ঢাকা ৩০ অক্টোবর ২০২৪, ১৫ কার্তিক ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

অন্যরকম

লুসাই সম্প্রদায় : রীতি আর বিশ্বাসে রয়েছে ভিন্নতা

লুসাই সম্প্রদায় : রীতি আর বিশ্বাসে রয়েছে ভিন্নতা

বাংলাদেশে বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষের বাস রয়েছে। সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যে ভিন্নতা রয়েছে তাদের। এমনই একটি জনগোষ্ঠী লুসাই। এই প্রতিবেদনে তাদের নানা বিষয় নিয়েই আলোচনা করা হবে।

ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী লুসাইয়ের বাস পূর্ব বাংলাদেশ, উত্তর-পূর্ব ভারত এবং মায়ানমারে। নিজেদের মঙ্গোলীয় জনগোষ্ঠীর বংশধর বলে পরিচয় দেয় তারা। বিখ্যাত লুসাই পাহাড়ের নামে তাদের নামকরণ করা হয়েছে। চাকমাদের কাছে তারা ‘কুগী’ নামে পরিচিত। এছাড়া মারমারা ‘লাঙ্গী’ ও ত্রিপুরারা ‘শিকাম’ নামে ডাকে তাদের।

দেশের তিন পার্বত্য জেলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে তারা। ভারতের মিজোরামে বিপুলসংখ্যক লুসাই জনগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে। তাই তাদের মিজো জাতিও বলা হয়। বাংলাদেশে মূলত রাঙ্গামাটি সদরের বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক উপত্যকায় এবং বান্দরবানের জেলা সদর ও রুমায় এই জাতির বাস।

লুসাইদের ধর্ম কী?

একসময় লুসাই জনগোষ্ঠী জড়োপাসক ও সর্বপ্রাণবাদে বিশ্বাসী ছিল। তারা ভূতপ্রেত, অপদেবতা ইত্যাদি বিশ্বাস করত। এসব ভূতপ্রেত ও অপদেবতার উদ্দেশ্যে পশু দিয়ে শির পূজা ও নদী পূজা করত তারা। অতীতে লুসাইরা একেক গ্রামে একেক নিয়মে দেবদেবীর পূজা করত। পরবর্তীতে তাদের মধ্যে খ্রিস্টান ধর্ম বিস্তার লাভ করে। বর্তমানে প্রায় সব লুসাই খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী।

লুসাইদের জীবিকা কী?

যেসব লুসাই নৃ-গোষ্ঠী পাহাড়ে বাস করে তারা জুম ও চাষাবাদ এবং পাহাড়ি বনজ সম্পদের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে। আর যারা শহরের বসবাস করে তারা বিভিন্ন পেশার মাধ্যমে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করে থাকে।

লুসাইদের বিবাহ রীতি

খ্রিস্টধর্ম গ্রহণের পর লুসাই জাতির বিবাহ অনুষ্ঠানে খ্রিস্টধর্মীয় রীতিনীতি পালন অনেকটা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। অধিকাংশ বিয়ে হয় পাত্র-পাত্রীর পছন্দেই। তবে তাতে সম্মতি থাকতে হয় উভয় পক্ষের অভিভাবকদের। লুসাই সমাজে স্বীকৃত বিবাহের পূর্বশর্ত হচ্ছে ‘ইননেহ্য়না’ অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে লুসাই বিবাহিত দম্পতি সমাজসিদ্ধভাবে একত্রে বসবাস ও দৈহিক মিলনের মাধ্যমে সন্তান জন্মদানের অধিকার লাভ করে। এই রীতি না মানলে লুসাই সমাজে নর-নারীর দৈহিক মিলন ও সন্তান জন্মদান সমাজসিদ্ধ নয় বিধায় অবৈধ বলে গণ্য হয়।

লুসাইদের বিয়ের কিছু সামাজিক রীতিও রয়েছে। রীতি অনুযায়ী পাত্রপক্ষ থেকে ‘পালাহ’র (ঘটক) মাধ্যমে পাত্রীপক্ষের অভিভাবকের নিকট বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতে হয়। পাত্রীর অভিভাবকের সম্মতি পাওয়া গেলে পাত্রীর পিতামহ অথবা তার অবর্তমানে পাত্রীর পিতার দাবি অনুসারে পাত্রপক্ষকে ‘কনে পণ’ দিতে হয়। পণ বাবদ গবাদি পশু কিংবা সমমূল্যের টাকা প্রদান করতে হয়। ‘কনে পণ’ দিতে ব্যর্থ হলে পাত্রের ঔরসজাত পুত্র কিংবা নাতি পর্যন্ত এই পণ পরিশোধ করতে বাধ্য থাকে। এই পণকে লুসাইদের ভাষায় ‘মান ইন হ্লান’ বলে।

যেদিন ‘কনে পণ’ দেওয়া হয়, সেদিনই কনেপক্ষ ভোজের আয়োজন করে এবং বিয়ের দিন (ইননেহ্য়না) ধার্য করে। এই অনুষ্ঠানে বরপক্ষ এসে ‘ইননেহ্য়না’ সম্পন্ন করে। অনুষ্ঠানের এক মাস পর বর-কনের দেখা এবং বরের বাড়িতে কনে বউ নেওয়া হয়।

খ্রিস্ট ধর্মীয় রীতি অনুসারে বর্তমানে চার্চে ‘বান’ প্রকাশের মাধ্যমে লুসাই পাত্রপাত্রীর বিবাহ হয়। রীতি অনুযায়ী তাদের একই সময়ে একাধিক বিয়ের অনুমতি নেই। লুসাইদের বিয়ের জন্য সাবালক হওয়া বাধ্যতামূলক। সাবালকত্ব অর্জনের বিষয়টিকে তাদের সমাজে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়। পাত্রের ক্ষেত্রে ‘থুরুং’ (বেতের তৈরি বড় ঝুড়ি বিশেষ) তৈরি, জুম চাষ, ঘরবাড়ি তৈরির কাজে পারদর্শী এবং ভারবহনের ক্ষমতাকে সাবালকত্বের মাপকাঠি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

লুসাই শিশুর জন্মশুদ্ধি ও আচার-অনুষ্ঠান

লুসাই সম্প্রদায়ে নতুন শিশুর জন্ম বেশ আনন্দের বিষয়। তাই কারো জন্মগ্রহণের বিষয়টিকে স্মরণীয় করে রাখার চেষ্টা করা হয়। শিশু জন্মের তিন দিন পর আত্ময়ীস্বজনকে নিমন্ত্রণ দিয়ে একটি গয়াল বা একটি শুকর বধ করে আপ্যায়নের ব্যবস্থা করা হয়। এ অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে বাড়ির সামনে একটি লম্বা পরিপক্ব গাছের সার অংশটি মাটিতে পুঁতে রাখা হয়। এই অনুষ্ঠানে শিশুর নামকরণ করা হয়। লুসাই দম্পতির প্রথম সন্তানের ক্ষেত্রে পিতৃকুলের পিতামহ-পিতামহী নামকরণ করেন।

লুসাইদের সৎকার রীতি কেমন?

লুসাই সমাজে সামাজিক বন্ধন বেশ শক্তিশালী। অন্যের বিপদে তারা দ্রুত এগিয়ে আসে। কেউ মারা গেলে গ্রামবাসী সবাইকে মৃতের জন্য শোক প্রকাশ করতে হয়। লুসাই সমাজে মৃত্যুর পর মৃতদেহ কবর দেওয়া হয়। সমাজের আদি রীতি অনুযায়ী মৃতের আত্মার উদ্দেশ্যে পশু বলি দিয়ে ভোজের আয়োজন করা হয়।

তবে বর্তমানে খ্রিষ্ট ধর্ম গ্রহণের পর এ প্রচলন আর নেই। খ্রিষ্ট ধর্মীয় রীতি অনুসারে কবর দেওয়া এবং ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করা হয়। যুবকরা কবর প্রস্তুত করে এবং একটি পাথরে মৃত ব্যক্তির নাম, মৃত্যুর তারিখ এবং তার গ্রাম ইত্যাদি লিখে কবরের ওপর মাটিতে পুঁতে রাখে।

লুসাই জনগোষ্ঠীর সামাজিক রীতিনীতি ও উৎসব

সামাজিক ও ধর্মীয় উৎসবে ভরপুর জনগোষ্ঠী লুসাই। ধর্মীয় উৎসব পালন ছাড়াও তারা বছরে প্রধান তিনটি উৎসব পালন করে থাকে। এগুলো হলো চাপচারকূত (বসন্ত উৎসব), মীমতূত (মৃত আত্মাদের স্মরণ) এবং পলকূত (শস্য কাটার উৎসব)।

এছাড়া রয়েছে চাপচার কুট, মনকুট, পাল কুট। লুসাইদের মাতৃভাষায় রচিত বিভিন্ন গান ও আদি নৃত্য পরিবেশন করা হয় উৎসবে। জুমের ঘাস কাটা শেষে করা হয় মনকুট উৎসব। চাপচার কুট হলো নবান্ন উৎসব। জুমের ধান কাটা শেষ হলে এই উৎসব করা হয়।

প্রায় এক সপ্তাহ ধরে চলে লুসাইদের খ্রিস্টমাস বা বড়দিনের আনন্দ উৎসব। প্রার্থনা, কেক কাটা, নাচ গানের মধ্যদিয়ে আনন্দ উৎসবে মেতে উঠে তারা। বড় দিনকে ঘিরে আনন্দমুখর হয়ে উঠে লুসাই পল্লীগুলো। সাজানো হয় গির্জাগুলো।

সকালে গির্জায় গির্জায় প্রার্থনার মধ্যদিয়ে শুরু হয় বড় দিনের উৎসব। বান্দরবান শহরের লুসাই বাড়ি গির্জা, ফাতিমা রাণী ক্যাথলিক গির্জা, কালাঘাটা ত্রিপুরা পাড়া গির্জা, নতুন ব্রিজ ইসিবি গির্জাসহ বিভিন্ন স্থানে সকালে যিশু খ্রিস্টের সম্মানে প্রার্থনার আয়োজন করা হয়। শহরের কাছে চিম্বুক পাহাড়ের ফারুক পাড়া, লাইমী পাড়া, গ্যাস্বমনি পাড়াসহ সেখানকার বম সম্প্রদায়ের পাড়াগুলোতে বড় দিনে উৎসবের বন্যা বয়ে যায়। নতুন কাপড় পরে এই প্রার্থনায় অংশ নেয় সবাই। পাড়ায় পাড়ায় আয়োজন করা হয় ভোজের।

বর্ণিল পোশাক-পরিচ্ছদ

অতীতে লুসাইরা পশুর চামড়া দিয়ে তৈরি পোশাক পরিধান করতেন। পরবর্তীকালে তুলা থেকে উৎপন্ন সুতা দিয়ে তৈরি ‘হ্নখাল’ নামে এক ধরণের চাদর প্রথমে লুসাই পুরুষরা এবং পরে নারীরা ব্যবহার শুরু করেন। সময়ের বিবর্তনে এখন নারীরা কোমর-তাঁত দিয়ে ‘পুয়ানফেল’ (থামি), ‘করচুং’ প্রভৃতি এবং পুরুষরা ‘করচুর’ (শার্ট) ও পুয়ানবি (লুঙ্গি) তৈরি করে ব্যবহার করতে শুরু করেন।

লুসাই নারীরা বিভিন্ন ধরনের থামি যেমন পুয়ান রৌপুই, পুয়ান চেই, পুয়ানদুম, ঙৌতে খের পরিধান করেন। তারা বিভিন্ন নকশার অলংকার দিয়ে নিজেদের সাজাতে পছন্দ করেন। দামি পাথরের মালা পরেন লুসাই নারীরা। অতীতে লুসাই বিবাহ অনুষ্ঠানে বর জামা ও লুঙ্গি এবং কনে ব্লাউজ ও থামি পরলেও বর্তমানে বর শার্ট-প্যান্ট এবং কনে সাদা গাউন পরিধান করেন। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের পোশাকেও পরিবর্তন এনেছে তারা।

লুসাইদের লোকবিশ্বাস

লুসাই জনগোষ্ঠী মনে করে, তাদের কারো মৃত্যুর পর মৃতের আত্মা ‘মিথিখুয়া’ নামক মৃতপূরীতে বাস করে। মিথিখুয়াতে অবস্থানকালে প্রত্যেকের নিজ নিজ কর্মফলের বিচার হবে। কর্মফল অনুসারেই তারা স্বর্গে (পিয়াল রাল) যেতে পারবে। পৃথিবী ছেড়ে মিথিখুয়াতে যাবার (থি টিন থলা) মাস ধরা হয় আগস্টকে। আর তাই লুসাই সমাজে এই মাসে কোনো বিয়ের অনুষ্ঠান বা বিনোদনমূলক উৎসব করা হয় না। বর্তমানেও এ রীতি মানেন তারা।

অনেক ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী মাতৃতান্ত্রিক হলেও লুসাই সমাজব্যবস্থা মূলত পিতৃতান্ত্রিক। তবে বর্তমানে বাংলাদেশে লুসাই জনগোষ্ঠী অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে। দেশে তাদের মোট জনসংখ্যা ২ হাজারেরও কম।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত