপ, নিয়োগে স্বেচ্ছাচারিতা, শিক্ষক-কর্মচারীদের সঙ্গে অশালীন আচরণ, অধ্যক্ষ নিজ হাতে ব্যাংক থেকে কলেজের হিসাব থেকে লাখ লাখ টাকা উত্তোলন এবং ইচ্ছামতো বণ্টন ও আত্মসাৎ, কলেজের বিভিন্ন কমিটির সম্মানি ভাতা আত্মসাৎসহ নানা অনিয়ম করে আসছেন।

এসব অনিয়মের মধ্যে সভাপতি ও অধ্যক্ষের আর্থিক দুর্নীতির উল্লেখ যোগ্য হচ্ছে-২০২২ সালের ১৭ ডিসেম্বর থেকে এ পর্যন্ত কলেজ পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম তালুকদার ও অধ্যক্ষ মো. আনোয়ার হোসেন ভুঁইয়া মার্কেন্টাইল ব্যাংক লি. চিতোষী শাখার কলেজ হিসাব নম্বর থেকে ১৬ লাখ ১২ হাজার টাকা উত্তোলন করেন। এছাড়াও অগ্রণী ব্যাংক ও সোনালী ব্যাংকের হিসাব নম্বর থেকে আরো কয়েক লাখ টাকা উত্তোলন করেন। যার হিসাব অধ্যাবদি পর্যন্ত পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা পায়নি বলে অভিযোগ। এছাড়া তারা মার্কেন্টাইল ব্যাংক থেকে গত ঈদুল ফিতরের পূর্বে ৬ লাখ টাকা উত্তোলন করেন। এর মধ্যে ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা উৎসব ভাতা হিসেবে প্রদান করলেও বাকি ২ লাখ ৫০ হাজার

টাকার হদিস নেই। এছাড়াও কলেজের কার্যক্রম পরিচালনায় সঠিক খরচের চেয়ে অতিরিক্ত খরচ দেখিয়ে বহু ভাউচার তৈরি করা হয় বলে অভিযোগ আনা হয়।

প্রশাসনিক জটিলতার অভিযোগে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় দীর্ঘ বছরের ডিগ্রি পরীক্ষার কেন্দ্র স্থগিত করে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া হয়। সভাপতি এবং অধ্যক্ষকে ডিগ্রি কেন্দ্র স্থগিতের জন্য দায়ী করে এবং তাদের অপসারণ চেয়ে গত ১২ জুলাই দুপুরে কলেজ ক্যাম্পাসের ভেতরে ও বাহিরে কলেজের শিক্ষক-কর্মচারী-শিক্ষার্থী-অভিভাবক ও এলাকাবাসী এর প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সভা করে। কলেজের এমন পরিস্থিতিতে একাদ্বশ শ্রেণিতে শিক্ষার্থীদের ভর্তি নিয়েও দুশ্চিন্তায় রয়েছেন সাধারণ শিক্ষকরা ও এলাকাবাসী।

কলেজের পাশে অবস্থিত মনিরা আজিম একাডেমি হাইস্কুলের একজন শিক্ষক জানান, দীর্ঘ প্রায় কয়েক বছর ধরে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে কলেজের শিক্ষাব্যবস্থায় মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটছে। বিষয়টি নিয়ে দ্রুত সমাধান না এলে কলেজটি একদম ধ্বংসের দিকে চলে যাবে। কারণ প্রায়ই অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব সংঘাতের কারণে কলেজের সুনাম ক্ষুণ্ন হচ্ছে।

এই কলেজের উপাধ্যক্ষ কামরুল আহসান চৌধুরী বলেন, ১৯৮৭ সালে এলাকার ধনাঢ্য ব্যক্তি কর্নেল (অব.) আনোয়ার উল আজিম কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেন। অত্র অঞ্চলে কলেজটির যথেষ্ট সুনাম ও সুখ্যাতি রয়েছে। ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর অবসর জনিত কারণে অধ্যক্ষর পদটি শূন্য হয়। বর্তমান সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম তালুকদার দায়িত্বে আসার পর থেকে

কলেজটির অচলাবস্থার সূত্রপাত ঘটে। বিধি বহির্ভূতভাবে বিতর্কিত ব্যক্তি মো. আনোয়ার হোসেন ভূঁইয়াকে অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ প্রদানের পর থেকেই এর চূড়ান্ত রূপ নেয়।

কামরুল আহসান চৌধুরী বলেন, ২০২১ সালের ৩১ জানুয়ারি আমাকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ করা হয়। কিন্তু ২০২২ সালের ৮ জুলাই জাহাঙ্গীর আলম কোনো ধরনের নোটিশ ছাড়াই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিধি লঙ্ঘন করে আমাকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ পদ থেকে সরিয়ে আমার জুনিয়র কামরুন নাহারকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ করেন। এরপরই অবৈধভাবে নিয়োগ দেন বর্তমান অধ্যক্ষ মো. আনোয়ার হোসেন ভুঁইয়াকে। এরপর থেকেই কলেজ পরিচালনায় চরম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। ওই অধ্যক্ষকে সঙ্গে নিয়ে সভাপতি তার ক্ষমতা খাটিয়ে কলেজটি ধ্বংস করার জন্য একের পর এক অনিয়ম করে যাচ্ছেন। ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের বিষয়টি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা পরিপন্থি মনে করে কামরুল আহসান চৌধুরী এ নিয়ে হাইকোর্টে রিট করেন। এসব অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ালেও তার অবমাননার মামলাও খান সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম তালুকদার।

শিক্ষক প্রতিনিধি আনিছুর রহমান ভুঁইয়া বলেন এই কমিটির প্রথম মিটিং এ কলেজটি সরকারি ছুটি থাকাকালীন সময়ে সভাপতি ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ কামরুল আহছান চৌধুরীকে অপসারণ করেন। কিন্তু এটি মিটিংয়ের এজেন্ডাতে ছিল না। এই বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্তও হয়নি। যা পরবর্তীতে অন্তর্ভুক্ত করা

হয় শেষের দিকে এজেন্ডা যুক্ত করে। এটা স্পষ্টত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিধি লঙ্ঘন, যার পরিপ্রেক্ষিতে মাউশির কুমিল্লা অঞ্চলের পরিচালক নিয়োগ কার্যক্রম বন্ধ রাখার জন্য নির্দেশনা প্রদান করেন। কিন্তু সভাপতি কোনো কিছুই তোয়াক্কা করেননি।

শিক্ষক প্রতিনিধি সামছুন্নাহার বেগম বলেন, কামরুন্নাহারকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নিয়োগ দিয়ে নতুন অধ্যক্ষ নিয়োগের সময় আমাদের কোনো স্বাক্ষর নেয়া হয়নি। আমাদের জানানো হয়নি। সভাপতি সব সিদ্ধান্ত নেয়ার পর আমাদের স্বাক্ষর নিতে এলে আমরা শিক্ষক প্রতিনিধি তিনজনসহ কয়েকজন অভিভাবক সদস্য স্বাক্ষর প্রদানে বিরত থাকি। যাকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ করা হয়, তিনিও কলেজের টাকা আত্মাসাৎ করেছেন। শুধু তাই নয়, গত এইচএসসি পরীক্ষায় কামরুন্নাহার ভুল প্রশ্নের সেট দিয়ে পরীক্ষা নেয়ায় কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ড থেকে তাকে শোকজ করা হয়। পরবর্তীতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় তার বেতন বন্ধ করেন। সেসব প্রমাণ আমাদের কাছে আছে।

সহকারী অধ্যাপক মো. একরাম হোসেন বলেন, কলেজটি উপজেলার শ্রেষ্ঠ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এখানে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার ফলাফলও ভালো হয়। কিন্তু সভাপতি তার অনুগত লোককে অধ্যক্ষ নিয়োগ দিয়ে নানা অনিয়ম অব্যাহত রেখেছেন। এভাবে ধারাবাহিক আর্থিক অনিয়মের কারণে এবং বিভিন্ন ভাতা আটকে রাখায় শিক্ষক কর্মচারীদের মধ্যে চরম অসন্তোষ বিরাজ করছে। কলেজ অধ্যক্ষ মো. আনোয়ার হোসেন ভুঁইয়া বলেন, আমি অভিযোগ হওয়ার মতো কোনো কাজ করিনি। আমার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকলে সেটা প্রমাণ করুক।

কলেজ পরিচালনা কমিটির সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম তালুকদার বলেন, আমি এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে রাজি না। কারণ আদালতে মামলা চলমান।

শাহরাস্তি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ হুমায়ন রশিদ বলেন, আমি প্রথম ২০২২ সালের ১৩ ডিসেম্বর কুমিল্লা মাউশির আঞ্চলিক কর্মকর্তা কর্তৃক প্রেরিত চিঠি পাই। সেখানে অধ্যক্ষ নিয়োগের কার্যক্রম স্থগিত রাখতে বলা হয়। পরবর্তীতে বিভিন্ন অনিয়ম সম্পর্কে অভিযোগ পেয়ে তা তদন্তপূর্বক পর পর দুইবার প্রতিবেদন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও জেলা প্রশাসকের কাছে জমা দেওয়া হয়।

কলেজের প্রতিষ্ঠাতা আনোয়ার উল আজিম বলেন, আমি এ কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেছি ধ্বংসের জন্য নয়। যারাই এর পেছনে থেকে ধ্বংসের চেষ্টা চালাচ্ছেন লাভ হবে না। এ বিষয়ে আমি স্থানীয় এমপি মহোদয়কে অনুরোধ করব এটি রক্ষায় ভালো ভূমিকা নেবেন।

চাঁদপুর-৫ আসনের সাংসদ রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম বলেন, কলেজের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব নিয়ে উচ্চ আদালতে মামলা চলমান আছে। আমার এ বিষয়ে কিছুই করার নেই। তবে কলেজটি যেহেতু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ই একমাত্র এর সমাধান দিতে পারে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত